খেলাধুলা

বাংলাদেশের সঙ্গে এক হয়ে কাজ করতে চাই : অভিষেক ডালমিয়া

অভিষেক ডালমিয়া। যার বাবা আইসিসির সাবেক প্রেসিডেন্ট এবং ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডের দু’বারের নির্বাচিত সভাপতি জগমোহন ডালমিয়া। তার পরিচিতি অবশ্য বাংলাদেশের কাছে একটু ভিন্ন। বাংলাদেশের ক্রিকেটের অকৃত্রিম বন্ধু তিনি।

Advertisement

বাংলাদেশের ক্রিকেট যে আজ এই পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তা শুধুমাত্র ‘জগু দাদা’র কারণেই। তিনি আইসিসি প্রেসিডেন্ট থাকার কারণেই ২০০০ সালে টেস্ট স্ট্যাটাসটা পেয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। এ দেশের ক্রিকেটে তার অবদান অনস্বীকার্য।বাংলাদেশের ক্রিকেটে অকৃত্রিম বন্ধু সেই জগু দাদা (জগমোহন ডালমিয়া) পৃথিবী থেকে চলে গেছে গত বছর। হঠাৎই মারা যান তিনি। তবে বয়সটাও কম ছিল না। ডালমিয়ার মৃত্যুর পর বিশাল পরিবর্তন এসেছে ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড বিসিসিআই এবং পশ্চিম বঙ্গ ক্রিকেটে। ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন অব বেঙ্গলেরও (সিবিএ) প্রেসিডেন্ট ছিলেন ডালমিয়া। তার মৃত্যুতে সিবিএর প্রেসিডেন্ট পদে আসেন কলকাতার মহারাজ সৌরভ গাঙ্গুলি। জগমহন ডালমিয়ার পুত্র অভিষেক ডালমিয়া হলেন সিবিএ’র যুগ্ম সম্পাদক। ভারতে চলমান টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কাভার করতে গিয়ে জাগো নিউজের স্পোর্টস রিপোর্টার রামিন তালুকদার গিয়েছিলেন জগমহন ডালমিয়ার বাড়িতে। সেখানে বসে তিনি দু’দেশের ক্রিকেট বিষয়ে নানা কথা বলেছেন ডালমিয়ার পুত্র অভিষেকের সঙ্গে। সেই কথাবার্তাগুলোই প্রশ্নোত্তর আকারে সাজিয়ে দেয়া হলো জাগো নিউজের পাঠকদের জন্য।প্রশ্ন: আপনার বাবার মৃত্যুর পর পারিবারিক অবস্থা কেমন?অভিষেক: সত্যি বলতে, বড় ধাক্কা খেয়েছে পরিবার। যখন কেউ অভিভাবক হারায়, তখন সেই পরিবারের সহজ থাকাটা কখনোই সহজ নয়। জীবন পরিবর্তন হয়ে গেছে পুরোপুরি। তখন মাথার উপর একটা গাছের মতো ছিলেন তিনি। এখন তো সেই গাছটা নেই। সুতরাং, এটা কঠিন অধ্যায় হয়ে গেছে আমাদের জন্য। একই সঙ্গে আমি এবং আমার দিদি যা শিখেছি উনার কাছ থেকে তা হলো, বাস্তবতা যা, সেটাকে মোকাবেলা করতে হবে এবং কাটিয়ে উঠতে হবে। আমরা চেষ্টা করছি। ব্যবসা করছি, ক্রিকেটে যুক্ত হয়েছি। যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করছি।প্রশ্ন: বাবাকে দেখতে দেখতে তো এখন নিজেই সিএবির কর্মকর্তা হয়ে গেলেন। অনুভূতিটা বলবেন?