রাজনীতি

ঝটিকা মিছিলে ভর করে বিএনপির সরকার পতনের আন্দোলন!

# মাঠে নেই মনোনয়নপ্রত্যাশী ও তারেক রহমানের আস্থাভাজনরা# ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিলে চলছে বিএনপির সরকারের পতনের আন্দোলন

Advertisement

সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি আদায়ে চূড়ান্ত আন্দোলনে রয়েছে বিএনপি। দাবি আদায়ে আন্দোলন-সংগ্রামের সুতিকাগার খ্যাত ঢাকার রাজপথ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে চায় বিএনপি। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ করে। ২৯ অক্টোবর হরতালের পর এখন দেশব্যাপী চলছে থেমে থেমে অবরোধ কর্মসূচি। কিন্তু ঢাকায় ১০-১৫ জন নেতাকর্মী নিয়ে ঝটিকা মিছিল ছাড়া সশরীরে কোনো কর্মসূচিই পালন করতে দেখা যায়নি। এর মধ্যে আবার সিনিয়র নেতারাও অধিকাংশই অনুপস্থিত।

নেতাকর্মীদের প্রশ্ন— প্রায় পাঁচ শতাধিক নির্বাহী কমিটির সদস্য ও অঙ্গ সংগঠনের বাকি নেতারা কোথায়? অবশ্য মাঠে থাকা নেতারা বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের দাবি, চলমান পুলিশি তৎপরতার মধ্যে অনেক নেতাকে মাঠে দেখা না গেলেও নিজ নিজ অবস্থান থেকে দলের হয়ে কাজ করছেন তারা। সামনের দিনে কোনো এক সময় তাদের মাঠে দেখা যাবে।

‘মন থেকে দল করি। দল আমাকে ছাত্রদলের সভাপতি বানিয়েছে। দলের কারণেই আজকের খোকন হয়েছি। তাই নৈতিক দায়িত্ব থেকে কাজ করছি।’

Advertisement

দেখা যায়, গত ২৯ অক্টোবর হরতাল থেকে শুরু করে তৃতীয় দফার অবরোধ পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই সকালে রাজধানীর কোনো না কোনো প্রান্তে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী দলের স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলামসহ কয়েকজন অনুসারী নিয়ে ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। আলাদাভাবে একই পথ অনুসরণ করেছেন দলের সহ-স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল, সহ-যুববিষয়ক সম্পাদক মীর নেওয়াজ আলী, নির্বাহী কমিটির সদস্য ইকবাল হোসেন শ্যামল, ফজলুর রহমান খোকন ও কাজী রওনকুল ইসলাম শ্রাবণ। রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন তারা। ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক অধ্যাপক ডা. ফরহাদ হালিম ডোনারকেও ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিলের প্রতিযোগিতায় দেখা গেছে।

আরও পড়ুন>> ২৮ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ৬৪ বাসে আগুন-ভাঙচুর

এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র সহ-সভাপতি ইয়াছিন আলী, সহ-সভাপতি কামরুজ্জামান বিপ্লব, সহ-সভাপতি সরদার মো. নুরুজ্জামান, যুগ্ম সম্পাদক জেড আই কামাল, যুগ্ম সম্পাদক আলাউদ্দিন জুয়েল, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নাজমুল হাসান বিভিন্ন জায়গায় ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিচ্ছেন।

‘বর্তমান সরকার গণতন্ত্রকামী জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে পাড়া-মহল্লায় শান্তি সমাবেশের নামে অগ্নিসন্ত্রাস করছে, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে জাতির কাছে পরিষ্কার।’

Advertisement

যুবদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম মিল্টন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাইনবোর্ড এলাকায় অ্যাম্বুলেন্সযোগে গিয়ে একদিন ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিয়েছেন। সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নয়নও একদিন তার অনুসারীদের নিয়ে রাজপথে বের হয়েছিলেন।

মৎস্যজীবী দলের সদস্য সচিব আব্দুর রহিম, কৃষক দলের সভাপতি হাসান জাফির তুহিন ও সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলাম বাবুল তাদের অনুসারী নিয়ে সম্মিলিতভাবে ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিল করছেন।

