মতামত

বিএনপি আওয়ামী লীগ নয়, ফাঁদে পড়েছেন জনগণ

 

‘আওয়ামী লীগকে ফাঁদে ফেলতে গিয়ে বিএনপি নিজেরাই ফাঁদে পড়েছে’-বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আসলেই কি তাই? আদতে কারা ফাঁদে পড়ে ধরাশায়ী হচ্ছেন? আমাদের এখন যা অবস্থা তাতে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামী নয়, সবচেয়ে ‘মাইনকা চিপায়’ বা ফাঁদে পড়েছেন জনগণ। আন্দোলনের নামে যে সহিংসতা ও জ্বালাও পোড়াও চলছে, তাতে আর যাই হোক, বিরোধীদলের জয় আসবে কিনা সন্দেহ। কারণ জনগণের ভোগান্তি, প্রাণসংহার করে যে জয় তারা আনতে চাইছেন, তা বুমেরাং ফল বয়ে আনতে পারে।

Advertisement

পুলিশ হত্যা থেকে শুরু করে সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ। বাসে আগুন, গাড়ি ভাংচুর, হেলপার মারা, হাসপাতালে হামলা চালানো, অ্যাম্বুলেন্স ভাঙা, পণ্যবাহী গাড়ি জ্বালিয়ে দেয়ার দায় কে বহন করবে? সরকার না জনগণ? বিরোধীদল কি জানেন না যে বাসে চেপে চলাচল করেন কারা? মন্ত্রী, আমলা, ধনীক শ্রেণি নাকি রাজনীতিবিদ? ওনাদের নিজেদের গাড়ি আছে, পুলিশ প্রহরা আছে। দূরপাল্লার বাস চলতে দিচ্ছেন না, মানুষ প্রয়োজনীয় কাজে ঢাকা থেকে বের হতে পারছেন না, ঢাকায় আসতেও পারছেন না। অথচ সেই মন্ত্রী, আমলা, ধনীক শ্রেণি ও রাজনীতিবিদরা প্লেনে করেই কাজ করে যাচ্ছেন। এই যে দিনের পর দিন ‘অবরোধ’ নামক একটা অত্যাচার সাধারণ মানুষের উপর চাপিয়ে দিচ্ছেন, তাতে কি আগামীকালকেই সরকারের পতন সম্ভব হবে বলে মনে করছেন?

এই সংঘাতময় পরিস্থিতিতেই মানুষকে কাজের প্রয়োজনে বাইরে বের হতে হচ্ছে, ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে, স্কুলগুলোতে ফাইনাল পরীক্ষা শুরু হচ্ছে, এমতাবস্থায় আপনারা চলন্ত ও দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়ে সটকে পড়ছেন। আর ভাবছেন ক্ষমতায় বসে যাবেন অচিরেই। এতগুলো বছর পর সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরে এসে বিএনপি ভোটাধিকার আদায়ের রাজনীতি না করে, জনগণের ঘাড়ে পা দিয়ে ক্ষমতায় আরোহন করতে চাইছে।

বিরোধীদল কি একবার ভেবে দেখেছেন দ্বিতীয় দফায় ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ শেষে ২৪ ঘণ্টা বিরতির পর ফের তারা যে ৪৮ ঘণ্টা অবরোধের যে ডাক দিয়েছেন, তাতে সরকারের কী এসে গেছে বা কী এসে যাবে। কতটা ক্ষতি করতে পারছেন সরকার বা আওয়ামী লীগের? এই আন্দোলনে আপনাদের কতটা সাফল্য এলো, সাধারণ মানুষ কী প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছেন, ব্যবসার উপর কী প্রভাব পড়ছে, সে সংক্রান্ত কোনোরকম পর্যালোচনা না করেই শুক্র-শনিবার বিরতি দিয়ে রোববার (১২ নভেম্বর) ভোর থেকে টানা কর্মসূচিতে যাচ্ছে বিএনপি।

