মতামত

ট্র্যাজেডি, কমেডি, অ্যাকশন, থ্রিলার

গত ২৮ অক্টোবর বাংলাদেশের রাজনীতির এক টার্নিং পয়েন্ট। বিএনপি অনেকদিন ধরেই সরকারবিরোধী আন্দোলন করছিল। প্রথমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করলেও পরে তারা সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে নামে। গত জুলাই থেকে এক দফা আন্দোলন শুরু হলেও তা মোটামুটি শান্তিপূর্ণই ছিল। কিন্তু ২৮ অক্টোবর এসে পাল্টে যায় দৃশ্যপট। আন্দোলন আর শান্তিপূর্ণ থাকেনি। ২৮ অক্টোবর দুই দলের মহাসমাবেশকে ঘিরে উত্তেজনা ছিল।

Advertisement

আমার আশা ছিল, ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশও আগের মতো শান্তিপূর্ণভাবেই শেষ হবে। কিন্তু এখন দেখেশুনে মনে হচ্ছে, দুই দলই আসলে অশান্তি চাচ্ছিল। বিএনপি বুঝতে পেরেছিল, শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে যেহেতু দাবি আদায় হচ্ছে না, তাই সহিংসতা দিয়েই আন্দোলন বেগবান করবে। আবার সরকারি দলও চাচ্ছিল, বিএনপিকে যদি সহিংসতার ধারায় ফিরিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে মামলা-হামলায় তাদের আন্দোলন পর্যুদস্ত করা যাবে। তাদের নামের পাশে আবার আগুন সন্ত্রাসের বদনাম জুড়ে দিতে পারলে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে তাদের হেয় করা যাবে। কে কার ফাঁদে পা দিল জানি না। কিন্তু দেশ যাত্রা করেছে এক অনিশ্চয়তার দিকে। হরতাল-অবরোধেই কাটছে বাংলাদেশের সময়। এক পুলিশ সদস্যকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যার মাধ্যমে শুরু হয়েছিল বিএনপির আন্দোলনের নবযাত্রা। তারপর নিয়মিতই রাজপথে ট্র্যাজেডির সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ মারা যাচ্ছে, যানবাহন পুড়ছে।

২৮ অক্টোবর ট্র্যাজেডিতে দিন শুরু হলেও সন্ধ্যায় বিএনপির নয়াপল্টনের কার্যালয়ে মঞ্চস্থ হয় এক কমেডি। অবশ্য কমেডিটা শুরুতে বোঝা যায়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয়ে মিয়ান আরেফি নামে এক ব্যক্তি যখন বিএনপি কার্যালয়ে বসে সংবাদ সম্মেলনে সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। জো বাইডেনের উপদেষ্টা বাংলাদেশে চলে এলেন, কেউ জানলো না, এটাই প্রথম সন্দেহ সৃষ্টি করে। পরে থলের বেড়াল বেরিয়ে আসে।

জানা গেলো, মিয়ান আরেফি বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক। তবে মার্কিন প্রশাসনের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। গোমর ফাঁস হয়ে যাওয়ায় তিনি পালাতে চেয়েছিলেন। আগের দিন হেঁটে হেঁটে বিএনপি কার্যালয়ে গিয়ে সংবাদ সম্মেলন করলেও পরদিন জো বাইডেনের এই কথিত উপদেষ্টা বিমানবন্দরে গেছেন হুইল চেয়ারে। সেখান থেকেই গ্রেফতর করা হয়।

Advertisement

আগের দিন বিএনপি কার্যালয়ে ইংরেজিতে বক্তব্য রাখলেও পুলিশের কাছে এসে বাংলায় মাফ চাইতে থাকেন। তার দাবি, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী তাকে শিখিয়ে জো বাইডেনের উপদেষ্টা পরিচয়ে বিএনপি কার্যালয়ে নিয়ে গেছেন। সংবাদ সম্মেলনে মিয়ান আরেফির পাশে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের সাথে হাসান সারওয়ার্দীও ছিলেন। বিএনপি বাংলাদেশের একটি বড় দল। কিন্তু সেই দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মিয়ান আরেফির মতো একজন ভুয়া ব্যক্তি গিয়ে কীভাবে সংবাদ সম্মেলন করতে পারেন, বিএনপির সাথে কোনো আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক না থাকলেও সারওয়ার্দী কোন পরিচয়ে সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত থাকেন; এসবের কোনো ব্যাখ্যা নেই।

