#স্কুলে ভর্তি, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করা যাচ্ছে না#আইন-বিধির ‘লঙ্ঘন’ করে সনদ দিচ্ছে ডিএসসিসি#জাতীয় সার্ভারের সঙ্গে ডিএসসিসির সার্ভারের আন্তঃযোগাযোগ নেই
Advertisement
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন ভোগান্তিহীন করতে এ কার্যক্রম ঢেলে সাজিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। নিজেদের নতুন ওয়েবসাইটেই সরাসরি জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের আবেদন গ্রহণ ও সনদ বিতরণ করছে। ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভারে সহজে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করা যাচ্ছে, সনদ পেতেও ভোগান্তি হচ্ছে না নাগরিকদের। তবে এ সনদ নিয়ে দেখা দিয়েছে আইনিসহ অন্য জটিলতা। এতে নতুন করে বিড়ম্বনায় পড়েছেন নাগরিকরা।
নাগরিকদের অভিযোগ, এক মাস ধরে ডিএসসিসি নিজস্ব সার্ভারে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সনদের আবেদন গ্রহণ এবং বিতরণ করছে। তবে এসব সনদ নিয়ে স্কুল-কলেজে ভর্তি, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্সের আবেদন করতে পারছেন না তারা। কারণ, ‘জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’র দায়িত্বপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের জাতীয় সার্ভারের সঙ্গে ডিএসসিসির আন্তঃযোগাযোগ নেই। এছাড়া ডিএসসিসির সঙ্গে সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠানের সমঝোতা স্মারকও (এমওইউ) নেই। ফলে তথ্য যাচাই করতে না পাড়ায় বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের সেবা নিতে গিয়ে হয়রানির মুখে পড়ছেন নাগগিকরা।
তবে ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তারা সরকারের সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের (এমএইউ) চেষ্টা করছেন। শিগগির এ সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু এমওইউ ও জন্মনিবন্ধন আইন সংশোধন ছাড়া কেন নিজস্ব সার্ভারে জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করা হলো- এমন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারনেনি সংশ্লিষ্ট কেউই।
Advertisement
আরও পড়ুন>> নিজস্ব সার্ভারে জন্মনিবন্ধন চালু দক্ষিণ সিটির, জানে না মন্ত্রণালয়
এদিকে ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভারে নিবন্ধনের বিষয়টি আইন-বিধির লঙ্ঘন হয়েছে উল্লেখ করে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে আপত্তি জানিয়েছে ‘জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’র দায়িত্বপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
নিজস্ব সার্ভারে জন্মনিবন্ধন চালু দক্ষিণ সিটির, জানে না মন্ত্রণালয়
এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী জন্মনিবন্ধন সনদ বিতরণের দায়িত্ব রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের। তাদের নিজস্ব সার্ভার থেকে সারাদেশের সব সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদে জন্মসনদ বিতরণ করা হচ্ছে। এখন দক্ষিণ সিটি নিজস্ব সার্ভারে সনদ দিচ্ছে বলে শুনেছি। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখবো।’
Advertisement
দক্ষিণ সিটির নিজস্ব সার্ভারে জন্মনিবন্ধন
জন্মনিবন্ধন সনদ বিতরণের খাত থেকে আদায় হওয়া রাজস্বের ভাগ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের সঙ্গে ডিএসসিসির দ্বন্দ্ব। এনিয়ে গত জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডিএসএসসিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কার্যক্রম বন্ধ ছিল। পরে নিজস্ব সার্ভার তৈরি করে গত ৪ অক্টোবর ডিএসসিসি এ সেবা চালু করে। স্বতন্ত্র সার্ভার চালু হওয়ায় নিবন্ধন ফি’র অর্থ সরাসরি পাচ্ছে ডিএসসিসি। বর্তমানে ডিএসসিসির ১০টি আঞ্চলিক কার্যালয়ে নিবন্ধনের কাজ চলছে।
তবে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা কেন্দ্রীয় সার্ভারের সঙ্গে ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভারের আন্তঃসংযোগ নেই। ফলে ডিএসসিসির সার্ভারে নিবন্ধনের তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে জমা হচ্ছে না। সরকারের কোনো সংস্থা তথ্য যাচাই করতে পারছে না।
আরও পড়ুন>> তিন মাস বন্ধ রেখেও জন্মনিবন্ধন কাজের স্বীকৃতি পেলো ডিএসসিসি
কলাবাগানের ডলফিন গলির বাসিন্দা আসাদুজ্জামান। সপ্তাহখানেক আগে ডিএসসিসি অঞ্চল-১ এর কার্যালয় থেকে চার বছরের ছেলে নাহিদুল ইসলামের জন্মনিবন্ধন করান। পরে এ জন্মনিবন্ধনের নম্বর দিয়ে অনলাইনে জরুরি ভিত্তিতে পাসপোর্টের আবেদন করেন তিনি। কিন্তু তার এ পাসপোর্ট আবেদন গ্রহণ করেনি ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর।
আসাদুজ্জামান বলেন, ‘ডিএসসিসি থেকে তাদের যে জন্মনিবন্ধন সনদ দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের জাতীয় সার্ভারের সঙ্গে কোনো মিল নেই। ফলে জন্মনিবন্ধন নম্বর খুঁজে পাননি পাসপোর্ট অফিসের লোকেরা। তাদের কয়েকজন বলছেন, দক্ষিণ সিটির এ জন্মনিবন্ধন সনদ ভুয়া। এর আইনগত ভিত্তি নেই। পরে ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তারা কোনো পাত্তা দিচ্ছেন না।’
