আমরা জানি পাঠকরা বাস্তবে ঠিক কতখানি অভিভূত হয়েছিলেন। দেশে-বিদেশে দলে দলে তরুণদের দল হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে পথে নেমেছিল। সেই ধারা এখনো অব্যাহত। আমার ধারণা, এটা চলবে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে...
Advertisement
হুমায়ূন আহমেদ হিমুকে নিয়ে লিখে গেছেন একুশটি পূর্ণ উপন্যাস। সেগুলোর কালক্রম হলো- ময়ূরাক্ষী (১৯৯০), দরজার ওপাশে (১৯৯২), হিমু (১৯৯৩), পারাপার (১৯৯৩) এবং হিমু (১৯৯৫), হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম (১৯৯৬), হিমুর দ্বিতীয় প্রহর (১৯৯৭), হিমুর রূপালী রাত্রি (১৯৯৮), একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁঝিঁ পোকা (১৯৯৯), তোমাদের এই নগরে (২০০০), চলে যায় বসন্তের দিন (২০০২), সে আসে ধীরে (২০০৩), আঙুল কাটা জগলু (২০০৫), হলুদ হিমু কালো র্যাব (২০০৬), আজ হিমুর বিয়ে (২০০৭), হিমু রিমান্ডে (২০০৮), হিমুর মধ্যদুপুর (২০০৯), হিমুর নীল জোছনা (২০১০), হিমুর আছে জল (২০১১), হিমু এবং একটি রাশিয়ান পরী (২০১১), হিমু এবং হার্ভার্ড Ph.D. বল্টুভাই (২০১১)।
এই উপন্যাসগুলোর মধ্যে প্রথম পনেরোটি হিমু সমগ্র- ০১ এবং পরবর্তী ছয়টি হিমু সমগ্র- ০২ নামের বইয়ে লিপিবদ্ধ আছে। এছাড়াও হিমুকে নিয়ে বিভিন্ন সময়ে খন্ডিত আকারে আরও কিছু লেখা আছে- হিমু মামা (২০০৪), হিমুর একান্ত সাক্ষাৎকার (২০০৮), হিমুর বাবার কথামালা (২০০৯), ময়ূরাক্ষীর তীরে প্রথম হিমু (অগ্রন্থিত)। যখন হিমু সমগ্র - ০১ প্রকাশিত হয় তখন লেখকের ভূমিকায় লিখেছিলেন- ‘হিমুকে নিয়ে কতগুলো বই লিখেছি নিজেও জানি না। মন মেজাজ খারাপ থাকলেই হিমু লিখতে বসি। মন ঠিক হয়ে যায়।’ এখানে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে লেখক স্বীকার করে নিচ্ছেন যখন মন মেজাজ খারাপ থাকে তখনই কেবল হিমু লেখার কথা মনে হয়। এর থেকে আমি যেটা বুঝেছি সেটা হলো পারিপার্শ্বিক সমস্যাগুলো যখন তাকে কাঁতর করে তুলতো।
স্বাভাবিক বিচার বুদ্ধি দিয়ে সেই সমস্যাগুলো সমাধান করা যেত না তখনই তিনি হিমুর মাধ্যমে সেই সমস্যাগুলোর সমাধান করিয়ে নিতেন অত্যন্ত সুনিপুণভাবে। এটা বলছি কারণ একজন সাধারণ পাঠক শুধু এই উপন্যাসগুলোর বাইরের খোলসটা পড়েই তৃপ্তি বোধ করবেন। কিন্তু একটু গভীরে দৃষ্টি দিলেই আপনি খুব সহজেই অনুধাবণ করতে পারবেন লেখক কি চমৎকারভাবেই না সমাজের সমস্যাগুলো নিয়ে ব্যঙ্গ বিদ্রুপ করেছেন। যখন হিমু সমগ্র- ০২ প্রকাশিত হয় তখন প্রকাশক লিখেছেন- প্রকাশনালগ্নে যতটা আনন্দ ঠিক ততটাই কারণ হুমায়ূন আহমেদ আর কখনও হিমু লিখবেন না।’ একই মতামত আমারও। আর কেউ এমন হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিমায় সমাজের সমস্যাগুলো তুলে ধরবেন না। আমরা এখন একটু হিমু চরিত্রের সৃষ্টির সময়ের দিকে নজর দিতে চাই। হিমুকে লেখা প্রথম উপন্যাসের নাম ছিল ‘ময়ূরাক্ষী’। সেটা ছিল নিতান্তই একটা মানবিক উপন্যাস।
Advertisement
আমার ধারণা লেখকের মাথায় তখনও হিমুকে নিয়ে আলাদা সিরিজ করার কোনো ভাবনা ছিল না। হিমু সিরিজের তৃতীয় উপন্যাসের ভূমিকায় লেখক এই বিষয়টা কিছুটা খোলাসা করেছেন- ‘হিমু আমার প্রিয় চরিত্রের একটি। যখন হিমুকে নিয়ে কিছু লিখি—নিজেকে হিমু মনে হয়, একধরনের ঘোর অনুভব করি। এই ব্যাপারটা অন্য কোনো লেখার সময় তেমন ঘটে না।... মানুষ হিসেবে আমি যুক্তিবাদী। হিমুর যুক্তিহীন, রহস্যময় জগৎ একজন যুক্তিবাদীকে কেন আকর্ষণ করবে? আমার জানা নেই।’
দ্বিতীয় উপন্যাসের নাম ‘দরজার ওপাশে’। এই উপন্যাসের ভূমিকায় লেখক হিমুর পরিচয় কিছুটা খোলাসা করেছেন - ‘তার ডাক নাম হিমু। ভালো নাম হিমালয়। বাবা আগ্রহ করে হিমালয় নাম রেখেছিলেন, যেন বড় হয়ে সে হিমালয়ের মতো হয়- বিশাল ও বিস্তৃত, কিন্তু ধরা ছোঁয়ার বাইরে নয়। হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়। ইচ্ছে করলে তিনি ছেলের নাম সমুদ্র রাখতে পারতেন। সমুদ্রও বিশাল এবং বিস্তৃত।’
‘সমুদ্রকে হাত দিয়ে স্পর্শ করা যায়। তার চেয়েও বড় কথা, সমুদ্রে আকাশের ছায়া পড়ে। কিন্তু তিনি সমুদ্র নাম না রেখে রাখলেন হিমালয়।...হিমু কাজ করে এন্টি-লজিক নিয়ে। আমাদের এই জগতে এন্টি-লজিকের স্থান নেই।’
আরও পড়ুন: যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন, শুভ জন্মদিন
Advertisement
‘হিমুর রূপালী রাত্রিতে লেখক হিমুকে নিয়ে আবারও লিখছেন- ‘সে আমার নিজের ভেতর হতাশা তৈরি করে যাচ্ছে। ইদানীং প্রায়ই মনে হয় আমি কেন হিমু হতে পারছি না। জীবন থেকে আনন্দময় স্বেচ্ছা নির্বাসন নিতে বাধা কোথায়? ভরা জোজনায় হলুদ একটা পাঞ্জাবি পরে প্রকৃতির কাছে ফিরে যাওয়া খুবই কি জটিল ব্যাপার? আমরা কে, আমরা কোত্থেকে এসেছি, আমরা কোথায় যাচ্ছি এসব না ভেবে-নিজেকে জোছনা বা বৃষ্টির অংশ কি ভাবা যায় না?’
