জয়পুরহাটের বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়েছে আলু চাষ। মাঠে মাঠে আলু রোপণে ব্যস্ত কৃষকেরা। তবে এই আলুর চাষ করতে গিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। সার, কীটনাশক নিয়ে কোনো সমস্যা না থাকলেও আলুর বীজ নিয়ে তৈরি হয়েছে সিন্ডিকেট। এ কারণে সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বীজ আলু কিনতে হচ্ছে কৃষকদের। কৃষকদের অভিযোগ, কিছু অতি লোভী ব্যবসায়ীর কারসাজিতে চড়া দামে কিনতে হচ্ছে বীজ আলু।
Advertisement
অন্যদিকে জেলার কালাই উপজেলায় বীজ আলু ব্যবসায়ীর একটি সিন্ডিকেট গভীর রাতে কয়েকটি হিমাগারে সংরক্ষণ করা কম দামের লোকাল আলু বস্তাবন্দি করে। এরপর সেগুলোর ওপর নামসর্বস্ব বিভিন্ন সংস্থার লোগো ব্যবহার করে বীজ হিসেবে বাজারে ছাড়ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। আবার বস্তার ওপর সাঁটানো লোগোতে দেওয়া ঠিকানার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। বীজ আলুর বস্তায় সাঁটানো ওইসব সংস্থাকে জয়পুরহাট জেলা বীজ প্রত্যয়ন বিভাগ থেকে প্রত্যয়নও দেওয়া হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। এ পরিস্থিতিতে ওইসব বীজ আলু জমিতে রোপণ করলে কৃষকেরা লোকসানের মুখে পড়বেন বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে সচেতন মহল।
কৃষকদের দাবি, অবিলম্বে জেলার অসাধু বীজ আলুর ব্যবসায়ী ও ডিলারদের গোডাউন তল্লাশি করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বীজের মান যাচাই-বাছাইসহ বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে।
জানা গেছে, আনুপাতিক হারে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম আলু উৎপাদনকারী জেলা জয়পুরহাট। একটু লাভের আশায় এ জেলায় প্রতি বছর ব্যাপক আলুর চাষ করে থাকেন কৃষকেরা। গত বছর আলুর চাষ করে দামও পেয়েছিলেন বেশ ভালো। বর্তমানে বাজারে আলুর দাম ভালো থাকায় আলু চাষে ঝুঁকেছেন তারা। এসব এলাকায় স্টিক, কারেজ, গ্রানুলা, কার্ডিনাল ও পাকরিসহ বিভিন্ন জাতের আলু চাষ হচ্ছে।
Advertisement
আরও পড়ুন: মিরসরাইয়ে ১৮০০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জয়পুরহাট সদর উপজেলার হিচমী, কোমরগ্রাম, চৌমুহনী, ধারকী, পাকারমাথাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় আলু বীজ রোপণে ব্যস্ত কৃষকেরা। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে মাঠে চলছে আলু রোপণ। গত বছর সারের সংকট থাকলেও এবার তা নেই। তবে সংকটের অজুহাতে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি দামে বীজ আলু কিনতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন কৃষকেরা। একদিকে সার, কীটনাশকের দাম বেড়েছে; অন্যদিকে অতিরিক্ত দাম দিয়ে বীজ কিনে শেষ অবধি যদি বাজার মূল্য ভালো না পাওয়া যায় তবে সর্বশান্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন তারা। তাই স্বপ্নের সঙ্গে কিছুটা শঙ্কা নিয়েই এবার আলু চাষ করছেন তারা।
জেলা কৃষি বিপণন অফিস জানায়, এবার এ-গ্রেড কার্ডিনাল বীজ আলু ৪০ কেজি বস্তার দাম ২৪০০ ও বি-গ্রেড ২৩২০ টাকা, ডায়মন্ড এ-গ্রেড ২৪৮০ টাকা ও বি-গ্রেড ২৪০০ টাকা, এস্ট্রোরিজ এ-গ্রেড ২৬৮০ ও বি-গ্রেড ২৬০০ টাকা, গ্রানুলা এ-গ্রেড ২২০০ ও বি-গ্রেড ২১২০ টাকা, কারেজ এ-গ্রেড ২৫২০ ও বি-গ্রেড ২৪৪০ টাকা। এছাড়া এ-গ্রেড ব্র্যাক লাল পাকরি ২৫২০ থেকে ২৬৮০ টাকা, ব্র্যাক চল্লিশা ২৮০০ থেকে ৩০০০ টাকা এবং বারি আলু-৬২ ২৪৮০ থেকে ২৬০০ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।
এদিকে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এসব না মেনে সংকটের অজুহাত দেখিয়ে ৪০ কেজি প্রতি বস্তা আলু বীজ ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত বেশি দামে বিক্রি করছেন। কোনো কোনো ব্যবসায়ী কৃষকদের কাছে আলু বীজ বিক্রির পর কোনো স্লিপ দিচ্ছেন না। আবার অনেকে স্লিপে সরকারি দাম লিখে দিলেও দাম নিচ্ছেন অতিরিক্ত।
Advertisement
সদর উপজেলার হিচমী বাজারের শাহীন নামে এক কৃষক জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত বছর আমি এক বিঘা আলু চাষ করেছি ১৭ হাজার টাকায়। কিন্তু এবার বীজের দাম বেশি হওয়ায় আমার ৩ হাজার টাকা খরচ বেশি হয়েছে। হিচমী বাজারের একটি দোকান থেকে আমি ব্র্যাক সিডের বীজ আলু ৩২০০ টাকায় কিনেছি। তবে তার নির্ধারিত মূল্য প্রায় ২৭০০ টাকা।’
আরও পড়ুন: দ্বিগুণ লাভের আশায় আগাম আলু চাষ
গঙ্গাদাসপুরের মামুন নামে এক কৃষক জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতি বছর সার ও বীজ আলুর কৃত্রিম সংকট তৈরি করে একটি সিন্ডিকেট অতিরিক্ত মুনাফা লাভ করে আসছে। ৪ দিন ঘুরে ঘুরে অবশেষে এক দোকান থেকে ৪০০ টাকা বেশি দামে দুই বস্তা বীজ আলু কিনেছি।’
চক ফকিরপাড়া গ্রামের বাছেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘সরকার যে রেট দিয়েছে আলু বীজের জন্য, সেই রেটে আমরা ডিলারের কাছে গিয়ে আলু পাচ্ছি না। ২৬০০ থেকে ২৮০০ টাকার আলু বীজ ৩২০০ থেকে ৩৪০০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। আমরা তো রাস্তা পাচ্ছি না, কী করবো?’
