কাঁসা শিল্পের জন্য বিশ্বব্যাপী সুনাম রয়েছে জামালপুরের ইসলামপুর উপজেলার। এক সময় কাঁসা তৈরির টুং টাং শব্দ আর ক্রেতার পদভারে মুখরিত থাকতো কাঁসারিপাড়া। সারাদেশ থেকে ব্যবসায়ীরা কাঁসাসামগ্রী কিনতে ভিড় জমাতেন এখানে। কারখানাগুলোতে কারিগররা দিনরাত কাজ করেও সরবরাহে হিমশিম খেতেন। তবে বর্তমানে ভাটা পড়েছে এই শিল্পে। জৌলুশ হারাতে বসেছে এই শিল্প। তবে এই শিল্পকে পূনরুজ্জীবিত করতে ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (ইএসডিও) নামে এক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কাজ করে চলেছেন।
Advertisement
উপজেলার কাঁসারিপাড়ার কারিগরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জেলার অন্যতম উপজেলা হচ্ছে ইসলামপুর। ব্রিটিশ আমল থেকেই এই উপজেলার কাঁসার কদর বিশ্বখ্যাত। তৎকালীন বৃটিশ সরকার ১৯৪২ সালে লন্ডনের বার্মিংহাম শহরে সারা বিশ্বের হস্তশিল্প প্রদর্শনীর আয়োজন করেন। সেই প্রদর্শনীতে জেলার ইসলামপুরের প্রয়াত কাঁসা শিল্পী জগৎচন্দ্র কর্মকার তার কারুকার্যপূর্ণ কাঁসার শিল্পটি প্রদর্শন করেন। ওই প্রদর্শনীতে বিশ্ববিখ্যাত শিল্প হিসেবে স্বর্ণপদক লাভ করেন তিনি। তারপর থেকে সারা বিশ্বে কাঁসা শিল্পের পরিচিতি লাভ করে। বেড়ে যায় কাঁসাশিল্পের চাহিদা।
চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় কাঁসা দিয়ে বিভিন্ন নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদি তৈরি শুরু হয়। এর মধ্যে ঘটি-বাটি, প্লেট, জগ, গ্লাস, বদনা, হুক্কা, খেলনা সামগ্রী এবং পূজা পার্বণে ব্যবহৃত জিনিসপত্র অন্যতম। এসব পণ্যের নির্মাণশৈলী ছিল খুবই চমৎকার। মানুষ এগুলোকে তৈজসপত্র হিসেবে পারিবারিক ও ধর্মীয় কাজে ব্যবহার করতেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এ শিল্পের সঙ্গে বেশি জড়িত ছিলেন। তবে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই দেশ ত্যাগ করে ভারতে চলে যান। অনেকে আবার ফিরে এসে পৈত্রিক পেশা বাদ দিয়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েন।
এছাড়াও আধুনিক যুগে নিত্য ব্যবহার্য দ্রব্যাদির ধরন বদলে যাওয়ায় বর্তমানে এ শিল্পে ধস নেমেছে। তবুও পৈত্রিক পেশাকে ধরে রাখার জন্য উপজেলার অনেকগুলো পরিবার এখনও এই কাজ করছেন। কাঁসা শিল্পের সঙ্গে জড়িত সকলেই গরিব। তাদেরকে পৃষ্ঠপোষকতা দিলে এই উপজেলা আবারও তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে। শিল্পীরা তাদের বাপ-দাদার পেশা দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হবেন।
Advertisement
কাঁসাশিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কারিগর প্রবীর কর্মকারের বাবা-দাদা ও তাদের পূর্বপুরুষরা। এখনও তিনিসহ অনেকে এই পেশাকে কোনোরকমে ধরে রেখেছেন। তবে এই শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে।
দুঃখ করে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, দিনদিন এই শিল্পের জৌলুশ হারিয়ে যাচ্ছে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা অধিকাংশই নিম্ন আয়ের মানুষ। এদের ব্যবসা করার মতো অর্থকড়ি নেই। পর্যাপ্ত মূলধন না থাকার কারণে সফলভাবে এই ব্যবসা করতে পারছেন না তারা। এই পেশাকে ধরে রাখতে কারিগরদের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। কারিগরদের জন্য কোনো কিছু করতে না পারলে আগামী ১০ বছরের মধ্যে এই শিল্প ইসলামপুর থেকে বিলীন হয়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, বিশেষ করে করোনাকালীন এই শিল্প এমনভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে যে তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারছেন না। এর মাঝে অনেক শিল্পকে প্রণোদনা দেওয়া হলেও তাদের এই শিল্পকে কোনো ধরনের প্রণোদনাই দেওয়া হয়নি। তবে এই শিল্পের উন্নয়নের জন্য একটি এনজিও কিছু ভারী যন্ত্রপাতি আনলেও সেটি আলোর মুখ দেখেনি আদৌ। ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে এই প্রকল্প দাঁড় করালেও এখনও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি।
