মতামত

সমস্যা সমাধানে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে

মজুরি বাড়ানোর দাবিতে গত ২৩ অক্টোবর থেকে শ্রমিকরা আন্দোলন করে যাচ্ছে। শ্রমিকদের দাবি, হয় মজুরি বাড়ান, না হয় জিনিসপত্রের দাম কমান। মালিকপক্ষ মজুরি বাড়াতে পারছেন না, আর সরকারও জিনিসপত্রের দাম কমাতে পারছে না। বাজারে আগে কখনো পেঁয়াজের দাম বাড়তো, কখনো তেলের, বা কাঁচামরিচের। একেক সময় একেকটি পণ্যের সিন্ডিকেট তাদের পণ্যের দাম বাড়াতো। এখন সব পণ্যেরই দাম চড়া।

Advertisement

বাজারে এখন পেয়াজের কেজি ১১০ টাকা। সয়াবিল তেলের লিটার ১৭০ টাকা। কেজি ১০০ টাকার নিচে বাজারে কোনো সবজি নাই বললেই চলে। বস্তা হিসেবে চাল কিনলেও সব চেয়ে নিম্ন মানের চালের দর পরে কেজি প্রতি ৫০-৬০ টাকা। কাজেই, বাজারের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই এটা স্পষ্ট। বাণিজ্য মন্ত্রীও তা স্বীকার করেছেন। যদিও তিনি দাবি করছেন যে তার এলাকার লোকজন ভালো আছেন। কারণ, তার এলাকার মেয়েরা তিন বেলা লিপস্টিক লাগাচ্ছেন, চার বেলা স্যান্ডেল বদল করছেন। কিন্তু, দিনে তিন বার লিপস্টিক লাগালে বা চার বার জুতা বদল করলেই যে দেশের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকে সেটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত নয়। এ বিষয়ে গবেষণা অবশ্য ভিন্ন কথা বলে।

কিন্তু গবেষণা যা-ই বলুন, দেশে সব পণ্যের দাম বেড়েছে কিন্তু শ্রমিকের (শুধু পোশাক শ্রমিক নয়) বেতন বাড়েনি- এটা স্পষ্ট। এভাবে পণ্যের দাম পাগলা ঘোড়ার মতো দৌড়ালে ও মজুরি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে এটা সবাই বোঝে। যাদের বোঝাটা জরুরি, শুধু তারাই বোঝেন না, বা বুঝতে চান না।

কোভিডকালে অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। অনেকে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে চলে গিয়েছিল। অথবা পরিবার গ্রামে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে ম্যাচে উঠেছে। শ্রমিকরা কোভিডাঘাত সামলে আবার নতুন করে শুরু করেছে। কিন্তু বর্তমান ত্রিমুখী চাপে আবার তারা হাপিয়ে উঠেছে। একদিকে পণ্যের দাম বাড়ছে, আরেকদিকে মজুরি বাড়ছে না। সেই সঙ্গে বাড়ছে ঘরভাড়া। কাজেই মানুষ টিকতে না পেরে গ্রামে চলে যাচ্ছে। অথবা টিকে থাকার জন্য জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আপোসরফা করছে। মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদের অবস্থা আরও খারাপ। চাকরিতে তাদের বেতন বাড়েনি। বাজারে আগুন। জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে আপোস করে কোনো মতে সামলে নিচ্ছে। মধ্যবিত্তদের পাতে গরুর মাংস গত হয়েছে আরও বহু আগেই। মাছ-ডিমও যায়-যায় অবস্থা। তার ওপর আসছে শীতকাল। মুরগি ডিম পারা কমিয়ে দিলে বাসনে ডিমও জুটবে না। এ অবস্থায় লিপস্টিক লাগিয়ে ক্ষুধা-দুঃখ-বেদনা ভুলে থাকাই শ্রেষ্ঠ বিকল্প।

Advertisement

শ্রমিকরা মজুরি বাড়ানোর দাবি করেছে অথবা জিনিসপত্রের দাম কমাতে বলছে যাতে তারা কোনো মতে খেয়েপরে বাঁচতে পারে। তার বিপরীতে জলকামান ও আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার কি অপরিহার্য ছিল? কয়েকজন শ্রমিক প্রাণ হারালো যাদের একজন নারী শ্রমিক। এই আন্দোলনের মধ্যেই গত মঙ্গলবার পোশাক খাতের জন্য সরকার গঠিত মজুরি বোর্ড ১২ হাজার ৫০০ টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে। ১ ডিসেম্বর থেকে এটি কার্যকর হবে। কিন্তু বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি, বাজারদর তথা জীবযাত্রার ব্যয়ের তুলনায় নতুন বেতন কাঠামো কতটা যৌক্তিক সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। পোশাক শ্রমিকরা একে প্রহসন বলছেন। তারা এ নতুন বেতনকাঠামো প্রত্যাখ্যান করে আন্দোলন অব্যাহত রেখেছেন। তাদের দাবি ন্যূনতম মজুরি হতে হবে ২৩-২৫ হাজার টাকা।

দেশের পোশাকশিল্পের বয়স প্রায় চার দশক। এবং এ চার দশক ধরেই এ খাতের শ্রমিকরা মজুরি বৈষম্যের শিকার। অন্যান্য সব দেশের চেয়েও আমাদের শ্রমিকরা কম মজুরি পান। মালিক পক্ষের দাবি, আমাদের শ্রমিকরা দক্ষ নয়। কিন্তু তাদের অদক্ষতার জন্য পোশাকের অর্ডার কম পেয়েছেন বা উৎপাদন মানসম্পন্ন না হওয়ায় যথা সময়ে অর্ডার সরবরাহ করা যায়নি এমনটি খুব একটা শোনা যায় না। কিন্তু তারপরও মজুরির প্রশ্ন উঠলেই সবসময় শ্রমিকদের অদক্ষতার অজুহাত দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, সস্তা শ্রমের বিনিময়ে বেশি লাভবান হওয়ার উত্তম নজির বাংলাাদেশের তৈরি পোশাকখাত।

 

দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ও রিজার্ভের বড় যোগানদাতা তৈরি পোশাকখাত। এ খাতের যেকোনো সমস্যা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে বা জলকামান দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এ জন্য নীতিনির্ধারকদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও বাস্তবসম্মত কর্মোদ্দ্যোগ জরুরি। এ ব্যাপারে মালিকপক্ষ, শ্রমিক সংগঠন, বিদেশি ক্রেতা, সরকারসহ সব অংশীজনের ইতিবাচক ভূমিকা কাম্য।

 

পোশাক শ্রমিকদের সর্বশেষ মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৮ সালে। পাঁচ বছর পরে সে মজুরির একটা বাস্তবসম্মত পরিবর্তন হবে সেটি খুবই স্বাভাবিক। সেই পরিবর্তনের আগে দেশের মূল্যস্ফীতি, বাজার দর, জীবনযাত্রার মান ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ-সব কিছুই বিবেচনা করা প্রয়োজন ছিল। সেসব বিবেচনা না করে শুধু একটি পক্ষের স্বার্থ বিবেচনা করে এক তরফা বেতন সংশোধন যৌক্তিক?

Advertisement

চীনের পর বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। চীনে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ৩০৩ ডলার। এছাড়া ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়ার ন্যূনতম মজুরি যথাক্রমে ১৭০ ডলার, ১৭১ ডলার, ২০০ ডলার ও ২৪৩ ডলার (সিপিডির)। অথচ আমাদের দেশে বর্তমান বর্ধিত বেতন অনুযায়ী ১১৩ ডলার। এটা কেমন কথা? দেশের পোশাকশ্রমিকরা উপরোক্ত সব দেশের চেয়েই কি খারাপ ও অদক্ষ? কিন্তু এতো অদক্ষ শ্রমিক দিয়েও কীভাবে চীনের পরেই বাংলাদেশ নিজের অবস্থান করে নিয়েছে?

আমরা শ্রমিকদের থেকে বেশি উৎপাদন চাইবো, কিন্তু তাদের জন্য নিম্নতম ভালো খাওয়া-পরার ব্যবস্থাও করবো না সেটি অযৌক্তিক। ব্যবসায়ীরা এক দিকে কম মজুরি দিচ্ছেন আরেক দিকে সরকারের কাছ থেকেও তারা বিভিন্ন সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও প্রণোদনা নিচ্ছেন। লাভের ওপর লাভ আর কি! অন্য শিল্পকারখানাকে যেখানে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত করপোরেট কর দিতে হয়, সেখানে পোশাক কারখানার জন্য এই করের হার ১০-১২ শতাংশ। এ ছাড়া নগদ সহায়তা, মূসক অব্যাহতি, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল (ইডিএফ) থেকে স্বল্প সুদে ঋণ নেওয়া ও শুল্কমুক্ত সুবিধায় কাঁচামাল আমদানির সুবিধা পান পোশাকশিল্পের মালিকেরা। এতো সুবিধা পাওয়ার পরও শ্রমিক মজুরির কথা উঠলেই নানা অজুহাত।

পোশাকশ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কতো হওয়া উচিত সেটা নিয়ে নানা মত আছে। তবে, ক্লিন ক্লথস ক্যাম্পেইন (সিসিসি) নামে একটি সংগঠনের মতে দারিদ্র্যসীমার ওপরে উঠতে শ্রমিকদের মাসিক ন্যূনতম মজুরি হওয়া প্রয়োজন ২৩ হাজার টাকা। তবে, বাজারদর, জীবনযাত্রার ব্যয় ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে একটি বাস্তবসম্মত মজুরি নির্ধারণ করা প্রয়োজন।

নতুন মজুরি এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। বাস্তবায়নের আগে এটি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। এদিকে শ্রমিকরাও তাদের ন্যায়সঙ্গত দাবি তুলতেই পারে। কিন্তু শান্তিপূর্ণ উপায়ের বদলে ভাঙচুর ও হঠকারিতা দিয়ে সে দাবি আদায় করা ন্যায়সঙ্গত নয়। কারখানা বন্ধ থাকলে কারোরই লাভ নেই- না মালিকের, না শ্রমিকের। কিন্তু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও দেশের অর্থনীতি। দেশের বৈদেশিক মুদ্রা ও রিজার্ভের বড় যোগানদাতা তৈরি পোশাকখাত। এ খাতের যেকোনো সমস্যা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। রাস্তায় আগুন জ্বালিয়ে বা জলকামান দিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা যাবে না। এ জন্য নীতিনির্ধারকদের উদার দৃষ্টিভঙ্গি ও বাস্তবসম্মত কর্মোদ্দ্যোগ জরুরি। এ ব্যাপারে মালিকপক্ষ, শ্রমিক সংগঠন, বিদেশি ক্রেতা, সরকারসহ সব অংশীজনের ইতিবাচক ভূমিকা কাম্য।

লেখক: আইনজীবী, প্রাবন্ধিক।

এইচআর/জিকেএস