‘হিমু তা পারে, আমি পারি না কেন?’ হিমুকে নিয়ে লেখক অনেক ধরনের পরীক্ষা নীরিক্ষা করেছেন। ‘হিমুর দ্বিতীয় প্রহর’ উপন্যাসে লেখক হিমুর সঙ্গে মিসির আলির দেখা করিয়ে দিয়েছেন। লেখকের ভাষায় - ‘দুজন মুখোমুখি হলে অবস্থাটা কি হয় দেখার আমার খুব কৌতুহল। ম্যাটার এবং এন্টিম্যাটার একসঙ্গে হলে যা হয় তার নাম শূন্য। মিসির আলি এবং হিমুওতো এক অর্থে ম্যাটার এবং এন্টিম্যাটার। দুটি চরিত্রের ভেতর কোনটিকে আমি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি সেটা জানার জন্যও এদের মুখোমুখি হওয়া দরকার।’
হিমুকে আবার লেখক জটিল পরিস্থিতির মধ্যেও ঠেলে দিয়েছেন। ‘একজন হিমু কয়েকটি ঝিঁঝি পোকা’ উপন্যাসের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন- ‘হিমু কখনো জটিল পরিস্থিতিতে পড়ে না। ছোটখাট ঝামেলায় সে পড়ে। সেসব ঝামেলা তাকে স্পর্শও করে না। সে অনেকটা হাঁসের মতো। ঝাড়া দিলো গা থেকে ঝামেলা পানির মতো ঝরে পড়ল। আমার খুব দেখার শখ বড় রকমের ঝামেলায় পড়লে সে কী করে।’
‘কাজেই হিমুর জন্যে একটা বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করেছি। এবং আগ্রহ নিয়ে তার কাণ্ড-কারখানা দেখছি।’ কখনও বা আবার হিমুকে স্থল থেকে নিয়ে জলের মধ্যে ছেড়ে দিয়েছেন। ‘হিমুর আছে জল’ উপন্যাসের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন - ‘হিমুর পায়ের নিচে সবসময় মাটি থাকে। সে হেঁটে বেড়ায় বিষণ্ণ ঢাকা নগরীর পথে পথে। আচ্ছা, তার পায়ের নিচে থেকে মাটিয়ে সরিয়ে নিলে কেমন হয়। সে থাকুক কিছু সময় পানির ওপরে। দেখা যাক চিন্তাভাবনায় কোনো পরিবর্তন আসে কি না।’ এই উপন্যাসেই লেখক হিমুকে তার কাছাকাছি চরিত্রের এক তরুণীর সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেন।’
বাংলাদেশের বিশেষ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী হিসেবে ২০০৪ সালে গঠন করা হয় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন সংক্ষেপে র্যাব (RAB). এই বাহিনী শুরুর দিকে অনেক সুনাম অর্জন করলেও ধীরে ধীরে অন্য আর দশটা সরকারি সংস্থার মতো দুর্নীতিতে পর্যবসিত হয়। ‘হলুদ হিমু কালো র্যাব’ উপন্যাসে সেই উত্তাল সময়ের ছাপ খুবই স্পষ্ট। এরপর ২০০৯ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসে বর্তমানের ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।
বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা এমনই যে ‘যেই যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ’ কথাটা খুবই প্রকট হয়ে উঠে। ‘হিমুর নীল জোছনা’ বইয়ে লেখক রাষ্ট্র ক্ষমতার মানুষদের থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং ক্ষমতার উচ্ছিষ্ট ভোগকারী সবাইকেই কটাক্ষ করেছেন। ক্ষমতা আর ভাগাভাগির লোভে যে হরহামেশাই এসব ভোক্তাদের মধ্যে আন্ত কলহ সৃষ্টি হয় সেদিকেও দৃষ্টি দিয়েছেন। কিন্তু সেটা করেছেন হিমুর মাধ্যমে যার ফলে আমার ধারণা সবাই সেটাকে নিয়েছিলেন না হলে এই উপন্যাসের জন্য লেখকের যথেষ্ট ভোগান্তি পোহানোর কথা ছিল বলেই আমার মনে হয়।
