অধ্যাপক ড. আব্দুল খালেক। দুই মেয়াদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব সামলেছেন। বাংলা বিভাগে অধ্যাপনা করলেও শিক্ষকজীবনের পুরোটাজুড়ে ছিলেন রাজনীতির সংস্পর্শে। ভাষা আন্দোলন, শিক্ষার্থীদের জন্য ড. শামসুজ্জোহার প্রাণোৎসর্গ, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ও মহান মুক্তিযুদ্ধের মতো অর্জনগুলো দেখেছেন খুব কাছ থেকে। অংশও নিয়েছেন সক্রিয়ভাবে।
Advertisement
শিক্ষাবিদ হিসেবে সুপরিচিতি হলেও আওয়ামী ঘরানার রাজনীতিতে সক্রিয় তিনি। বর্তমানে তিনি আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের অন্যতম সদস্য। রয়েছেন দলটির শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক উপ-কমিটির চেয়ারম্যান পদেও। ইতিহাসের শিক্ষা ও মুক্তিযুদ্ধকে শিকড় ধরে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট ও আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক আল-আমিন হাসান আদিব। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।
জাগো নিউজ: সরকার হটানোর আন্দোলনে বিএনপিসহ বিরোধীপক্ষ। টিকে থাকতে চাইছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন আসন্ন। দূরদৃষ্টিতে আপনি কী দেখছেন?
অধ্যাপক আব্দুল খালেক: হ্যাঁ, স্ট্রাগল ফর এক্সিজটেন্স (টিকে থাকার লড়াই) চলছে। দুটো বড় রাজনৈতিক দলেরই অস্তিত্বের প্রশ্ন। বিএনপির জন্য পথটা বেশিই কঠিন। তারা মাঠে সেভাবে টিকতে পারছে না। তবুও ক্ষমতাসীনদের জন্য লড়াইয়ের অঙ্কটা জটিল। এখানে কে হারবে, কে জিতবে সেটা তো সময় বলবে। সবাই সেদিকে তাকিয়ে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও তো তাকিয়ে রয়েছেন। আগাম কিছু বলছেন না। আমি শুধু বলবো— কিছু ক্ষয়ক্ষতি হবে। দ্রুত তা কাটিয়েও উঠবে।
Advertisement
আরও পড়ুন>> রাজনীতির সমাধান রাজপথে হলে সংঘাত অনিবার্য
জাগো নিউজ: বিএনপির জনসমর্থন বেশ। তারা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতে গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে চেয়েছিল। বিদেশিদের চাপ সত্ত্বেও সরকার তো ছাড়ই দিচ্ছে না। গণঅভ্যুত্থানের ভয় থেকেই কি এটা…?
অধ্যাপক আব্দুল খালেক: ভালো প্রশ্ন। তবে এখানে ইতিহাসের শিক্ষা বা পাঠটা গুরুত্বপূর্ণ। দেশে বারবার যা ঘটেছে, সেটা গণঅভ্যুত্থান বনাম সামরিক অভ্যুত্থান। বিএনপি বলছে, তারা গণঅভ্যুত্থানের চেষ্টা করছে। অথচ ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউই গণঅভ্যুত্থান করতে পারেনি। বিএনপি বলেন, জামায়াত বলেন, গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে পেরেছে কেবল আওয়ামী লীগই। এবারও তারা (বিএনপি) পারবে না, হেরে যাবে।
বিএনপি সঠিক নেতৃত্ব-দিকনির্দেশনা ছাড়া মাঠে নেমে হুটহাট যে এনার্জি লস (শক্তি খোয়ানো) করলো, সেই শক্তি এখানে না খুইয়ে নির্বাচনমুখী চিন্তা করতে পারতো। তারা নির্বাচনের জন্য কোনো শক্তি আর রাখেনি।
Advertisement
জাগো নিউজ: নব্বইয়ের এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তো ছিল বিএনপি। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে তাদের ভূমিকা ছিল…
অধ্যাপক আব্দুল খালেক: দেখুন— ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান হয়েছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা স্যারকে মেরে ফেললো পাকিস্তানিরা। এর মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিল। সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তারপর সত্তর এলো, একাত্তর এলো। মহান মুক্তিযুদ্ধ হলো। সবকিছুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ।
১৯৭৫ সালে সামরিক ব্যক্তিরা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ফেললো। সেটা গণঅভ্যুত্থান নয় নিশ্চয়ই। বঙ্গবন্ধুকে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের যে ঘটনা, সেটা সামরিক বাহিনীর কিছু বিপৎগামী সদস্য করলো। গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে তখন কেউ ক্ষমতায় আসতে পারেনি।
তারপর যারা ক্ষমতায় এলো-গেলো, পেছনে থেকে কল-কাঠি নাড়লো সবাই সামরিক ব্যক্তি। জিয়াউর রহমান সামরিক শাসক। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সাহেবও সামরিক ব্যক্তি। তারা সামরিক শাসনই চালিয়ে গেলেন।
আরও পড়ুন>> রাজনৈতিক সংকট দারিদ্র্য-বৈষম্য আরও বাড়াবে
সামরিক শাসককে সরাতে আবারও যে অভ্যুত্থান হলো, সেটাও ঘটলো আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই। ২১ বছর ধরে সংগ্রাম করে তারা আবার অভ্যুত্থান ঘটালো। সেটা ৯০-এর গণঅভ্যুত্থান। বিএনপি-জামায়াত ছিল বটে, তবে সেখানেও আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব।
আমি ইতিহাসটুকু বললাম। ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে কথাগুলো বললাম। এটা আমার নিজের কথা তো নয়।
জাগো নিউজ: তাহলে কি আপনি ২০১৪ ও ২০১৮-এর মতো এবারও বিএনপির স্পষ্ট পরাজয় দেখছেন?
