সমাজে প্রচলিত একটি বিষয় যে প্রতিবন্ধী মানেই বোঝা। তবে এটিকে মিথ্যা প্রমাণিত করেছেন মাদারীপুর সদর উপজেলার বিসিক এলাকার মৃত হারুন ঢালীর ছেলে খলিলুর রহমান ঢালী খলিল (৪২)। জন্মান্ধ না হলেও ছোটবেলায় খেলতে গিয়ে আঘাত পেয়ে হারান দুটি চোখই। এরপর থেকেই শুরু হয় তার জীবন সংগ্রাম। সবার কাছে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য ও বোঝা হয়ে বাঁচতে চাননি তিনি। শুরু করেন নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা। প্রশিক্ষণ নেন নানা কাজের। মিলেছেও অনেক সার্টিফিকেট। টুঙ্গি ও গাজীপুর থেকে কুটির শিল্প, মিরপুরে ভোকেশনাল ইনস্টিউটশন থেকে চক ও পেনসিল তৈরি, মাদারীপুর বিসিক থেকে চকলেট তৈরিসহ মাদারীপুর সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে অনেকগুলো প্রশিক্ষণ নেন তিনি। যখন যে কাজ পেয়েছেন সে কাজ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছেন জীবন যুদ্ধে হার না মানা এই সৈনিক।
Advertisement
আরও পড়ুন: ঐতিহ্য হারাতে বসেছে রাজারাম মন্দির
অবশেষে তিনি পেশা হিসেবে বেছে নেন মাইকিংয়ের কাজ। প্রায় ২০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি মাইকিং করেই জীবিকা নির্বাহ করেছেন। একবার শুনেই তার মুখস্থ হয়ে যায় মাইকিংয়ের বিষয়বস্তু। প্রথমদিকে তাকে কেউ কাজ দিতে চাইতেন না। তবে এখন তার উচ্চারণ ও উপস্থাপন সুন্দর হওয়ায় মাইকিংয়ের জন্য আগে থেকেই তাকে অগ্রিম টাকা দিয়ে বুকিং করে রাখেন অনেকে। মাইকিংয়ের কাজের জন্য সবার প্রিয় হয়ে উঠেন খলিল। লোকের মুখে খলিল ঢালী নামের সঙ্গে যুক্ত হয় মাইকিং খলিল।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, খলিলুর রহমান ঢালী খলিল বর্তমানে পরিবার নিয়ে শহরের রকেট বিড়ি এলাকায় ভাড়া থাকেন। তার পরিবারে রয়েছে দুই মেয়ে, স্ত্রী ও মা। বড় মেয়ে তানজিয়া আক্তার ফাতেমা পড়েন ডনোভান সরকারি উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণিতে। ছোট মেয়ে জান্নাত (২)। দুই সন্তানকে পড়াশুনা করে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চান তিনি। এছাড়া স্ত্রী ও বৃদ্ধা মা মালঞ্চ বিবিকে তিনিই দেখাশুনা করেন।
Advertisement
আরও পড়ুন: মহাসড়কের পাশে-সড়ক বিভাজনে বসে সুপারির হাট, ভোগান্তি চরমে
আরও জানা যায়, প্রথমদিকে রিকশা ভাড়া করে মাইকিং করতেন তিনি। পরে টাকা জমিয়ে নিজেই একটি ব্যাটারিচালিত রিকশা কিনেন। সেই রিকশা চালান তার সহযোগী মাদারীপুর সদর উপজেলার মাদ্রা গ্রামের মো. রেজাউল হাওলাদার (৪০)। তিনি বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে রিকশা চালান আর খলিল মাইকিং করেন। এতে মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো আয় হয় তার।
খলিলুর রহমান ঢালী খলিল বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করলেও এখন আমার পেশা মাইকিং করা। যে কথাগুলো মাইকিং করতে হবে তা একবার পড়ে বুঝালেই আমার মুখস্থ হয়ে যায়। আমার একজন সহযোগী আছে। সে রিকশা চালায় আর আমি মাইকিং করি। মাইকিং করার সময় লোকে যখন মাইকিং খলিল ভাই বলে ডাকে তখন আমার খুব ভালো লাগে। সবচেয়ে বড় কথা অন্ধ হয়েও সমাজ বা সংসারের বোঝা হতে হয়নি, এটাই আমার বড় প্রাপ্তি। আমি অন্য প্রতিবন্ধীদেরও বলবো নিজের মনোবল নিয়ে এগিয়ে গেলে, কাজ করলে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব।
আরও পড়ুন: চিকিৎসক দম্পতির ছাদ যেন বনসাইয়ের রাজ্য
Advertisement
মাদারীপুরের সচেতন নাগরিক কমিটির সদস্য এনায়েত হোসেন নান্নু বলেন, পুরাণ বাজারের ব্যবসা সংক্রান্ত ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের যে কোনো বিষয় মাইকিং করার জন্য আমরা খলিল ঢালীকেই বেছে নেই। তার উচ্চারণ ও উপস্থাপন অনেক সুন্দর। একবার শুনেই মুখস্থ বলতে পারেন। এই কারণে সে কাজও বেশি পায়। মাদারীপুরের অনেকেই তাকে মাইকিং খলিল বলে ডাকেন।
মাদারীপুর জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, খলিল ঢালী প্রতিবন্ধী হয়েও কাজ করছেন। এটা খুব ভালো। তবে সমাজসেবা থেকে তাকে প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে। দেখতে না পেয়েও যে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা যায়, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছেন এই খলিল ঢালী।
আরও পড়ুন: ফরিদপুরে মুড়িকাটা পেঁয়াজ চাষে ব্যস্ত চাষিরা
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মাইনউদ্দিন বলেন, চোখে দেখতে না পেয়েও খলিল ঢালী মাইকিংয়ের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। এটা খুবই ভালো। তাছাড়া প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিংয়ের কোনো কাজ থাকলে তাকে দেওয়া হয়।
আয়শা সিদ্দিকা আকাশী/জেএস/জিকেএস