একটা রাজনৈতিক দল কীভাবে এতটা দেউলিয়া হতে পারে, সেটা আসলে বিস্ময়কর। চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী একসময় বর্তমান সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। কিন্তু সেনাপ্রধান হতে না পারার বেদনায় তিনি সরকারের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছেন। বর্তমান সরকারের পতন নিশ্চিত করতে তার চেষ্টার কমতি নেই। যে কেউ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে পারেন। কিন্তু তাই বলে একজন ভুয়া লোককে জো বাইডেনের উপদেষ্টা সাজিয়ে বিএনপি অফিসে নিয়ে যেতে হবে।

 

দুই রাজনৈতিক দলের কাছেই আমাদের অনুরোধ, প্লিজ আপনারা রাজপথ সহিংসতামুক্ত করুন। দিনের পর দিন অবরোধ চললে, মানুষের পক্ষে ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু রাস্তায় নামলেই যদি অগ্নিসন্ত্রাসের ঝুঁকি থাকে, তাহলে মানুষ কী করবে। প্লিজ আপনারা আলোচনার টেবিলে বসুন। কথা বলে সমস্যার সমাধান করুন। বাংলাদেশের অর্থনীতির, বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলনের চাপ নেওয়ার আর সামর্থ্য নেই।

 

মিয়া জাহিদুল ইসলাম ওরফে বেলাল থেকে মিয়ান আরেফি বনে যাওয়া এই ভুয়া লোক এখন দাবি করছেন, তাকে যা শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে, তিনি তাই বলেছেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, এখন ইশরাক, হাসান সারওয়ার্দী সবাই দাবি করছেন, তারা তাকে চেনেনই না। পরে বিএনপিও বলছে, মিয়ান আরেফিকে তারা চেনে না। নাই যদি চিনবেন, তবে তাকে বিএনপি অফিসে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বসানো হলো কেন? আমার কাছে এ কমেডির সবচেয়ে হাস্যকর অংশ মনে হয়েছে মিয়ান আরেফির সাথে বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভির কথোপকথন। সংবাদ সম্মেলন করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় মিয়ান আরেফির সাথে দেখা হয় রিজভীর। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে দুই বাঙালি হাস্যকর ইংরেজিতে কথা বলছিলেন।

Advertisement

দুপুরে যে আন্দোলন ছিল ট্র্যাজেডি, সন্ধ্যার মধ্যে বিএনপি তাকে কমেডি বানিয়ে ফেলে। এরপর আর আন্দোলন এগিয়ে নেওয়ার জন্য কাউকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গোপন জায়গা থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করে সাসপেন্স তৈরি করে বিএনপি। আর অনুমিতভাবেই অ্যাকশনে গেছে সরকার। রাজপথে পিটিয়ে পুলিশ হত্যা, প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, হাসপাতালে হামলা, অগ্নিসংযোগের পর সরকার যে বসে থাকবে না, এটা তো জানা কথা। শুরুতে যেমনটি বলেছি, সরকারও চাইছিল, বিএনপি সহিংসতার ধারায় ফিরে আসুক, যাতে তাদের ওপর মামলা-হামলার যুক্তি তৈরি হয়। একইসাথে আন্তর্জাতিক মহলকেও বোঝানো যাবে, দেখো বিএনপি কতটা খারাপ। বিএনপি সরকারকে সে যুক্তি তৈরি করে দিয়েছে।

