মতামত

প্রসঙ্গ দুইমন্ত্রীর পদত্যাগ : নৈতিক না রাজনৈতিক?

খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের মন্ত্রিত্বের বৈধতা বা নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সবাই। কেউ কেউ বলছেন এটা সম্পূর্ণই তাদের ব্যক্তিগত ব্যাপার। বাংলাদেশের বাস্তবতায় আসলে এটা প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার। এবং সম্পূর্ণ বিষয়টাই রাজনৈতিক। আদালত অবমাননার দায়ে তারা সর্বোচ্চ আদালত কর্তৃক দণ্ডিত। এবং এটা ফৌজদারি অপরাধ। যেহেতু এদেশে সংবিধান বা আইনকানুনে ছোটখাট দণ্ডের দায়ে বা আদালত অবমাননার দায়ে মন্ত্রী চাকরি হারাবেন কিনা তা বলা নেই, তাই সমাজের একটি অংশ নৈতিকতার বিষয় বলে মন্ত্রী দুজনকে সরে যেতে বলছেন। যেহেতু নৈতিকতা মাপার কোনো নিক্তি নেই তাই এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার বলেও মত দিচ্ছেন কেউ কেউ। মন্ত্রীদ্বয় কিভাবে আদালত অবমাননা করলেন? পূর্ণাঙ্গ রায় ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত এটার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া না গেলেও ধরেই নেয়া যায় তারা যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতে যেসব কথা বলেছেন সেই সব কথায় আদালতের কার্যক্রমে হস্তক্ষেপ বা আদালতের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করেছেন। এখানে অপরাধটা হলো মন্ত্রীরা কথাবার্তায় মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। যদি তারা মাত্রা রেখে কথা বলতেন তাহলে আদালতের অবমাননা হতো না। এখন প্রশ্ন হলো যেসব মন্ত্রী মাত্রা রেখে কথা বলতে পারেন না তারা কি মন্ত্রিসভায় থাকতে পারেন? এই হিসেব করলে কতোজন মন্ত্রী যে পদ হারাবেন তা সহজেই নাগরিক সমাজ অনুমান করতে পারে।দ্বিতীয়ত অন্যসব মন্ত্রীরা মাত্রাজ্ঞান হারালেও আদালতের ব্যাপারে সতর্ক থাকেন, তাই তাদের নৈতিকতা বা শপথ ভঙ্গের অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হয় না। বিষয়টি দাঁড়ালো একজন মন্ত্রী প্রতিপক্ষকে যা-তা ভাষায় গালি গালাজ করতে পারবেন, আদালত কর্তৃক দণ্ডিত হননি এমন নেতা বা নেতাদের দুর্নীতিবাজ বলবেন, জনগণের ধারণায় দুর্নীতিবাজ হিসেবে চিহ্নিত হবেন, একজন মন্ত্রী পঁচা গম আমদানি করে জনস্বার্থ বিরোধী কাজ করতে পারবেন, একজন মন্ত্রী দেশের রিজার্ভ অর্থ সম্পদ রক্ষা করতে পারবেন না, একজন মন্ত্রী নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারবেন না, এমন অনেক কিছুই করতে না পারার কারণে কোনো মন্ত্রীর পদে থাকার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে না। প্রশ্ন উঠলো কখন যখন তারা শুধু আদালতের ব্যাপারে মাত্রাজ্ঞান রেখে কথা বলতে ব্যর্থ হয়েছেন। হতে পারে এটা একটা অযোগ্যতা তবে জনগণের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থতার চেয়ে এটা কি বড় অযোগ্যতা?যে দেশে ব্যর্থতার জন্য ব্যাক্তিগত দায় নিয়ে পদত্যাগ করার নজির খুঁজে পাওয়া যায় না, যে দেশে পদত্যাগের সংস্কৃতিই চালু হয়নি বরং পদ ধরে রাখার জন্য নানা উপায় বের করার সংস্কৃতি বিদ্যমান, সেদেশে নৈতিকতার প্রশ্নে ওই দুই মন্ত্রীর পদত্যাগের আশা করা বা দাবি জানানো উলুবনে মুক্তো ছড়ানোই মনে হবে। এছাড়া মন্ত্রী হতে হলে প্রধানমন্ত্রীর কৃপাই যেখানে একমাত্র যোগ্যতা সেখানে প্রধানমন্ত্রী যতোদিন অসন্তুষ্ট না হবেন ততোদিন তারা মন্ত্রীগিরি করে যাবেন। এখন প্রশ্ন হলো দেশের সর্বোচ্চ আদালত যেখানে অসন্তুষ্ট হয়েছে সেখানে প্রধানমন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়া দেখাবেন কবে?আপিল বিভাগের ওই রায়ের মধ্য দিয়ে হয়তো সমাজে বা রাষ্ট্রে একটা বার্তা পৌঁছানো গেছে যে আদালত নিয়ে কথা বলার আগে বেশ কয়বার ভেবে নিও, যতো বড় ক্ষমতাশালীই হও না কেন আদালতের মর্যাদা নিয়ে টানাটানি করো না। আদালত তার মর্যাদা রক্ষায় যথাযথ ভূমিকা রাখতে ভুল করবে না। গত কয়েকদিন বা কয়েক মাস ধরে আদালত নিয়ে নানাজনের নানা মন্তব্যে এই রকম একটা আদেশের দরকার ছিল বৈকি। কিন্তু প্রশ্ন হলো জনগণের মর্যাদা নিয়ে টানাটানি করলে অথবা জনগণের মর্যাদা না দিলে মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কী উপায় আছে? জবাব একটা হতে পারে ভোট। ভোটের মাধ্যমে জনগণ সেটির জবাব দিয়ে দিবে? কিন্তু ভোট দেয়ার সুযোগই যদি জনগণ না পায় তাহলে কি হবে? তাহলে হতে পারে আন্দোলন। আবার আন্দোলন করেই বা জনগণ কী পায়। এত সব প্রশ্নের জবাব একটাই- জনগণের এতো প্রশ্ন করতে নেই। জনগণের জন্য কোনো ব্যবস্থাই নেই। মন্ত্রীরা আদালত নিয়ে বাজে কথা বলবেন তো আদালত শাস্তি দিবে, আমলাতন্ত্র নিয়ে কথা বলবেন তো তারা সাতঘাটের পানি খাইয়ে ছেড়ে দিবে, অর্থাৎ বিচার বিভাগ কিংবা নির্বাহী বিভাগ সব জায়গায় মন্ত্রীদের ধরার একটা ব্যবস্থা আছে, ব্যবস্থা নেই শুধু জনগণের কাছে ধরা দেওয়ার। কিন্তু জনতা নিশ্চয়ই তাদের কোনো না কোনোভাবে একদিন ধরবে। কিন্তু কবে?এইচআর/এমএস

Advertisement