রাজনীতি

জামায়াতকে পাশে পেয়ে উজ্জীবিত বিএনপি

দীর্ঘদিনের জোটসঙ্গী জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির বেশ কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়েছে। জোট ভাঙার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না থাকলেও দুই দলের নানান কার্যক্রমে এমনটাই আভাস পাওয়া যাচ্ছিল। সরকারবিরোধী আন্দোলনে তারা নিজেদের মতো কর্মসূচি পালন করছিল। চলতি বছরের জুন মাসে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে একটি সমাবেশ করে জামায়াত। ফলে বিএনপির অনেকে সন্দেহ করে সরকারের সঙ্গে তাদের আঁতাত হয়েছে!

Advertisement

রাজনৈতিক মহলে চলে নানা গুঞ্জন। এরপর দেশের আর কোথাও জামায়াতকে সমাবেশের অনুমতি দেয়নি প্রশাসন। এরইমধ্যে গড়ে ওঠে ফ্যাসিবাদবিরোধী একটি সর্বদলীয় ছাত্রঐক্য। ছাত্রদল নেতৃত্বাধীন সেই ছাত্রঐক্যে জায়গা পায়নি ছাত্রশিবির!

অবরোধে তৃণমূল পর্যায়ে বিএনপি

চলমান সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি ও সমমনা জোট পালন করছিল নিজেদের কর্মসূচি। জামায়াতও নিজের মতো করে কর্মসূচি দিয়ে মাঠে ছিল। এরইমধ্যে রাজধানীর শাপলা চত্বরে শিবির ও জামায়াত দুটি পৃথক বিক্ষোভ মিছিল করে বড় শোডাউনে নিজেদের শক্তির মহড়া দেয়।

Advertisement

একদিনের হরতাল; এরপর দেশব্যাপী সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি নেতাকর্মীরা সফলভাবে পালন করেছেন। সাধারণ মানুষও এ কর্মসূচিতে শামিল হয়েছেন। বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের মাঠে থাকার নির্দেশনা রয়েছে। রাজপথে থেকেই আমাদের দাবি আদায় করে ঘরে ফিরবো ইনশাআল্লাহ। —মতিউর রহমান, কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, ছাত্রদল।

এরপর গুঞ্জন ওঠে আন্দোলন-সংগ্রামে জামায়াতকে পাশে চায় বিএনপি। এনিয়ে ভেতরে ভেতরে তৎপরতাও চলছে বলে জানা যায়। তারপরও দৃশ্যমান কোনো কিছু বোঝা যাচ্ছিল না। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপি নয়াপল্টনে মহাসমাবেশের ঘোষণা দিলে জামায়াতও শাপলা চত্বরে মহাসমাবেশের ঘোষণা দেয়। সেদিনের সেই মহাসমাবেশে বিএনপি অনুমতি পেলেও শেষ পর্যন্ত তা পণ্ড হয়। অন্যদিকে আনুষ্ঠানিক অনুমতি ছাড়াই মহাসমাবেশ করে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করে জামায়াত। মূলত ওইদিন থেকেই একযোগে মাঠে নামা শুরু হয় বিএনপি-জামায়াতের। সেদিনের মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার প্রতিবাদে দেশব্যাপী হরতালের ঘোষণা দেয় বিএনপি। জামায়াতও তাৎক্ষণিক হরতালের ঘোষণা দিয়ে মাঠে নামে। এরপর প্রথম দফার টানা অবরোধেও বিএনপি –জামায়াত সক্রিয়ভাবে মাঠে ছিল। দ্বিতীয় দফায়ও নৌ, রেল ও সড়কপথ অবরোধে মাঠে থাকে দুই দল। তাদের সমমনারা মাঠে থাকলেও রাজনৈতিক মহলে আলোচনায় আসে বিএনপি-জামায়াত।

আরও পড়ুন: বিএনপির ‘ভুল’ ভাঙার অপেক্ষায় জামায়াত

সরকারবিরোধী চলমান আন্দোলনে জামায়াতে ইসলামীর যুগপৎ কর্মসূচি থাকায় বেশ উজ্জীবিত বিএনপি নেতাকর্মীরা। বিএনপির তৃণমূলের ধারণা, শুধু সিনিয়র নেতাদের দিয়েই চলমান আন্দোলন হচ্ছে না। এ আন্দোলনে দলমত নির্বিশেষে জনগণের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলেই স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল-অবরোধ পালিত হচ্ছে।