এখন সরকার বিএনপির ওপর সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির সক্রিয় প্রায় সব নেতাই এখন কারাগারে। বিএনপির কয়েক হাজার নেতাকর্মী এখন কারাগারে। পালিয়ে বেরাচ্ছেন হাজার হাজার নেতাকর্মী। আর গোপন স্থান থেকে হরতাল বা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেই বসে থাকছেন বিএনপি নেতৃত্ব। অবরোধের আগের রাতে যানবাহনে আগুন দিয়ে ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে। গোপন স্থান থেকে কর্মসূচি ঘোষণা আর দুর্বত্তদের যানবাহনে আগুন থ্রিলারের উত্তেজনা এনেছে আন্দোলনে। তবে বিএনপির অবরোধে সাড়া দেয়নি জনগণ।

তবে বিএনপির এই লক্ষ্যহীন আন্দোলনে তাদের কোনো লাভ না হলেও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে জনগণকে। অবরোধ সফল না হলেও এর প্রভাব পড়ছে বাজারে। বাড়তে থাকা নিত্যপণ্যের দাম আরেক দফা বাড়ছে। ঝুঁকিতে থাকা অর্থনীতির সংকট আরও বাড়ছে। বিএনপি আন্দোলন করছে সরকার পতনের এক দফায়। শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে সরকারের পতন হয়নি। আগুন সন্ত্রাসেও সরকার পতন হবে, তেমন বাস্তবতা মাঠে নেই।

দুদিন পর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হলে বিএনপি কী করবে? সরকার পদত্যাগ না করলে বিএনপির পরবর্তী কর্মসূচি কী হবে? এসব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মতো কেউ নেই এখন। এসব গোপন স্থান থেকে কর্মসূচি দিয়ে আর অগ্নিসন্ত্রাস দিয়ে যে সরকারকে কাবু করা যাবে না, তা বিএনপিও জানে। আশা করি তারা ২০১৪ সালের আন্দোলনের অভিজ্ঞতা ভুলে যায়নি। টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটাতে হলে চাই প্রবল গণআন্দোলন। কিন্তু গত ১৫ বছরে বিএনপি তেমন পরিস্থিতি কখনোই সৃষ্টি করতে পারেনি। নাই যদি পারবেন, তবে টুটকা-ফাটকা আন্দোলন করে জনগণকে কষ্ট দিয়ে লাভ কী?

ইদানীং বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফরমে সিনেমা দেখার দারুণ সুবিধা হয়েছে। হলে মুক্তি পাওয়ার মাসখানেকের মধ্যেই কোনো না কোনো ওটিটিতে চলে আসে সিনেমা। এসব ওটিটিতে সিনেমার নানা ক্যাটাগরি আছে। দর্শক চাইলে তার পছন্দের ক্যাটাগরির সিনেমা দেখতে পারেন। জনপ্রিয় ক্যাটাগরির মথ্যে রয়েছে- ট্র্যাজেডি, কমেডি, অ্যাকশন, থ্রিলার। বিএনপির আন্দোলনের নামে এখন রাজপথে প্রদর্শিত হচ্ছে নানা ধরনের সিনেমা। যাদের জন্য রাজনীতি, সেই জনগণ এই সিনেমার নীরব, অসহায় দর্শকমাত্র। তাদের এখানে কোনো ভূমিকাই নেই।

দুই রাজনৈতিক দলের কাছেই আমাদের অনুরোধ, প্লিজ আপনারা রাজপথ সহিংসতামুক্ত করুন। দিনের পর দিন অবরোধ চললে, মানুষের পক্ষে ঘরে বসে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু রাস্তায় নামলেই যদি অগ্নিসন্ত্রাসের ঝুঁকি থাকে, তাহলে মানুষ কী করবে। প্লিজ আপনারা আলোচনার টেবিলে বসুন। কথা বলে সমস্যার সমাধান করুন। বাংলাদেশের অর্থনীতির, বাংলাদেশের মানুষের আন্দোলনের চাপ নেওয়ার আর সামর্থ্য নেই।

১২ নভেম্বর ২০২৩লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/ফারুক/জিকেএস