ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। অর্থনীতিবিদ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর। অধ্যাপনা করছেন বেসরকারি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। রাজনীতির চলমান পরিস্থিতি ও অর্থনীতিতে এর প্রভাব নিয়ে মতামত ব্যক্ত করেন জাগো নিউজের কাছে। রাজনৈতিক সংকট চলতে থাকলে দেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে বলে অভিমত তার। মতামত নিয়ে লিখছেন সায়েম সাবু।
Advertisement
জাগো নিউজ: রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই মূলত অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন মানুষ। আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: রাজনীতি শুধু অর্থনীতিকেই প্রভাবিত করে না, রাজনীতি দ্বারা সব কিছুই নিয়ন্ত্রিত। রাজনৈতিক জবাবদিহিতা না থাকলে সবকিছুই ভেঙে পড়ে। রাষ্ট্র, সমাজে কোনো কিছুই আর স্বাভাবিকভাবে চলে না।
হরতাল-অবরোধ কোনোভাবেই সমাধানের পথ নয়। তবে সরকার যে অবস্থান নিয়েছে সেটাও কোনো সমাধান দেবে বলে মনে করি না। সমাঝোতার দরকার। জবাবদিহিতা দরকার। এভাবে চলতে থাকলে সংকট নিরসন করা এক সময় সম্ভব হবে না।
Advertisement
সরকার উন্নয়ন করছে। উন্নয়ন সবাই চায়। কিন্তু জবাবদিহি ছাড়া উন্নয়ন সবার কল্যাণে আসে না। দেশে ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে বলে বলা হচ্ছে। কিন্তু বৈষম্য বাড়ছে কেন? দরিদ্রের হার বাড়ছে কেন? মানুষের মধ্যে এত হতাশা কেন? প্রবৃদ্ধি বাড়লেই তাকে আমরা প্রকৃত উন্নয়ন বলতে পারি না। উন্নয়নের সুবিধা কত সংখ্যক মানুষ পাচ্ছে তা আগে বিবেচনায় আনতে হবে।
আরও পড়ুন>>‘শেখ হাসিনা সরকার উৎখাত হলে রাজনৈতিকভাবেই মূল্য দিতে হবে’
বলা হচ্ছে, সরকার ব্যবসাবান্ধব। ব্যবসার সুবিধাটা কে পাচ্ছে? মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাচ্ছে কেন? বেতন বাড়ানোর জন্য শ্রমিকরা রাস্তায় নামছে কেন? মরছে কেন? উন্নয়নের সুবিধা তো তাদেরও পাওয়ার কথা। মূলত জবাবদিহিতা না থাকার কারণেই এ বৈষম্য।
চলমান রাজনৈতিক সংকট মানুষের মধ্যে উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলছে। কী হবে সামনে এমন এক অনিশ্চয়তায় কাটছে সময়। কাঠামোগত উন্নয়ন দেখে সাধারণ মানুষ কোনোভাবেই আশ্বস্ত হতে পারছে না। বরং বাজারে গিয়ে যখন সে ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে, তখন সে দিশেহারা হয়ে পড়ছে।
Advertisement
জাগো নিউজ: সরকার কিন্তু কাঠামোগত উন্নয়নে ভর করেই বাহবা নিতে চাইছে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: উন্নয়নের ন্যারিটিভ সরকার দিচ্ছে। অর্থনীতিবিদ, গবেষকরা বারবার এ ন্যারিটিভগুলোর (ধারণা) সমালোচনা করে আসছে। এ ধারণাকে ভাঙতে হবে। সরকারের উন্নয়ন সার্বিক উন্নয়ন নয়।
আরও পড়ুন>>‘বাংলাদেশ একটি সন্ধিক্ষণে আছে এতে কোনো সন্দেহ নেই’
আপনি দেখেন বিশাল বিশাল হাসপাতাল করছে। সেখানে যন্ত্রপাতি নেই। ভালো ডাক্তার নেই। মন্ত্রী, আমলারা সামান্য অসুস্থ হলেই বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বড় বড় ভবন হচ্ছে। অথচ ভালো শিক্ষক নেই। গবেষণা নেই। তাহলে এ উন্নয়নের মানে কী? সরকার জ্বালানিখাতে বিনিয়োগ করলো। রেন্টাল-কুইক রেন্টাল নিয়ে এখন কী হচ্ছে? কত টাকা গচ্চা গেলো এর হিসাবও তো রাখতে হবে।
বিরোধী জোট যেভাবে হরতাল-অবরোধ ডাকছে তাতেও মানুষ শঙ্কিত। তবে এবার একতরফা নির্বাচন হলে সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। কারণ একইভাবে আবার ক্ষমতায় এলে জবাবদিহি বলতে কিছুই আর থাকবে না।
জাগো নিউজ: এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি তথা হরতাল-অবরোধের সংস্কৃতি দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: হরতাল-অবরোধ কোনোভাবেই সমাধানের পথ নয়। তবে সরকার যে অবস্থান নিয়েছে সেটাও কোনো সমাধান দেবে বলে মনে করি না। সমাঝোতার দরকার। জবাবদিহিতা দরকার। এভাবে চলতে থাকলে সংকট নিরসন করা এক সময় সম্ভব হবে না।
সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে আমাদের টেকসই অবস্থানে আসা দরকার। ক্ষমতায় কে এলো আর কে গেলো সেটা বিষয় নয়। এ কাঠামো থাকলে ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও কোলো লাভ হবে না। প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো পরিবর্তন করতে হলে রাজনীতির আমূল পরিবর্তন দরকার।
আরও পড়ুন>>রাজনৈতিক নবায়ন অপরিহার্য হয়ে পড়ছে
জাগো নিউজ: সে পরিবর্তন আশা করার মতো কোনো উপাদান দেখছেন?ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এই রাজনীতি কোনোভাবেই জনকল্যাণমুখী নয়। এর দায় সবার। তবে সরকারের দায় সবার আগে। আগের দুটি নির্বাচনের মতো সরকার যেভাবে ঘোষণা দিয়ে আসছে তাতে সংঘাত আরও বাড়বে। অন্যদিকে বিরোধী জোট যেভাবে হরতাল-অবরোধ ডাকছে তাতেও মানুষ শঙ্কিত। তবে এবার একতরফা নির্বাচন হলে সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। কারণ একইভাবে আবার ক্ষমতায় এলে জবাবদিহি বলতে কিছু্ই আর থাকবে না।
জাগো নিউজ: কিন্তু নির্বাচনের তো কোনো বিকল্প নেই এবং নির্বাচনের আয়োজন করা তো সরকারের দায়?ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: বাংলাদেশের শতকরা ৯০ শতাংশ মানুষ ভোট দিতে চায়। ভোটের রাজনীতি এদেশের মানুষের রক্তে মিশে আছে। মানুষ ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। কিন্তু ভোট দেওয়ার তো পরিবেশ পায় না। ভোটের সংস্কৃতি কোনো না কোনোভাবে নষ্ট হয়ে গেলে এর দায় রাজনীতিক দলগুলোকে নিতে হবে।
জাগো নিউজ: ক্ষমতায় টিকে থাকার স্বার্থে সরকার আরও আগ্রাসী হতে পারে কি না? আপনার কী মনে হয়? দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ গণতন্ত্র ছাড়াই তো এগিয়ে যাচ্ছে। সরকারের অনেকে এমন উদাহরণ দিয়ে আসছে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এ উদাহরণগুলো খারাপ। চীনকে আপনি কল্যাণকামী রাষ্ট্র বলতে পারেন না। চীন, রাশিয়ায়ও জবাবদিহিতা নেই। ফিলিপাইন ভেঙে পড়েছে। জনগণ মতামত ব্যক্ত করতে পারে না। শ্রীলঙ্কার অবস্থা দেখেন। এমন একটি রাষ্ট্র ব্যর্থ হবে কেউ তো ভাবতে পারেনি। পাকিস্তানের অবস্থান দেখেন। এর মধ্য থেকে বাংলাদেশকে আপনি আলাদা করে দেখতে পারেন না।
কোনো নিষেধাজ্ঞাই বাংলাদেশের মানুষের জন্য মঙ্গলজনক নয়। পোশাকখাত বন্ধ হয়ে গেলে গোটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধস নামাবে। এটি রাজনীতিবিদদের সবার আগে বুঝতে হবে। আমার টিকে থাকার মধ্য দিয়ে দেশকে বিপদে ফেলতে পারি না।
জাগো নিউজ: এই পরিস্থিতি অন্য কোনো শক্তি বা চরমপন্থার… ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: সব কিছু তো অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। সরকার তো চেষ্টা করলো সামলানোর। ফের সংঘাতে ফিরছে রাজনীতি। এভাবে চলতে থাকলে অন্যরা সুযোগ নিতেই পারে।
জাগো নিউজ: যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: কোনো নিষেধাজ্ঞাই বাংলাদেশের মানুষের জন্য মঙ্গলজনক নয়। পোশাকখাত বন্ধ হয়ে গেলে গোটা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ধস নামাবে। এটি রাজনীতিবিদদের সবার আগে বুঝতে হবে। আমার টিকে থাকার মধ্য দিয়ে দেশকে বিপদে ফেলতে পারি না। জনগণের ক্ষমতায়ন জরুরি। পরোয়া করি না এই মানসিকতাই সংকটের মূল। নির্বাচনকালীন সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বড় কথা নয়। জনগণ যেভাবে ভোট দিতে পারবে তা নিশ্চিত করতে হবে। দলীয় সরকারগুলো তাতে ব্যর্থ হয়েছে।
জাগো নিউজ: সম্প্রতি পোশাক শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতনের দাবিতে যে আন্দোলন, তা নিয়ে কী বলবেন?
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: এ আন্দোলন অবশ্যই যৌক্তিক। বেতন না বাড়লে শ্রমিকরা চলে কীভাবে। সব পণ্যের দাম বেড়েছে। বেতন না বাড়াতে পারলে কারখানা বন্ধ রাখুক। যারা বেতন দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন, তারা কারখানা চালু রাখবেন।
এএসএস/এএসএ/জিকেএস