তিনি দুঃখ করে বলেন, এই শিল্পকে ধরে রাখতে তার পূর্বপুরুষরা তাদের জীবন-যৌবন মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছেন। আর আমরা তাদের নামটুকুও ধরে রাখতে পারছি না।
Advertisement
ইকো-সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ইএসডিও) প্রকল্প ম্যানেজার মো. কামরুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, কাঁসা শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত ও উন্নয়ন করার জন্য ভ্যালু চেইন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে প্রকল্পের আওতাভুক্ত ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন ও আকর্ষণীয় ডিজাইন, নতুন নতুন তৈজষপত্র ও পণ্য সামগ্রী প্রস্তুত, গৃহস্থালি পণ্যের পাশাপাশি বিভিন্ন শো-পিছ, গিফট আইটেম এবং প্রসাধনী উপকরণ প্রস্তুত বিষয়ক কারিগরি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণের ব্যবস্থা করা, আধুনিক যন্ত্র ও মেশিনারিজ সম্বলিত একটি কমন সার্ভিস সেন্টার চালু করা, উদ্যোক্তাদের ব্যবসা পরিচালনা ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, পণ্য প্রচার ও বিক্রয়জাতকরণের লক্ষ্যে মার্কেটিংয়ের ব্যবস্থা করা এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য। বিদ্যমান কাঁসা শিল্পের কলাকৌশল ও উদ্যোক্তাদের অনুকূলে উপরোক্ত ভ্যালু চেইন কর্মকাণ্ড যুক্ত করা গেলে সম্ভাবনার নতুন দিগন্তের দ্বার উন্মোচিত হবে।
জামালপুর সরকারি আশেক মাহমুদ কলেজের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আব্দুল হাই আল হাদী জাগো নিউজকে বলেন, কাঁসা শিল্প যে শুধু ইসলামপুর উপজেলায় বিখ্যাত ছিল তা নয়, এই শিল্প ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে ব্রিটেনের রানির রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল। এটার বাহ্যিক সৌন্দর্য ও মান অন্য অঞ্চলের কাঁসার চেয়ে একটু আলাদা। এটাকে ঘঁষে-মেজে রাখলে এর উজ্জ্বলতা দিনদিন বৃদ্ধি পায়। স্বর্ণ যেমন দীর্ঘদিন তার উজ্জ্বলতা ধরে রাখতে পারে তেমনি এই কাঁসাও তার উজ্জ্বলতা দীর্ঘদিন ধরে রাখতে পারে। কিন্তু সারাবিশ্বে শিল্প বিপ্লবের ফলে হস্তচালিত শিল্প বা ক্ষুদ্র কুঠির শিল্প এই জাতীয় শিল্পগুলো বৃহৎ আকারের শিল্পের সঙ্গে পেরে উঠতে পারছে না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় সকল শিল্পের পরিবর্তন এসেছে। অর্থাৎ আমরা যান্ত্রিক যুগে চলে এসেছি। তাই দিনদিন হারিয়ে যেতে বসেছে এই শিল্প। তবে উপজেলার কিছু কিছু পরিবার এখনও তাদের বাবা-দাদার পেশাকে টিকিয়ে রাখতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে সরকারিভাবে পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই শিল্প আবারও তার জৌলুশ ফিরে পেতে পারে।
জামালপুর জেলা প্রশাসক মো. শফিউর রহমান মুঠোফোনে জাগো নিউজকে বলেন, এটি একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প। কাঁসার তৈরি দ্রব্যাদির চাহিদা কম থাকায় ও খরচ বেশি হওয়ায় এ পেশা থেকে অনেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে এখনও বসা হয়নি, এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে বসে আলাপ আলোচনা করে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।
এফএ/এএসএম