ফ্রিল্যান্সিং বা আউটসোর্সিং পেশাকে একটা সময় অনেকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মনে করতেন। তবে সময় যত পেরিয়েছে ততই বিকশিত হচ্ছে এ পেশা। এক সময় বড় শহরগুলোতে ফ্রিল্যান্সিং বেশি দেখা যেতো। তবে এখন ধারণা বদলেছে মানুষের। বর্তমানে ছোট ছোট শহর এমনকি গ্রামগঞ্জেও ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা বাড়ছে প্রতিনিয়িত। বিশেষ করে শিক্ষিত বেকার যুবকরা এ পেশায় যুক্ত হচ্ছেন বেশি। পাশাপাশি বয়স্করাও অন্য কাজের পাশাপাশি ফ্রিল্যান্সিং করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
Advertisement
উত্তরের সীমান্তবর্তী জেলা জয়পুরহাট। ছোট এ জেলাটি মূলত কৃষিনির্ভর। কয়েক বছর আগেও এ জেলায় ফ্রিল্যান্সিং করতেন হাতেগোনা কয়েকজন। তবে সময়ের সঙ্গে ফ্রিল্যান্সিংয়ে আগ্রহ বৃদ্ধিসহ আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশি ফ্রিল্যান্সারদের কাজের চাহিদা থাকায় বর্তমানে জেলায় এক হাজারেরও বেশি তরুণ-তরুণী ফ্রিল্যান্সিংয়ের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত রয়েছেন। ফ্রিল্যান্সিংয়ে যারা কাজ করছেন তারা অধিকাংশই শিক্ষিত বেকার। পাশাপাশি বয়স্করাও যুক্ত হচ্ছেন এ পেশায়।
তরুণ-তরুণীরা চাকরির পেছনে না ছুটে কেউবা চাকরি না পেয়ে এ পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। এতে সাধারণ যেকোনো চাকরির চেয়ে মাসে বেশি ইনকাম করছেন তারা। এতে নিজের বেকারত্ব দূর, দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখার পাশাপাশি পরিবারে স্বচ্ছলতা আনছেন তারা। সঠিক প্রশিক্ষণ ও প্রয়োজনীয় সহায়তা পেলে জেলার ফ্রিল্যান্সাররা এ খাতকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন বলে মনে করছেন জয়পুরহাটবাসী।
এদিকে সম্ভবনা বাড়ায় জেলায় ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা বাড়াতে বেসরকারিভাবে কয়েকটি ট্রেনিং সেন্টার খোলা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের আওতাধীন লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রজেক্টের আওতায় সরকারিভাবে জেলার ৬০০ জনকে ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তাদের মধ্যে ভালো করায় ৪৬ জনকে ল্যাপটপ উপহার দেওয়া হয়েছে। কাজ শিখে এদের মধ্যে অনেকেই অনলাইন থেকে আয় শুরু করেছেন।
Advertisement
জানা গেছে, ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণের বিভিন্ন ধাপ রয়েছে। যেমন ওয়েব ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডাটা এন্ট্রি, ওয়েব ডিজাইন, এসইও, ইউটিউব মার্কেটিং, ফেসবুক মার্কেটিং, ইমেইল মার্কেটিং ইত্যাদি। আগে নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ের ওপর কাজ শিখতে হয়, তারপর মার্কেটপ্লেসে নিজের একাউন্ট তৈরি করতে হয়।
বর্তমান মার্কেটপ্লেসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য আপওয়ার্ক, ফাইবার, ফ্রিল্যান্সার, গুরু ইত্যাদি। এসব মার্কেটে একাউন্ট করার পর নির্দিষ্ট ক্যাটাগরিতে কাজের জন্য বিড করতে হয়। এরপর বায়ার নির্ধারিত মূল্যে সেই কাজটি ফ্রিল্যান্সারকে দেয়। কাজ শেষে আবার সেটি বায়ারকে বুঝিয়ে দিতে হয়। তখন বায়ার মার্কেটপ্লেসের একাউন্টে কাজের মূল্য হিসেবে ডলার পরিশোধ করে। এরপর সেখান থেকে ডলার ব্যাংকে ট্রান্সফার করলে টাকায় রূপান্তর হয়।
বর্তমানে জয়পুরহাট জেলায় আপওয়ার্ক ও ফাইবার মার্কেটপ্লেসে বেশি কাজ করছেন ফ্রিল্যান্সাররা। ফাইবারে কাজের গিগ (নমুনা) তৈরি করে রাখতে হয়। সেখানে গিগ দেখে ফ্রিলান্সারদের কাছ থেকে কাজ করিয়ে নেন বায়াররা।
সদর উপজেলার কোমগ্রামের গোলাম কিবরিয়া শ্রাবণ স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন জয়পুরহাট সরকারি কলেজ থেকে। এরপর বেশ কিছুদিন ঘুরেছেন চাকরির পেছনে। তবে মনমতো চাকরি না পাওয়ায় তিনি ফ্রিল্যান্সিং শুরু করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
Advertisement
গোলাম কিবরিয়া শ্রাবণ জাগো নিউজকে বলেন, ফেসবুকে এক পোস্টের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিং শেখার বিষয়টি জানতে পারি। এরপর থেকে আমার আগ্রহ হয় এটি শেখার জন্য। ডিসি অফিস থেকে ট্রেনিংয়ে অনেকগুলো কাজ আমাদের শেখানো হয়েছে। আমি বর্তমানে ফাইবারে গ্রাফিক্স ডিজাইন নিয়ে কাজ করি। প্রতিমাসে ১০০ থেকে ৫০০ ডলার পর্যন্ত আয় হয়। এ থেকে আমার সংসার ভালোভাবে চলছে। গতমাসে একটি মোটরসাইকেলও কিনেছি এখানকার আয়ের টাকা দিয়ে।