Advertisement

বহুবছর পর রাজনীতির মাঠে নেমে বিরোধী দল হরতাল ও অবরোধকে দাবি আদায়ের অস্ত্র হিসেবে বেছে নিয়েছে। সম্ভবত এই দুটি সবচেয়ে সহজ রাজনৈতিক হাতিয়ার। তেমন সৈন্যসামন্ত লাগে না, শুধু মানুষকে ভয় দেখাতে পারলেই ফায়দা হাসিল। মানুষ পথে নামবে না, যানবাহন চলবে না, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান খুলবে না, স্কুল-কলেজ চলবে না। আর এই ভয় দেখানোর উপায়টাও তারা ভালোই খুঁজে বের করেছেন, সেটা হলো অগ্নিসংযোগ ও যানবাহন ভাংচুর।

এ ক্ষেত্রে অসহযোগ আন্দোলনের কথাও ভাবছে দলটি। যদিও বিএনপির নেতা-কর্মী এবং সমর্থকরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ‘অসহযোগ আন্দোলন’ সম্পর্কে তাদের তেমন কোনো ধারণা নেই। তারা বিষয়টিকে হরতাল-অবরোধের মতো করে ভাবছেন। যে আন্দোলন সম্পর্কে নেতা-কর্মী ও সমর্থকদেরই ধারণা নেই, তারা এর রেজাল্ট বুঝবেন কেমন করে? ইতিহাসে পড়েছি মহাত্মা গান্ধী বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যখন অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন, এর আগে স্বদেশীরা অনেকটা পথ পার করেছেন আন্দোলন-সংগ্রাম করে।

পাক-ভারত-বাংলা উপমহাদেশে মহাত্মা গান্ধী ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক পরিচালিত গণ-আইন অমান্য আন্দোলন হল অসহযোগ আন্দোলন। ১৯২০ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯২২ সাল পর্যন্ত চলা এই আন্দোলন ভারতবর্ষের ইতিহাসে প্রথম গণভিত্তিক জাতীয় আন্দোলন। ব্রিটিশ সরকারের নির্দেশ অমান্য ও সরকারি কাজে অসহযোগিতা করাই ছিল এই আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য। এই আন্দোলনকে ‘অহিংস অসহযোগ আন্দোলন’ও বলা হয়। আন্দোলন হবে কিন্তু কোনোরকম সহিংসতা হবে না, এমনটাই ছিল রুপরেখা।

১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ২ মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, চলে ২৫ মার্চ পর্যন্ত। কাজেই ‘অসহযোগ আন্দোলন’ এর ডাক দেয়ার আগে এর রুপরেখা নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের নিজেদেরই পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার।

Advertisement

আমরা যারা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ তাদের শিরে-সংক্রান্তি অবস্থা। আমরা এমনিই জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছি, এর উপর এই সহিংস রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। বছরের পর বছর ধরে চলা দুর্নীতি, লুটপাট, নাগরিক হয়রানি, মূল্যস্ফীতি, হত্যা, গুম, টাকা পাচার, নিরাপত্তাহীনতা, অভাব-অনটন, অর্থনৈতিক মন্দা সবকিছু মিলিয়ে নাগরিকদের জীবন ভীষণ যন্ত্রণার ও হতাশার। সরকারের ক্রমবর্ধমান অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বৃদ্ধি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সুবিধাদি ও বেতন বৃদ্ধি, মেগা প্রকল্প গ্রহণের বিপরীতে জনগণের একটা বড় অংশের নুন আনতে পানতা ফুরায় অবস্থা।

মধ্যবিত্ত ও নিন্মবিত্ত মানুষতো ইতোমধ্যে সঞ্চয় ভেঙে খাওয়া শুরু করেছেন। শুধু নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়, ২০২২ সালের সঙ্গে, চলতি বছরের তুলনা করলে দেখবো যে আরও অনেক খাতেই অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। বেড়েছে বাড়িভাড়া, পরিবহন খরচ, জ্বালানি, বিদ্যুৎ, চিকিৎসা ও শিক্ষা ব্যয়। গত এক বছরে ভোজ্যতেলের মতো বিভিন্ন আমদানিভিত্তিক নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়েনি।