এদিকে ছাত্রদল নেতাদের মধ্যে কেন্দ্রীয় সংসদের সহ-সভাপতি আকতারুজ্জামান আক্তার, সহ-সভাপতি নাছির উদ্দিন নাছির, সহ-সভাপতি শামিমুর রহমান শামিম, মিলাদ উদ্দিন ভূঁইয়া, মাহমুদ সরদার, তানজিল হাসান, ফয়সাল আলম, সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম রাকিব, যুগ্ম সম্পাদক এমএম মুসা, যুগ্ম সম্পাদক রিয়াদ রহমান, যুগ্ম সম্পাদক মনজুর আলম রিয়াদ, যুগ্ম সম্পাদক রেহানা আক্তার শিরিন, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবু জাফর, সহ-সাধারণ সম্পাদক সানজিদা ইয়াসমিন তুলি, ঢাকা মহানগর পূর্ব ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক নাঈম আবেদীন, রুহুল আমিন, হান্নান মজুমদার মাসুদ, বায়েজিদ হোসাইন, আক্তার।

‘১৫ বছর ধরে সরকারের মামলা-হামলার মধ্যে আছি। তাই আমাদের অবস্থান থেকে আন্দোলনে সর্বোচ্চ ভূমিকা থাকবে এবং আছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার শপথ নিয়েছি। সেখানে কিছু ঝুঁকি তো থাকবেই।’

ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুগ্ম আহ্বায়ক রিয়াজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সুজন মোল্লা, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মুসাব্বির মিল্লাত পাটোয়ারী, সুমন সরদার, জাফর আহমেদ, মোস্তাফিজুর রহমান রুমি, প্রচার সম্পাদক শাখাওয়াতুল ইসলাম পরাগসহ বিভিন্ন ইউনিটের নেতারা নিয়মিত ঝটিকা বিক্ষোভ মিছিল করেছেন।

আরও পড়ুন>> একদিনে সারওয়ার্দী ও বিএনপির ৪ নেতা কারাগারে

দলীয় সূত্রে জানা যায়, সারাদেশে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে অন্তত পাঁচ শতাধিক নেতা রয়েছেন, এর মধ্যে রাজধানীতে মাত্র হাফ ডজন নেতার উপস্থিতিতে মাঠের নেতাকর্মীদের মধ্যে নানা সংশয় তৈরি হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির নির্বাহী কমিটির একজন সদস্য জাগো নিউজকে বলেন, নিয়ন্ত্রিত কাউন্সিলের মাধ্যমে চাঁদপুর, দিনাজপুর, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ জেলা, গাজীপুর মহানগর কমিটি গঠন করায় আন্দোলনে নেতাকর্মীদের দেখা মিলছে না। স্বজনপ্রীতিসহ আর্থিক নানা অনৈতিক সুবিধার মাধ্যমে এসব কমিটি গঠনের অভিযোগ ছিল সব সময়।

বিএনপি সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে ঝটিকা মিছিল

তিনি বলেন, ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য আসনপ্রতি অন্তত তিনজন বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন। সেই হিসেবে সারাদেশে অন্তত ৯০০ মনোনয়নপ্রত্যাশী রয়েছেন। কিন্তু চলমান আন্দোলনে তাদের তেমন দেখা যাচ্ছে না। অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে তাদের খুঁজতে হচ্ছে। গত চার বছরে নির্বাহী কমিটিতে যাদের সাংগঠনিক সম্পাদকসহ সাংগঠনিক পদে পদায়ন করা হয়েছে এবং গত ২৯ জুলাইয়ের পর দল যাদের প্রমোশন দিয়েছে তাদেরও রাজপথে দেখা যাচ্ছে না।

আরও পড়ুন>> দায়িত্বশীল নেতাদের ভূমিকা নিয়ে তৃণমূলে অসন্তোষ

ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আস্থাভাজনরা মাঠে নেই জানিয়ে তিনি বলেন, সংরক্ষিত আসনে যারা বিএনপির হয়ে এমপি হয়েছেন তারাও নিষ্ক্রিয়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ আস্থাভাজন হিসেবে দলের ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আহমেদ আজম খান, অধ্যাপক ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল, তথ্য গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক সাইদ সোহরাব, পল্লী উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক ফরহাদ হোসেন আজাদ, কোষাধ্যক্ষ রশিদুজ্জামান মিল্লাত নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর হেলালদেরও খোঁজ নেই।

‘সভা-সমাবেশ, ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচির মাধ্যমে দাবি আদায় করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা আমাদের মহাসমাবেশে পূর্বপরিকল্পিত হামলা করে মামলা দিয়ে সিনিয়র নেতাসহ সারাদেশে নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করছে। এ কারণে অনেকে আত্মগোপনে রয়েছে।’

চলমান আন্দোলনে থাকা ছাত্রদলের একজন কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, রাজধানীর প্রত্যেকটা সভা-সমাবেশে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ বিএনপির আহ্বায়ক আব্দুস সালাম। নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করতে তিনি সরকারবিরোধী স্লোগান দিতেন। ‘ভুয়া, ভুয়া’ বলে ধোয়া তুলতেন। তাকেও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মাঠের আন্দোলনকারীদের কাছেই তিনি এখন ‘ভুয়া’ হয়ে গেছেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এসব নেতা তো নামেননি তাদের অনুসারী এবং অধীনস্থ ইউনিটের নেতাকর্মীরাও মাঠে নেই।

তবে, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্যদের মধ্যে যে কয়জন মাঠে রয়েছেন তার মধ্যে একজন নির্বাহী কমিটির সদস্য ফজলুর রহমান খোকন। কীভাবে মাঠে নামছেন জানতে চাইলে জাগো নিউজকে বলেন, মন থেকে দল করি। দল আমাকে ছাত্রদলের সভাপতি বানিয়েছে। দলের কারণেই আজকের খোকন হয়েছি। তাই নৈতিক দায়িত্ব থেকে কাজ করছি।

আরও পড়ুন>> নির্বাচন নিয়ে চীনা রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যে যা বললো বিএনপি

আপনারা মাঠে নামতে পারলে অন্যরা কেন পারছে না এমন প্রশ্নের জবাবে খোকন বলেন, দলের সবাইকে প্রকাশ্যে দেখা না গেলেও আমার মনে হয় সবাই কোনো না কোনো দায়িত্ব পালন করছেন।

একটা সময় সবাইকে মাঠে দেখা যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

নির্বাহী কমিটির সদস্য ইকবাল হোসেন শ্যামল বলেন, বর্তমান আওয়ামী সরকার গণতন্ত্রকামী জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে পাড়া-মহল্লায় শান্তি সমাবেশের আদলে অগ্নিসন্ত্রাস করছে, যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে জাতির কাছে পরিষ্কার। আওয়ামী প্রশাসন ও আওয়ামী সন্ত্রাসীদের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই দেশনায়ক তারেক রহমানের নেতৃত্বে জনগণ গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে রাজপথে নেমে এসেছে।

‘রাজপথে ফয়সালার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের বিদায় হবে, ইনশাআল্লাহ। সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনীর সামনে নিরস্ত্র জনগণের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কিছুটা কঠিন। তবে সবাই রাজপথে নামছে না বিষয়টা সঠিক নয়। সবাই যার যার অবস্থান থেকে চেষ্টা করে যাচ্ছে।’

সহ-স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল বলেন, ১৫ বছর ধরে সরকারের মামলা-হামলার মধ্যে আছি। সুতরাং আমরা আমাদের অবস্থান থেকে এ আন্দোলনে সর্বোচ্চ ভূমিকা থাকবে এবং আছে। আমি নিজেও জেল খেটেছি। আমার নামে দেড়শ বেশি মামলা রয়েছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনার শপথ নিয়েছি। সেখানে কিছু ঝুঁকি তো থাকবেই তার মাঝেই গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার ফিরিয়ে আনতে হবে।

আরও পড়ুন>> সরকারের ‘অলটারনেট গণতন্ত্রের’ ফানুস চুপসে গেছে: মঈন খান

দলের অন্য নেতারা চলমান আন্দোলনে মাঠে নামছেন না কেন এমন প্রশ্নের জবাবে জুয়েল বলেন, দলের সবাই যার যার অবস্থান থেকে কাজ করছেন।

বিএনপির স্বাস্থ্য-বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা সভা-সমাবেশ, ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচির মাধ্যমে দাবি আদায় করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা শান্তিপূর্ণ মহাসমাবেশে পূর্বপরিকল্পিত হামলা করে মামলা দিয়ে একের পর এক সিনিয়র নেতাসহ সারাদেশে তৃণমূল নেতাকর্মীদের পর্যন্ত গ্রেফতার করছে। এ কারণে নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে গেছেন। এরই মধ্যে সুযোগ বুঝে তৃণমূল নেতাকর্মীরা অবরোধের সমর্থনে ঝটিকা মিছিল করছেন।

বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, দল যেভাবে কর্মসূচি দেবে সেভাবে পালন করবে নেতাকর্মীরা। আমাদের ঠিকানা হয় কারাগার না হয় রাজপথ। আমাদের অন্য কোনো পথ নেই।

তিনি বলেন, কারাগারে নিয়ে যেতে পারে আমাদের নানাভাবে অত্যাচার-নির্যাতন করতে পারে… আমরা সবকিছু বরণ করে এ অভিযাত্রা অব্যাহত রাখবো। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন চলবে।

কেএইচ/এমএএইচ/এএসএম