কালাই উপজেলার মাত্রাই ইউনিয়নের আলু চাষি জাহাঙ্গীর, উদয়পুরের আনিছুর, জিন্দারপুর ইউনিয়নের সাজুসহ অনেকেই জানান, হিমাগারে লোকাল ভাবে সংরক্ষণ করা আলু বিভিন্ন নাম সর্বস্ব সংস্থার লোগো ব্যবহার করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে। অনেক কৃষক বিভিন্ন আলু ব্যবসায়ীর গোডাউন থেকে উচ্চদামে এসব বীজ সংগ্রহ করেছেন, অনেকে সংগ্রহ করবেন। এসব বীজ ব্যবহার করে কৃষকেরা লোকসানের মুখে পড়তে পারেন।
হিচমী বাজারের মেসার্স স্বর্ণালী এন্টারপ্রাইজের মালিক বিএডিসি অনুমোদিত বীজ ডিলার জুলফিকার আলী ভুট্টু জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ এলাকার কৃষকদের কাছে বিএডিসির আলুর চাহিদা তেমন নেই। এজন্য আমার বেচাকেনা খুব কম। সরকারি রেটের চেয়েও ১ টাকা-দেড় টাকা কেজিতে কম দামে আমরা বীজ বিক্রি করছি। কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানির বীজের চাহিদা বেশি। বিএডিসির বীজ যদি বিক্রি না হয় তাহলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাব। প্রাইভেট কোম্পানির ছোট ডিলাররা বেশি দামে বীজ বিক্রি করছেন।’
মেসার্স লামিম ট্রেডার্সের আব্দুস সাত্তার জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি একটি বেসরকারি কোম্পানির বীজ বিক্রি করি। তারা নির্ধারিত যে দাম আমাদের দিয়েছে, সেই দামেই বিক্রি করছি। কতিপয় অসৎ ব্যবসায়ী, যাদের লাইসেন্স নেই; তারা সিন্ডিকেট করে বীজের দাম বেশি নিচ্ছেন। এতে আমাদের সুনাম নষ্ট হচ্ছে। আমরা দাম বেশি নিচ্ছি না।’
আরও পড়ুন: ৮ লাখ টাকার শিম বিক্রি, আরও ৪ লাখ বিক্রির আশা
ক্ষেতলালের বটতলী বাজারের বিএডিসি অনুমোদিত ডিলার দুলাল মিয়া জাগো নিউজকে বলেন, ‘বাজারে বীজ আলুর কোনো সংকট নেই। আমরা সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করছি। গ্রাম-গঞ্জে কোনো ছোট ডিলার বেশি দাম নিয়ে থাকলে বিষয়টি আমাদের জানা নেই।’
জয়পুরহাট কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা রতন কুমার রায় জাগো নিউজকে বলেন, ‘আলুর বীজের বিষয়টি নিয়ে আমরা কৃষি বিপণন থেকে নিয়মিত মনিটরিং করছি। কয়েকদিন আগে বীজের দোকানে অভিযান চালানো হয়েছিল। সে সময় কয়েকজনকে কৃষি বিপণন আইনে জরিমানাও করেছি। তাদের সতর্ক করা হয়েছে, যেন অতিরিক্ত মূল্যে কেউ বীজ বিক্রি না করেন।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক মুজিবুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘জেলায় এবার ৩৮ হাজার ৬২৫ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিপরীতে আলুর বীজের চাহিদা আছে ৫৮ হাজার মেট্রিক টন। এরই মধ্যে ২ হাজার হেক্টর জমিতে আলু রোপণ সম্পন্ন হয়েছে। বর্তমানে আলু বীজের কোনো সংকট নেই। কেউ যদি বেশি দামে বা নিম্নমানের আলু বিক্রি করে তাহলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
এসইউ/এমএস