অধ্যাপক আব্দুল খালেক: যেটা বলছিলাম, আওয়ামী লীগকে হটানোর জন্য সামরিক অভ্যুত্থান ছাড়া কেউ গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে পারবে না। কেন আমি এ কথাটা বলছি? এটা বলছি এ কারণে যে, মুক্তিযুদ্ধকে ভিত্তি করে যে দলের শিকড় রয়েছে, সেই দলের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান সম্ভব নয়। আন্দোলন সফল করতে হলে কখন কী করতে হবে, সেটার একটা হিসাব কষতে হয়। একটা অঙ্কের ব্যাপার আছে, সেখানে বিএনপি পুরোপুরি ব্যর্থ। যত যা এরা (বিএনপি-জামায়াত) বলুক, দেখবেন কয়েকদিনের মধ্যেই তারা চূড়ান্তভাবে হেরে যাবে।
জাগো নিউজ: বর্তমান উত্তপ্ত রাজনীতির মাঠে বিএনপির বড় ঘাটতি কোথায় দেখছেন? আওয়ামী লীগই বা এগিয়ে কেন?
অধ্যাপক আব্দুল খালেক: রাজনীতিতে দূর থেকে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে হয়। কাছ থেকে দেখলে তো হবে না। পথ হারানো বিএনপির উচিত ছিল আরও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবকিছু দেখা। তারা এখন বর্তমানকে দেখছে। এই বুঝি সামনে ক্ষমতার চেয়ারটা! এটা তো পরিস্থিতি অনুযায়ী মানানসই নয়। ভবিষ্যৎ তারা দেখছেনই না। তাদের মধ্যে চরম দূরদর্শিতার অভাব।
রাজনীতিতে দূর থেকে সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখতে হয়। কাছ থেকে দেখলে তো হবে না। পথ হারানো বিএনপির উচিত ছিল আরও তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সবকিছু দেখা। তারা এখন বর্তমানকে দেখছে। এই বুঝি সামনে ক্ষমতার চেয়ারটা! এটা তো পরিস্থিতি অনুযায়ী মানানসই নয়। ভবিষ্যৎ তারা দেখছেনই না। তাদের মধ্যে চরম দূরদর্শিতার অভাব। আরও পড়ুন>> ‘একতরফা নির্বাচন হলে সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে’
তাদের এ সমস্যার অনেক কারণও আছে। তারেক রহমান লন্ডনে, খালেদা জিয়া অসুস্থ হয়ে পড়ে আছেন। তাদের নেতৃত্বটা কোথায়? নেতৃত্ববিহীন দল হয়ে পড়েছেন তারা। তাদের একটা ভালো সমর্থন ছিল। সেটা অ্যান্টি-আওয়ামী লীগ সেন্টিমেন্টে। সেটা তারা কাজে লাগাতে চান বটে, কিন্তু সেই প্রজ্ঞাটা তাদের নেই। জাগো নিউজ: আপনি বলছিলেন বিএনপির জনসমর্থন আছে। কর্মীরাও মাঠে নামছে। কর্মসূচিতেও আছে দলটি। বিদেশিদের চাপ; সবমিলিয়ে শেষ পর্যন্ত ভিন্ন কিছু কী ঘটে যেতে পারে?
অধ্যাপক আব্দুল খালেক: আসলে দল তো দেশে দুটো। আওয়ামী লীগ এবং অ্যান্টি আওয়ামী লীগ। যে কোনো কারণেই হোক রাজনীতিতে বিএনপি-আওয়ামী লীগ সেন্টিমেন্ট আছে। জনসমর্থনও থাকবে এটা স্বাভাবিক। বিএনপি সঠিক নেতৃত্ব-দিকনির্দেশনা ছাড়া মাঠে নেমে হুটহাট যে এনার্জি লস (শক্তি খোয়ানো) করলো, সেই শক্তি এখানে না খুইয়ে নির্বাচনমুখী চিন্তা করতে পারতো। তারা নির্বাচনের জন্য কোনো শক্তি আর রাখেনি। যদি ধরেও নিই কোনোভাবে বিএনপির পছন্দসই সরকার-পদ্ধতি (তত্ত্বাবধায়ক) চলেও আসে, তবুও তারা আর জিততে পারবে না। বিএনপি অপরিকল্পিতভাবে মাঠে নেমে হইচই করে শক্তি খুইয়ে ফেলেছে। নির্বাচন হলেও কেন্দ্র পাহারা দেওয়ার কেউ থাকবে না। তারা সব তো এখন আসামি। ভালো জনসমর্থন থাকা সত্ত্বেও নিজেরা নিজেদের সর্বনাশ করছে।
এএএইচ/এএসএ/এমএস