স্কুলে শিশুদের ভর্তির জন্য জন্মনিবন্ধন সনদ বাধ্যতামূলক। সন্তানের জন্মনিবন্ধন করতে সায়েদাবাদে ডিএসসিসির অঞ্চল-৫ এর কার্যালয়ে যান যাত্রাবাড়ীর বিবিরবাগিচার বাসিন্দা সৈয়দ খোরশেদ আলম। তিনি সেখানে গিয়ে জারতে পারেন এক মাস ধরে দক্ষিণ সিটি থেকে যেসব জন্মনিবন্ধন সনদ বিতরণ করা হয়েছে, সেগুলো সরকারের কোনো সংস্থা গ্রহণ করছে না। স্কুলে ভর্তি, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ কোনো কাজই করা যাচ্ছে না। ফলে অনেকেই সনদ করতে গিয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
খোরশেদ আলম অভিযোগ করে বলেন, ‘নাগরিক সেবায় সিটি করপোরেশনের যে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে, তার মধ্যে জন্মসনদ বিতরণ অন্যতম একটি প্রধান কাজ। অথচ এখন সিটি করপোরেশনের জন্মসনদ দিয়ে কোনো কাজই করা যাচ্ছে না। কিন্তু কেন করা যাচ্ছে না তাও স্পষ্ট করে বলছেন না তারা।’
এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএসসিসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রতিদিনই ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা ডিএসসিসির সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এ সমস্যা সমাধানে অনুরোধ করছেন। কিন্তু ডিএসসিসির সঙ্গে এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের এমওইউ নেই। এছাড়া এমওইউ করার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুমোদন তথা আইন পরিবর্তন করা লাগবে।’
আরও পড়ুন>> পদে পদে ভোগান্তি: টাকা দিলে আগে মেলে জন্মনিবন্ধন সনদ
যদিও এ সমস্যা সমাধানে গত ১৮ অক্টোবর ২২টি সরকারি প্রতিষ্ঠানকে যুক্ত করে একটি চিঠি ইস্যু করে ডিএসসিসি। চিঠিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সনদ যাচাইয়ে ডিএসসিসির সার্ভারে ক্লিক করে কিউআর কোড ব্যবহারের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। কিন্তু এটি হঠকারিতা ছাড়া কিছুই নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির জাগো নিউজকে বলেন, ‘মূলত রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের সার্ভারে ত্রুটির কারণে নাগরিকদের চরম ভোগান্তি হচ্ছিল। তাই নাগরিক সেবা সহজ করতে নিজস্ব সার্ভারে জন্মনিবন্ধন সেবা শুরু করেছে ডিএসসিসি। তবে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডিএসসিসির এমওইউ না থাকায় কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে কাজ করছি।’
তবে এমওইউ এবং জন্মনিবন্ধন আইন পরিবর্তন না করে কেন নিজস্ব সার্ভারে জন্মনিবন্ধন সনদ বিতরণ করা হচ্ছে- এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেননি ফজলে শামসুল কবির।
রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের অভিযোগ
স্থানীয় সরকার বিভাগের ‘জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন’ দায়িত্বপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় সূত্র জানায়, জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ বিভিন্ন সরকারি সেবা পেতে জন্মসনদের প্রয়োজন হয়। এমন ২২টি সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে রেজিস্ট্রার জেনারেল কার্যালয়ের এমওইউ আছে। এখন ডিএসসিসি যেটি করছে তার আইনগত কোনো ভিত্তি নেই। এটি করতে চাইলে বিদ্যমান জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন-বিধি সংশোধন করতে হবে। এ সংশোধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে দীর্ঘসময় লাগবে।
আরও পড়ুন>> মিরপুরে জনবল সংকটে বন্ধ জন্মনিবন্ধন কার্যক্রম
ডিএসসিসির নিজস্ব সার্ভারে নিবন্ধনের বিষয়টি আইনবিধির লঙ্ঘন উল্লেখ করে এরই মধ্যে আপত্তি জানিয়েছে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়। গত ১৯ অক্টোবর স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের কাছে এক চিঠিতে এ আপত্তি জানান রেজিস্ট্রার জেনারেল (জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন) মো. রাশেদুল হাসান।
ওই চিঠিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন ২০০৪-এর ৭ (ক) (২) এবং জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮-এর ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৯ (২) ধারা তুলে ধরা হয়েছে। আইনের ৭ (ক) (২) ধারায় বলা আছে, রেজিস্ট্রার জেনারেলের দায়িত্ব ও কার্যাবলি বিধি দ্বারা নির্ধারিত হবে। আর বিধিমালার ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৯ (২) ধারায় উল্লেখ আছে, সফটওয়্যার নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও সফটওয়্যারের মাধ্যমে নিবন্ধনের তথ্য কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারে সংরক্ষণের এখতিয়ার রেজিস্ট্রার জেনারেলের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাশেদুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী কেন্দ্রীয়ভাবে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের কাজের এখতিয়ার রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের। সরকারের কোনো সংস্থার এ সংক্রান্ত কাজ আইন ও বিধির লঙ্ঘন। বিষয়টি লিখিতভাবে স্থানীয় সরকার বিভাগকে জানিয়েছি। এখন তারাই করণীয় নির্ধারণ করবে।’
এমএমএ/ইএ/জেআইএম