ফ্রিল্যান্সিংকে নিজের পেশা হিসেবে নিয়েছেন হাজী মাদরাসা রোডের মঞ্জুরুল আলম টুটুল। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, আমি নওগাঁ পলিটেকনিক থেকে ডিপ্লোমা করেছি। পাশাপাশি নিজেকে স্বাবলম্বী করতে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি। এজন্য ডিসি অফিস থেকে দুই মাসের ২০০ ঘণ্টার একটি ট্রেনিং করি। এরপর নিজে নিজেই কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করি। আমার এখন প্রতিমাসে ৫০ হাজার থেকে ৮০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে। এর পাশাপাশি আমি যুব উন্নয়ন অধিপ্তরের ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছি।
শহরের বাটার মোড় এলাকার মিলন হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, সরকার থেকে প্রথমে ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিই। এরপর অনলাইনে আয় করার চেষ্টা শুরু করি। প্রায় এক বছর কষ্ট করার পর আমার প্রথম ১৫ ডলার আয় হয়। এরপর থেকেই শুরু, সেই মাসেই ওয়েব ডিজাইন, ডাটা এন্ট্রির কাজ করে ৬০ হাজার টাকা আয় হয়। সর্বোচ্চ এক মাসে সাড়ে ৬ লাখ টাকা আয় করেছি। বর্তমানে প্রতিমাসে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা আয় হচ্ছে। এটি অনেক সম্ভবনাময় একটি পেশা। শিক্ষিত বেকার যুবকরা এ পেশায় এসে নিজেকে স্বাবলম্বী করে তুলতে পারেন।
শহরের জানিয়ার বাগান এলাকার এরেনা আইটি অ্যান্ড সফটওয়্যারের সিইও গোলাম রাশেদুন নবী সোহেল ফ্রিল্যান্সিংয়ে সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে জাগো নিউজকে বলেন, এক সময় ফ্রিল্যান্সিংকে অনেকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য মনে করতো। কিন্তু এখন অনেকেই এটি শেখার জন্য আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আমি প্রথমে সরকারের আইসিটি বিভাগ থেকে ফ্রিল্যান্সিংয়ের ওপর একটি প্রশিক্ষণ নিই। এরপর যখন ভালো ইনকাম করা শুরু করি তখন নিজেই একটি ট্রেনিং সেন্টার খুলি। সেখানে গ্রাফিক্স ডিজাইন, ডিজিটাল মার্কেটিং, ওয়েব ডিজাইনসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ১০০ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এর মধ্যে ৪০-৫০ জন এখন আয় করে নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এ খাতকে আরও এগিয়ে নিতে সরকারের প্রকল্পগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে বর্তমানে অনেক ফ্রিল্যান্সার কাজ না করেই প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। এক্ষেত্রে দক্ষ ফ্রিল্যান্সারদের দিয়েই প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তারা নিজেদের আয়ের চেয়ে সরকারি প্রশিক্ষণে কম পারিশ্রমিক পান বলেই আগ্রহী হন না। সেজন্য তাদের পারিশ্রমিক বাড়াতে হবে। এতে করে নতুনরা ভালোভাবে শিখে আয় করতে পারবেন।
জেলা প্রশাসক সালেহীন তানভীর গাজী বলেন, কয়েক বছর আগেও ফ্রিল্যান্সিংয়ে মানুষের তেমন একটা আগ্রহ দেখা যেত না। এজন্য আমরা সরকারের তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগ থেকে ফ্রিল্যান্সারদের প্রশিক্ষণ নিয়ে একটি প্রকল্প পরিচালনা করেছি। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত এ প্রকল্পের আওতায় জেলায় ৬০০ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণে যারা ভালো করেছে প্রণোদনা হিসেবে তাদের মধ্যে ৪৬ জনকে ল্যাপটপ উপহার দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, এখান থেকে কাজ শিখে অনেকে আয় করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। আবার অনেকে বেরসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। বর্তমান সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে এখন অনেকেই অনলাইনে ঘরে বসে অর্থ উপার্জন করতে পারছেন। ফলে অনেকের আগ্রহের জায়গা এখন আউটসোর্সিং।
তিনি আরও বলেন, ফ্রিল্যান্সারদের সংখ্যা আরও বাড়াতে জেলার কালাই উপজেলায় আইসিটি অধিদপ্তর থেকে শেখ কামাল আইটি ট্রেনিং সেন্টার খোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটি চালু হলে যে কেউ সহজেই ফ্রিল্যান্সিং শিখতে পারবেন এবং বেকারদের আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
এফএ/এমএস