জাতীয়

উত্তরায় ডিস-ইন্টারনেট সেবার ওপর ‘অদ্ভুত’ চাঁদাবাজি

একশো বাসায় ইন্টারনেট ও ডিস সংযোগ দিলে চাঁদা পাঁচ হাজার টাকা। একশোর বেশি বাসায় সংযোগ দিলে সেই অংক হবে ১০ হাজার টাকা। পাশাপাশি প্রতি মাসে সার্ভিস চার্জ বাবদ প্রতি একশো সংযোগের জন্য গুনতে হবে আরও পাঁচ হাজার টাকা। সংযোগের সংখ্যা ২০০ পূর্ণ হলে সার্ভিস চার্জ হবে ১০ হাজার টাকা। এভাবে প্রতি একশো সংযোগ বাড়লে সার্ভিস চার্জের পরিমাণও পাঁচ হাজার করে বাড়বে।

Advertisement

ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের ওপর এমন ‘অদ্ভুত’ চাঁদা বসিয়েছে রাজধানীর উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টর ওয়েলফেয়ার সোসাইটি। গত ৩১ অক্টোবর ও ২ নভেম্বর ওই এলাকায় ডিস ও ইন্টারনেট সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ নির্দেশনা মেনে ব্যবসা করার জন্য চিঠি দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: বিনোদনের জন্য ইন্টারনেট চালায় ৫৩ শতাংশ শ্রমিক-পথশিশু

চিঠি দুটির একটিতে সই করেছেন সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মুমতাজুল করিম, অর্থ সম্পাদক কাজী মোশাররফ হোসেন এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জুবাইর আব্দুল্লাহ নাসিম। অন্যটিতে সই করেছেন সোসাইটির অ্যাডমিন অ্যান্ড ফাইন্যান্স ম্যানেজার খায়রুল বাসার রুমেল। চিঠি দুটি জাগো নিউজের হাতে এসেছে।

Advertisement

সোসাইটির নেতারা বলছেন, ডিস-ইন্টারনেট ব্যবসায়ী সেজে অনেকে বাসা-বাড়িতে ঢুকে চুরির ঘটনাও ঘটায়। সেগুলো রুখতে নিবন্ধিতদেরই কেবল সোসাইটি এলাকায় সংযোগের কাজ করতে দেওয়া হবে।

সোসাইটির নেতারা বলছেন, ডিস-ইন্টারনেট ব্যবসায়ী সেজে অনেকে বাসা-বাড়িতে ঢুকে চুরির ঘটনাও ঘটায়। সেগুলো রুখতে নিবন্ধিতদেরই কেবল সোসাইটি এলাকায় সংযোগের কাজ করতে দেওয়া হবে

অন্যদিকে ডিস ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ীরা বলছেন, রাজধানীতে কোথাও এমন চাঁদা বা নিবন্ধনের কথা তারা জানেন না। ১৩ নম্বর সেক্টর সোসাইটি অদ্ভূত এ নিয়ম চালু করছে। তারা রীতিমতো সার্কুলার দিয়ে আবেদন জমা নিচ্ছেন। বাধ্য হয়ে অনেক ব্যবসায়ী তাদের এ ‘অন্যায়’ আবদার মেনে আবেদন করছেন।

গত ২ নভেম্বর একটি ইন্টারনেট ও ডিস সংযোগের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক/চেয়ারম্যান বরাবর দেওয়া চিঠিতে বলা হয়, গত আগস্ট মাসে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টর ওয়েলফেয়ার সোসাইটি কর্তৃক আপনাকে চিঠির মাধ্যমে অবহিত করা হয় যে, ১৩ নম্বর সেক্টর এলাকায় ডিস ও ইন্টারনেট ব্যবসা সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে সোসাইটি কর্তৃক নিবন্ধিত হতে হবে। আপনি তার পরিপ্রেক্ষিতে আবেদনপত্র জমা দিয়েছেন।

Advertisement

আরও পড়ুন: দেশে মোবাইল টাওয়ার থেকে ছড়ানো রেডিয়েশন মান সহনীয়

এতে আরও বলা হয়, সোসাইটির নির্বাহী পরিষদের সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক আপনার নিবন্ধন ফি ১০ হাজার টাকা এবং সেপ্টেম্বর ও নভেম্বর দুই মাসের সার্ভিস চার্জ ২০ হাজার টাকা আগামী ১০ নভেম্বরের মধ্যে সোসাইটির অফিসে জমা দিত অনুরোধ করা যাচ্ছে।

অন্যদিকে ৩১ অক্টোবর সই করা নির্দেশনায় নিবন্ধন ফি ও সার্ভিস চার্জ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় সোসাইটির নেতারা। সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও অর্থ সম্পাদকের সই করা ওই নির্দেশনায় জানানো হয়, সোসাইটির ভেতরে যারা অন্তত ১০০ সংযোগ দিয়েছেন, তাদের নিবন্ধন ফি পাঁচ হাজার টাকা। একশোর বেশি হলে ফি হবে ১০ হাজার টাকা।

সেখানে সার্ভিস চার্জও উল্লেখ করা হয়। সার্ভিস চার্জ অংশে বলা হয়, সোসাইটির ভেতরে নিবন্ধন করে যারা ব্যবসা করতে চান তাদের মাসিক সার্ভিস চার্জ সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা। সংযোগের সংখ্যায় একশো অতিক্রম করলে প্রতি ১০০ সংযোগে আরও পাঁচ হাজার টাকা করে বাড়বে। অর্থাৎ কারও ৩০০ সংযোগ থাকলে তাকে প্রতি মাসে ১৫ হাজার টাকা সার্ভিস চার্জ দিতে হবে।

বেশিরভাগ গ্রাহকই ৮০০ টাকার প্যাকেজ নেন। আমার ১১০-১১৫ জন গ্রাহক আছে। এখন নিবন্ধন করতে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে। আবার মাসে মাসে পাঁচ হাজার দিতে হবে। লাভ তাহলে আর কী থাকবে? এটা অন্যায় হচ্ছে

ওই এলাকার অন্তত পাঁচজন ডিস ও ইন্টারনেট ব্যবসায়ীর সঙ্গে জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা কেউ নাম প্রকাশ করে এ প্রসঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। প্রায় সাত বছর ওই এলাকায় ডিস ব্যবসা করা এক ব্যবসায়ী নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে জাগো নিউজকে বলেন, ‘এ ব্যবসায় আমার রুটি-রুজি। অন্যকিছু তো করি নাই। অন্য এলাকায় এখন হঠাৎ সংযোগও দিতে পারবো না।’

আরও পড়ুন: ইন্টারনেটে কেউ না কেউ আপনাকে নজরদারিতে রেখেছে

তিনি বলেন, ‘এখানে প্রায় পাঁচ হাজার গ্রাহক রয়েছে। গত আগস্ট থেকে সোসাইটির নেতারা আমাদের কাছ থেকে এ চাঁদা নিতে তোড়জোড় শুরু করে। তারা সেটা আদায় করেই ছাড়বে।’

ডিস ও ইন্টারনেট উভয় ব্যবসা থাকা আরেক ব্যবসায়ী বলেন, ‘বেশিরভাগ গ্রাহকই ৮০০ টাকার প্যাকেজ নেন। আমার ১১০-১১৫ জন গ্রাহক আছে। এখন নিবন্ধন করতে পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে। আবার মাসে মাসে পাঁচ হাজার দিতে হবে। লাভ তাহলে আর কী থাকবে? এটা অন্যায় হচ্ছে।’

জানতে চাইলে ১৩ নম্বর সেক্টর ওয়েলফেয়ার সোসাইটির অ্যাডমিন অ্যান্ড ফাইন্যান্স ম্যানেজার খায়রুল বাসার রুমেল জাগো নিউজকে বলেন, ‘এলাকায় চুরির ঘটনা ঘটছে অনেক। বেশিরভাগই ইন্টারনেট ও ডিস ব্যবসায়ী বলে ঢোকে। এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য তাদের সব কাগজপত্র আমরা নিচ্ছি। তাদের আইডি কার্ড দেওয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা তো কাউকে জোর করছি না যে এখানে এসে ব্যবসা করেন। আমাদের নির্বাহী পরিষদ মিটিং করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা থেকে সরে আসার সুযোগ নেই। আমরা নিবন্ধন করতে সার্কুলার দেওয়ার পর ২৭ জন আবদেন করেছেন। তাদের আমরা চিঠি দিয়ে ফি ও সার্ভিস চার্জ জানিয়ে দিচ্ছি।’

আরও পড়ুন: মডেমে ‘অপচয়’ সাড়ে ৩ কোটি, সংযোগ ছাড়াই ইন্টারনেট বিল ১৯ লাখ!

ব্যবসায়ীদের ওপর এত টাকা ফি নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে খায়রুল বাসার রুমেল বলেন, ‘তাদের আমরা দেখভাল করবো। প্রয়োজনে তাদের যান্ত্রিক সহায়তা দেওয়াও হবে। যেন সোসাইটির সদস্যরা ভালো ইন্টারনেট ও ডিস সেবা পান। সোসাইটির কল্যাণে আমরা এটা করছি।’

উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে ৩৫ জন নিবন্ধিতসহ শতাধিক ইন্টারনেট ও ডিস ব্যবসায়ী রয়েছেন। ওই এলাকার এক হাজারের বেশি বাসায় পাঁচ হাজারের বেশি ব্রডব্যান্ড ও ডিস সংযোগ রয়েছে। সোসাইটির অদ্ভূত চাঁদাবাজিতে তারা ‘দিশেহারা’

উত্তরার আর কোনো সেক্টর সোসাইটি বা রাজধানীতে কোথাও এমন নিয়ম আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কোথাও আছে কি না জানি না। আমাদের সিদ্ধান্ত, আমরা এটা বাস্তবায়ন করবোই।’

এদিকে, চিঠি দিয়ে নিবন্ধন ফি ও চাঁদা আদায়ে জোর করায় বুধবার (৮ নভেম্বর) ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) কার্যালয়ে উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের আইএসপি ব্যবসায়ীদের নিয়ে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে।

জানতে চাইলে আইএসপিএবি সভাপতি ইমদাদুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা সরকারের বাইরে কাউকে চাঁদা দিয়ে ইন্টারনেট ব্যবসা করবো না। প্রয়োজনে যে এলাকায় চাঁদা চাওয়া হবে, ওই এলকায় সেবা দেওয়াই বন্ধ করে দেবো।’

আরও পড়ুন: ২০৩০ সাল পর্যন্ত ইন্টারনেটের ঘাটতি হবে না: মোস্তাফা জব্বার

আইএসপিএবি সভাপতি আরও জানান, উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরে ৩৫ জন নিবন্ধিতসহ শতাধিক ইন্টারনেট ও ডিস ব্যবসায়ী রয়েছেন। ওই এলাকার এক হাজারের বেশি বাসায় পাঁচ হাজারের বেশি ব্রডব্যান্ড ও ডিস সংযোগ রয়েছে। সোসাইটির অদ্ভুত চাঁদাবাজিতে তারা ‘দিশেহারা’।

এএএইচ/এমকেআর/এমএস