Advertisement

অবরোধে তৃণমূল পর্যায়ে জামায়াত

দলটির নেতারা বলছেন, বিজয় না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে নিয়ে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে যে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলছে তা অব্যাহত থাকবে।

সরকারের তিন মেয়াদের নির্যাতিত মানুষ হরতাল অবরোধ খুবই ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছে। ব্যাপক পুলিশি তৎপরতার পরেও নেতাকর্মীরা মোটামুটি মাঠে ছিল। আগামীর কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা আরও সিরিয়াসলি মাঠে নামবে। বিশেষ করে যাদের নামে অসংখ্য মামলা আছে তারা আর ঘরে বসে থাকবে না। —ইকবাল হোসেন।

যদিও বিএনপি নেতাদের অনেকেই সরাসরি জামায়াতের নাম নেয়নি। তারপরও মাঠের কর্মসূচিতে জামায়াতকে পাশে পেয়ে বেশ উজ্জীবিত বিএনপি নেতাকর্মীরা একথা সহজেই বোঝা যায়।

আরও পড়ুন: কর্মসূচি নিয়ে ‘সাপলুডু’ খেলায় বিএনপি-জামায়াত

জানা গেছে, দীর্ঘদিন বিএনপি থেকে দূরে ছিল জামায়াত। সম্প্রতি বিএনপির চলমান আন্দোলনে সমর্থনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঠে নেমেছে তারা। সে কারণে বিএনপির সঙ্গে সুর মিলিয়ে তারাও কর্মসূচি ঘোষণা করছে। এতে বিএনপি মাঠের শক্তি প্রয়োগেও আস্থাশীল হয়েছে।

জামায়াত-বিএনপির রাজপথের যুগপৎ কর্মসূচিতে ভীতির পরিবেশ তৈরি হওয়ায় চলাচলের ক্ষেত্রে জনসাধারণও সতর্কতা অবলম্বন করছে। এ কারণে গণপরিবহনে যাত্রী অর্ধেকের কম হয়েছে। অন্যদিকে বাস মালিকরাও নানান রকম হিসাব-নিকাশ করেই গাড়ি রাস্তায় বের করতে উৎকণ্ঠায় ভোগেন। সরকার সমর্থিত অন্যতম পরিবহন নেতা হয়েও হরতাল-অবরোধে এনা পরিবহনের মালিকের কোম্পানির এবং তার অ্যাসোসিয়েটের দূরপাল্লার গাড়ি রাস্তায় দেখা যায়নি।

আরও পড়ুন: জামায়াত আমিরের বক্তব্যে বিএনপিতে অস্বস্তি

সম্প্রতি ধর্মভিত্তিক আরেকটি রাজনৈতিক দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ঢাকায় একাধিক সমাবেশ ও মহাসমাবেশ করেছে। সেগুলোতে বিএনপিসহ একাধিক রাজনৈতিক দলের নেতারাও বক্তব্য রেখেছেন।

২৮ অক্টোবর, পণ্ড হওয়ার আগে বিএনপির মহাসমাবেশ

বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর নেতারা মনে করছেন, ইসলামী আন্দোলনও নির্দলীয় নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে পাশে থাকবে।

আরও পড়ুন: তালাবদ্ধ বিএনপি কার্যালয়ের চেয়ারে ইসির সংলাপের চিঠি

এদিকে চলমান আন্দোলনে বিএনপির প্রধান নেতা দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকলেও দলের অন্য নেতারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও প্রকাশ্যে বেশিরভাগ নেতাকর্মীকে মাঠে দেখা যাচ্ছে না। এরপরও হরতাল-অবরোধে ঢাকা শহরের সঙ্গে দেশের অন্য জেলার যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন থাকতে দেখা গেছে। এটাকেই বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীরা সফলতা মনে করছেন।

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মতিউর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, একদিনের হরতাল এবং এরপর দেশব্যাপী সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচি নেতাকর্মীরা সফলভাবে পালন করেছেন। সাধারণ মানুষও এই কর্মসূচিতে শামিল হয়েছেন। বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আমাদের মাঠে থাকার নির্দেশনা রয়েছে। রাজপথে থেকেই আমরা দাবি আদায় করে ঘরে ফিরবো ইনশাআল্লাহ।

দাবি আদায়ে রাজপথে ছিলাম, আছি। জুলুম-নির্যাতন, মিথ্যা মামলা-হামলা, গ্রেফতার করে এদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন নস্যাৎ করা যাবে না। বিএনপির আর পেছনে ফেরার সময় নেই। গ্রেফতার করে, হুলিয়া দিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। দেশের সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এবং জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ। —ড. আব্দুল মঈন খান।

জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. নাজমুল হাসান বলেন, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থনে হরতাল এবং অবরোধ কর্মসূচি সফল হচ্ছে। কর্মসূচি সফল হওয়ার কারণে নেতাকর্মীরা উজ্জীবিত ।

আরও পড়ুন: চট্টগ্রামে বিএনপির রোববারের হরতালে সমর্থন দিল জামায়াত সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার সীমান্তবর্তী সোনাবাড়িয়া ইউনিয়নের বিএনপি সমর্থিত সাবেক চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম বলেন, মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিএনপির কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। পুলিশ নেতাকর্মীদের বাড়িতে গিয়ে তল্লাশি চালানোসহ বিভিন্ন ধরনের ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করছে। তারপরও নেতাকর্মীরা মাঠে। আগামীতে সব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে কর্মসূচিতে ব্যাপকভাবে নেতাকর্মীরা নামবে বলে আশাবাদী তিনি।

২৮ অক্টোবর আনুষ্ঠানিক অনুমতি ছাড়াই জামায়াতের মহাসমাবেশ

যশোরের মনিরামপুর উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক সাবেক পৌর মেয়র অ্যাডভোকেট শহীদ ইকবাল হোসেন বলেন, সরকারের তিন মেয়াদের নির্যাতিত মানুষ হরতাল অবরোধকে খুবই ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছে। ব্যাপক পুলিশি তৎপরতার পরেও নেতাকর্মীরা মোটামুটি মাঠে ছিল। আগামীর কর্মসূচিতে নেতাকর্মীরা আরও সিরিয়াসলি মাঠে নামবে। বিশেষ করে যাদের নামে অসংখ্য মামলা আছে তারা আর ঘরে বসে থাকবে না।

আরও পড়ুন: সরকারের পতন ঘটলেও বিএনপি ক্ষমতায় আসবে না

কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি মো. শরিফুল আলম বলেন, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল অবরোধ কর্মসূচি সফল করছে। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিজয় অর্জন ছাড়া তারা ঘরে ফিরবে না।

চলমান আন্দোলনে আমাদের সমর্থন রয়েছে। আমরাও রাজপথে আছি। ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্রঐক্যের আন্দোলনে আরও ভূমিকা রাখা দরকার।—ডা. সাদিক আবদুল্লাহ, কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক, ছাত্রশিবির।

খুলনা বিভাগীয় সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জয়ন্ত কুমার কুন্ডু বলেন, জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে কর্মসূচি শতভাগ সফল হয়েছে। আগামীতেও দাবি আদায়ে যে কোনো কর্মসূচি সফল করে বিজয় অর্জন করবো।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, বিএনপির প্রতিটি কর্মীই নেতার ভূমিকা পালন করে এ আন্দোলনে সফলতা আনবে। আমরা আমাদের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে অটল। দাবি আদায়ে রাজপথে ছিলাম, আছি। জুলুম-নির্যাতন, মিথ্যা মামলা-হামলা, গ্রেফতার করে এদেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন নস্যাৎ করা যাবে না। বিএনপির পেছনে ফেরার সময় নেই। গ্রেফতার করে, হুলিয়া দিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করার কোনো সুযোগ নেই। দেশের সব গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল এবং জনগণ আজ ঐক্যবদ্ধ।

অবরোধে দেশের বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে তালা দেয় ছাত্রদল

তিনি বলেন, সরকার আমাদের দাবি আদায়ের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিগুলোতে উসকানি দিয়ে বিরোধীদলের ওপর দোষ চাপানোর ফন্দি নিয়েছে। এসব ধাপ্পাবাজি দিয়ে এবার দেশে-বিদেশে কাউকে আর বিভ্রান্ত করা যাবে না।

সরকার পতনের এক দফা দাবিতে যে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চলছে তা অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।

এ বিষয়ে জামায়াতের ঢাকা মহানগরী উত্তরের প্রচার সম্পাদক আতাউর রহমান সরকার বলেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দেশপ্রেমের নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে অতীতের মতো এখনও ভূমিকা রেখে চলেছে। এখানে কেউ খুশি, বেজার বিষয় নয়।

ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ডা. সাদিক আবদুল্লাহ বলেন, চলমান আন্দোলনে আমাদের সমর্থন রয়েছে। আমরাও রাজপথে আছি। এই আন্দোলনে ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্রঐক্যের আরও ভূমিকা রাখা দরকার।

কেএইচ/এসএইচএস/এমএস