হিমু সিরিজের সর্বশেষ উপন্যাসের নাম ‘হিমু এবং হার্ভার্ড Ph.D. বল্টু ভাই’। এই উপন্যাসের ভূমিকায় তিনি লিখেছেন - ‘হিমু-বিষয়ক প্রতিটি লেখাতেই আমি এই ভুবনের রহস্যময়তার দিকে ইঙ্গিত করেছি। এর বেশি কিছু না। আমি নিজে জগতের রহস্যময়তা দেখে প্রতিনিয়ত অভিভূত হই। আমি চাই, আমার পাঠকরাও অভিভূত হোক।’
আমরা জানি পাঠকরা বাস্তবে ঠিক কতখানি অভিভূত হয়েছিলেন। দেশে-বিদেশে দলে দলে তরুণদের দল হলুদ পাঞ্জাবি পরে খালি পায়ে পথে নেমেছিল। সেই ধারা এখনো অব্যাহত আছে। আমার ধারণা এটা চলবে যতদিন বাংলাদেশ থাকবে। লেখক নিজেই ‘চলে যায় বসন্তের দিন’ উপন্যাসের ভূমিকায় অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে কলকাতার একজন হিমুর কথা উল্লেখ করেছেন যিনি বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। এছাড়াও লেখক ‘সে আসে ধীরে’ উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছিলেন বাস্তবের আরেকজন হিমু স্বাধীন খসরুকে।
হিমু একটা প্রজন্মের আবেগের নাম। অনেকেই হিমু চরিত্রকে বিভিন্নভাবে বিদ্রুপ করেছেন। আমি নিশ্চিত করেই বলতে পারি তারা কেউই হিমুর আসল উদ্দেশ্য ধরতে পারেননি। হিমু তার সহজ, সরল, অনাড়ম্বর জীবনবোধ দিয়ে আমাদের সমাজে চলমান প্রত্যেকটা সমস্যাকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। পাশাপাশি সেই সমস্যাগুলো তার ম্যাজিক রিয়েলিজম’র মাধ্যমে সমাধান করার চেষ্টা করেছে। যখন সেটা সম্ভব করতে পারেনি তখন সেটা নিয়েই জীবনযাপন করতেও শিখিয়ে গেছে।
ফুটবল খেলায় হলুদ কার্ড দেখানো হয় খেলোয়াড়দের অখেলোয়াড়সুলভ আচরণের জন্য। ঠিক একইভাবে হুমায়ূন আহমেদ তার স্বভাবসুলভ হাস্যরস দিয়ে হিমুর হলুদ পাঞ্জাবির মাধ্যমে যেন আমাদের সমাজে চলমান সকল প্রকার অনিয়ম, অনাচার, অন্যায়, অপরাধ, শ্রেণি বৈষম্য সর্বোপরি দুর্নীতিকে হলুদ কার্ড দেখিয়েছেন। আরও একটা ব্যাপার লক্ষণীয় সেটা হলো হিমু হাটে রাতের বেলা এবং খালি পায়ে। রাতের অন্ধকারে অপরাধপ্রবণতা অনেক বেড়ে যায় তাই হিমু যেন রাত জেগে দেশটাকে পাহারা দেয়। আমি যতদূর জানি ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভাতফেরীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা খালি পায়ে হেঁটেছিলেন। সেই জন্যই কি হিমুও খালি পায়ে হাটে?
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যখন হিমুর কোনো বই পড়বে তখন তাদের সামনে মূর্ত হয়ে উঠবে বাংলাদেশের আশি নব্বুইয়ের দশকের আর্থ-সামাজিক প্রতিচ্ছবি। হিমুর পাশাপাশি হুমায়ূন আহমেদ এর সকল সৃষ্টিই গবেষণার দাবি রাখে। কারণ বাংলাদেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের জীবন এবং মননকে হুমায়ূন আহমেদ এর চেয়ে ভালো করে আর কেউ বোঝেননি।
এমআরএম/জিকেএস