দেশের মানুষ দেশের প্রকৃত পরিস্থিতি জানেন না। সাধারণ মানুষের চ্যালেঞ্জ কী, জানতে চাইলে ৬৮ শতাংশ মানুষ যেখানে বলেছেন, খাবার কিনতেই তাঁদের অবস্থা হিমশিম, সেখানে হরতাল-অবরোধে অবস্থা আরো দুঃসহ হয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। স্পষ্টই বলা যায় সাধারণ মানুষ নানাদিক দিয়ে সরকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই ডুবে যাওয়া অবস্থায় যেখানে সাধারণ মানুষ খড়কুটো আঁকড়ে ধরে ভেসে থাকার চেষ্টা করছেন, সেখানে সরকার পরিবর্তনের কথা শুনিয়ে জ্বালাও-পোড়াও কতটা ঠিক কৌশল হচ্ছে বিরোধী দলের, তা ভেবে দেখা দরকার।

রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের নামে, এখন এমন একটা সময় এসেছে, যখন রাজনীতির প্যাঁচে পড়ে যেকোনো সময় ঢাকার রাস্তায় আমি, আপনি অথবা আপনার সন্তান বা স্বজন পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাবে। বাসের ভিতরে বসে গন্তব্যে না পৌঁছে, সোজা পরপারে চলে যেতে হতে পারে। আমরা যারা রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চাই, রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাই, সন্তান-সন্ততিসহ নিরাপদ থাকতে চাই তারাই এখন সবচেয়ে নিরুপায়।

আমরা রাজনীতির ভয়াবহতাকে যতোই এড়াতে চাই, এই রাজনীতি আমাদের ছাড়ছে না। নিয়ম মতো দুই দলের রাজনৈতিক কর্মীরা অশান্তি সৃষ্টির জন্য পরস্পরকে দায়ী করতেই থাকবেন, প্রকৃত হামলাকারী চিহ্নিত হবে না, জনগণের সম্পদ ধ্বংস হবে, হামলা-মামলা চলবে, জিনিসপত্রের দাম আরো বাড়বে, আর হয়তো এভাবেই চলবে বাংলাদেশের রাজনীতির জগত।

সরকার যেমন জনগণের ভোটের অধিকারকে এড়িয়ে যেতে চাইছেন, অন্যদিকে বিরোধীদলগুলোও ভোটাধিকার নিয়ে আমাদের কোনো আশার বাণী দেখাতে পারছেন না। বিএনপি’র এই ‘ছন্নছাড়া’ অবস্থার মধ্যে অসহযোগ আন্দোলন বাস্তবসম্মত হবে না বলে মনে করছেন দলটিরই মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা। তাদের মতে, আরও কিছু দিন হরতাল-অবরোধ চালিয়ে যাওয়ার পর অসহযোগ আন্দোলনের কথা ভাবা উচিত বিএনপির।

দল না গুছিয়ে, নেতা ঠিক না করে, মাঠ পর্যায়ে কোনো কাজ না করে, দিক-নির্দেশনা ছাড়া ও অত্যন্ত দুর্বল সাংগঠনিক কাঠামো নিয়ে বিএনপি যে আন্দোলন সংগ্রাম করছে, তা কি শুধু সহিংসতা ও গুপ্তহামলার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে? তাদের মনে রাখা দরকার রাজনীতির নামে সন্ত্রাসবাদ, জ্বালাও পোড়াও যতো বেশি হবে, সরকারের অবস্থান তত বেশি পাকাপোক্ত হবে। জনগণ যতোই অর্থনৈতিক চাপে থাকুক না কেন, কিন্তু এইসব হরতাল, অবরোধ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি, যানবাহন ভাংচুর ও সর্বোপরি আগুন সন্ত্রাস এখন আর চাইছেন না। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো যদি জনগণকে নিয়ে খেলা করতে শুরু করেন, তাহলে সেটা বড় ভুল হবে। কারণ একটি খারাপ সিস্টেম দেশের মানুষকে বারবার পরাজিত করে। আর মানুষ পরাজিত হলে দেশ পরাজিত হয়।

৭ নভেম্বর, ২০২৩লেখক: যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস