জাতীয়

জ্বালানি তেল খালাসের নতুন যুগে বাংলাদেশ

আমদানিকৃত পেট্রোলিয়াম ক্রুড পরিশোধিত জ্বালানি খালাসে মহেশখালীতে নির্মিত এসপিএম (সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং) প্রকল্পের উদ্বোধন আজ (১৪ নভেম্বর)।

Advertisement

মঙ্গলবার (১৪ নভেম্বর) গণভবন থেকে এক ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রকল্পটির উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এজন্য যাবতীয় প্রস্তুতি নিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ।

বিপিসির অর্থায়নে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার কোটি টাকায় বিপিসির অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড “ইনস্টলেশন অব সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং উইথ ডাবল পাইপলাইন” প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে। ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. লোকমান জাগো নিউজকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, আজ প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে এসপিএম প্রকল্পের সফট ওপেনিং করবেন।

জানা যায়, বর্তমানে এক লাখ টনের ক্রুড অয়েলবাহী একটি মাদার ভ্যাসেল খালাস নিতে কমপক্ষে ১১ দিন সময় লাগে। সেখানে এসপিএম পুরোদমে চালু হলে ২৮ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিজেল ও ক্রুড অয়েলবাহী জাহাজ খালাস করা সম্ভব হবে। এতে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে জানিয়েছে বিপিসি। তবে প্রাথমিক অপারেশনাল কার্যক্রম শুরু হলেও পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ হতে আরও কয়েক মাস সময় লাগবে।

Advertisement

এদিকে গত ৩ জুলাই ক্রুড অয়েলের প্রথম কমিশনিংয়ে শুরুর ৫ ঘন্টা পর বন্ধ করে দেওয়া হয়। মূলত এসপিএমের সঙ্গে আটকানো জাহাজের মুরিং হোসার (রশি) ছিঁড়ে যাওয়ায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা খালাস বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন বলে জানিয়েছে বিপিসির একাধিক সূত্র। পরে সনাতন পদ্ধতিতেই লাইটারিংয়ের মাধ্যমে ‘এমটি হোরে’ নামের জাহাজটি খালাস করে বিপিসি। মূলত এসপিএমের সঙ্গে আটকানো জাহাজের মুরিং হোসার ছিঁড়ে যাওয়ায় বিপত্তি তৈরি হয়। এসময় তেল খালাসের ভাসমান হোস পাইপ ফেটে গেলে সাগরে কিছুটা ক্রুড অয়েল ছড়িয়ে পড়ে। এরইমধ্যে পুনরায় কমিশনিংয়ের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। নভেম্বর মাসের শেষের দিকে এসপিএম কমিশনিং হতে পারে।

বিপিসি সূত্রে জানা গেছে, ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের (ইআরএল) এখন ক্রুড অয়েল (অপরিশোধিত জ্বালানি তেল) পরিশোধন ক্ষমতা বছরে ১৫ লাখ মেট্রিক টন। বর্তমানে নির্মাণাধীন ইউনিট-টু প্রকল্প চালু হলে ইআরএলের ক্রুড অয়েল পরিশোধন ক্ষমতা বছরে ৪৫ লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়াবে। অন্যদিকে দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে বছরে প্রায় ৫০ লাখ মেট্রিক টন ডিজেল আমদানি করতে হয়। বঙ্গোপসাগরের কর্ণফুলী চ্যানেলের নাব্য ৮ মিটার থেকে ১৪ মিটারের নিচে হওয়ায় অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার কারণে ক্রুড অয়েলবাহী বড় ভ্যাসেল হ্যান্ডেল করতে পারে না চট্টগ্রাম বন্দর। যে কারণে ক্রুড অয়েলবাহী মাদার (বড়) ভ্যাসেলগুলো গভীর সমুদ্রে নোঙর করা হয়। মাদার ভ্যাসেল থেকে লাইটারেজ করে ক্রুড আনলোড করা হয়। লাইটারেজ ব্যবহার করে ক্রুড অয়েল আনলোড করা সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। এ অবস্থায় আমদানি করা জ্বালানি খালাসে ব্যয় ও সময় বাঁচানোর পাশাপাশি নিরাপত্তা বাড়াতে উদ্যোগ নেয় সরকার। তারই ফলস্বরূপ সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং (এসপিএম) সহ পাইপলাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়।

সূত্র জানায়, ২০১০ সালে ইস্টার্ন রিফাইনারির মাধ্যমে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং নির্মাণের পরিকল্পনা নেয় বিপিসি। কিন্তু নানা জটিলতার কারণে সময়ক্ষেপণে প্রকল্পটির ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যায়। কয়েকবার সংশোধিত হয়ে ২০১৬ সালের ১৮ আগস্ট ৫ হাজার ৪২৬ কোটি ২৬ লাখ ৮৩ হাজার টাকার প্রকল্পটির প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগ। প্রশাসনিক অনুমোদনের পর ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না পেট্রোলিয়াম পাইপলাইন ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের (সিপিপিইসিএল) সঙ্গে চুক্তি করে বিপিসি। প্রায় দেড় বছর পর ২০১৮ সালের ১৪ মে থেকে কাজ শুরু করে ইপিসি ঠিকাদার।

প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর ২০২০ সালের ৬ জুলাই প্রথম দফায় সংশোধিত হয়ে ব্যয় বাড়ে এক হাজার ১৪২ কোটি টাকা। পরে মাতারবাড়ী চ্যানেল ঝুঁকিমুক্ত করতে প্রায় দেড় কিলোমিটার পাইপলাইন সমুদ্রতটের ৩০ ফুট গভীরে বসানো হয়। এর ফলে দ্বিতীয় দফায় আরও ৩৬০ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ে। ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে তৃতীয় দফায় ১৯৬ কোটি টাকা ব্যয় বাড়িয়ে প্রকল্প ব্যয় দাঁড়ায় ৭ হাজার ১২৪ কোটি টাকায়। গত অর্থবছরের ৩০ জুন পর্যন্ত প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় নির্ধারণ করা হয়। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ডলার সংকটের প্রভাব পড়ে এসপিএম প্রকল্পে। এ অবস্থায় চতুর্থ দফায় প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। ৪র্থ দফার এ সংশোধনীতে প্রায় এক হাজার ২১৭ কোটি টাকার ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এর ফলে প্রকল্পটির ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৩৪১ কোটি টাকায়। যদিও কাজের শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে জি টু জি ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হয়েছে প্রকল্পটি। এতে বৈদেশিক সহায়তা দিয়েছে চায়না এক্সিম ব্যাংক।

Advertisement

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পে এসপিএম নির্মাণের পাশাপাশি মহেশখালীর মাতারবাড়ী উপকূলে ৫০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার তিনটি ক্রুড অয়েল স্টোরেজ ট্যাংক নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পে রয়েছে ৩০ হাজার মেট্রিক টন ধারণক্ষমতার তিনটি ডিজেল স্টোরেজ ট্যাংক। পাশাপাশি মহেশখালীতে পাম্প স্টেশন স্থাপন, স্কাডা সিস্টেম স্থাপন এবং ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পের মূল কাজের অংশ হিসেবে অফশোরে ১৪৬ কিলোমিটার ও অনশোরে ৭৪ কিলোমিটারসহ মোট ২২০ কিলোমিটার পাইপলাইন স্থাপন করা হয়। প্রকল্পে কুতুবদিয়া চ্যানেল এবং মাতারবাড়ী অ্যাপ্রোচ চ্যানেল অংশে ডিপ পোস্ট ট্রেন্সিং পদ্ধতিতে চারটি পাইপলাইন সমুদ্রতটের ৩০ ফুট গভীরে স্থাপন করা হয়েছে। তাছাড়া মহেশখালীর ধলঘাটায় একটি, চট্টগ্রামের গহিরায় একটি, ডাঙ্গারচরে একটি ব্লক বাল্ব স্টেশন এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে মাইক্রোওয়েভ রিলে টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রকল্প বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারির ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. লোকমান জাগো নিউজকে বলেন, চলতি মাসের শেষের দিকে এসপিএম কমিশনিং হবে। সফল কমিশনের পর এসপিএমের পুরোপুরি অপারেশন শুরু হলে ২৮ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে ডিজেল ও ক্রুড অয়েলবাহী জাহাজ খালাস করা সম্ভব হবে। ইস্টার্ন রিফাইনারির ৩০ লাখ মেট্রিক টন ক্রুড অয়েল পরিশোধনের আরেকটি প্রকল্প ইআরএল-২। শিগগির ইআএল-২ প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হতে পারে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে ইস্টার্ন রিফাইনারির ক্রুড পরিশোধন ক্ষমতা বেড়ে ৪৫ লাখ মেট্রিক টনে দাঁড়াবে। এতে এসপিএম প্রকল্পের ভালো সুফল পাওয়া যাবে পাশাপাশি এসপিএম দিয়ে তেল খালাসে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার মতো সাশ্রয় হবে বলে মতপ্রকাশ করেন তিনি।

এমডিআইএইচ/এসআইটি/জিকেএস