অভিষেক: আমি সৌভাগ্যবান যে উনার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ২০০৬ সাল থেকে ছায়া হয়ে ছিলাম। এমনকি যখন ছোট ছিলাম, তখন অপেক্ষা করতাম, কখন ফিরবেন বাসায়। জিজ্ঞাসা করতাম, সারাদিন কি হলো। বোর্ড মিটিংয়ে কি হলো, কে কি বললো, তার জবাব তুমি কীভাবে দিলে। ২০০১ সাল থেকে আমি অফিস জয়েন করি। তখন উনার সঙ্গে এক সঙ্গে কাজ করা শুরু হয়। ২০০৬ থেকে পরিপূর্ণভাবে কাজ শুরু করেছিলাম। তার জন্যও কঠিন সময় যাচ্ছিল। গত ১০ বছর অন্তরালে উনার অফিসের কাজটাও আমি দেখতাম কিছুটা। সহযোগিতা করতাম। এটা আমাকে অনেক সাহায্য করেছে। সেখান থেকে শিখেছি কীভাবে সমস্যা সমাধান করতে হয়, কঠিন অবস্থা থেকে বের হয়ে আসা। ২০১৩ সালে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হওয়ার পরও উনার সঙ্গে ছিলাম। বিসিসিআইয়ের টালমাটাল অবস্থা ছিল। সেই সময়টাও আমি দেখেছি। এখন আমি সিএবিতে। ওই অভিজ্ঞতা আমাকে সাহায্য করেছে।প্রশ্ন: বাবার কোন জিনিসটা আপনার ভালো লাগতো বেশিঅভিষেক: যেটা দেখেছি সততা, একনিষ্ঠতা, কঠোর পরিশ্রম। এই তিনটা জিনিসের কারণেই ওনার বিসিসিআইতে প্রত্যাবর্তন সম্ভব ছিল। সবসময় সততা প্রমাণ করে গেছেন। এটা কিন্তু খুব সহজ নয়। একটা লোক দুবার আসে না। একবারই হয়। দুবার হয়- যদি না আপনার ট্র্যাক রেকর্ড ভালো হয়। ওসব ভালো হয় আপনার কাজের কারণে। তিনি কাজের জায়গাকে মন্দির হিসেবেই বিবেচনা করতেন। ওভাবেই কাজ করতেন।প্রশ্ন: মাঝে আপনার বাবা যখন ছিলেন না তখন বিসিসিআইতে নানা কেলেঙ্কারি হয়েছে। তখন?অভিষেক: ওই সময়ে তিনি বিসিসিআইয়ে না থাকলেও ক্রিকেটে ছিলেন। তারপরও তিনি কিছু সাজেশন দিয়েছিলেন। যেগুলো বিসিসিআইও তখন গ্রহণ করেছিল। এটা করেছিল কারণ এমন একজন করেছে যে, তার সততার কারণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল। ক্রিকেটকে ক্লিন করার জন্যও কাজ করে গেছেন তিনি।প্রশ্ন: বাংলাদেশের জন্য আপনার বাবার টান কেমন দেখেছিলেন?অভিষেক: বাংলাদেশের জন্য উনার টান চিরকালই প্রচণ্ড রকমের ছিল। কেন নয়? আর এটা তো শুধু একটা সামীন্তের বাইরে। আগে তো একই ছিল। বাংলাদেশ থেকে সহযোগিতা, ভালোবাসা উনি পেয়েছিলেন পুরোটা সময় জুড়ে। যখন উনি ঢাকায় যেতেন, উনাকে দেখার জন্য লোকে ভিড় করতো। ১৯৯৮-এ আমি তখন ছিলাম সঙ্গে। অবস্থাটা আমি দেখেছি। এই যে ভালোবাসা, এই ভালোবাসা আলাদা মাত্রার। বাংলাদেশ ভালো খেলে উঠে আসার চেষ্টা করছে, প্রয়োজনীয় ক্রিকেট অবকাঠামো তৈরি করেছে, টুর্নামেন্ট আয়োজন করে। এগুলো না হলে, একহাতে তো তালি বাজতো না। এগুলো হয়েছিল বলেই, তাদেরকে সাহায্য করেছে। দুদিক থেকে সমানভাবে সম্পর্ক ছিল। কখনোই ক্রিকেট বাদ দিয়ে সম্পর্ক ছিল না। আমি মনে করি, এখন এটা গর্বের যেভাবে বাংলাদেশ খেলছে। তারা যে কোনো দিন যে কোনো দলকে হারাতে পারে।প্রশ্ন: সৌরভ গাঙ্গুলি তো সিবিএ সভাপতি। আপনি জয়েন্ট সেক্রেটারি। তাকে কেমন দেখছেন? অভিষেক: সৌরভ লিজেন্ড। ক্রিকেটে দীর্ঘদিন ছিলেন খেলোয়াড় হিসেবে। সে দেখেছে কীভাবে বিসিসিআই সমৃদ্ধ হয়েছে। টিম ইন্ডিয়া তো সে বানিয়েছিল। দলের মধ্যে জেতার জেদ এনেছিলেন। তখন থেকেই দেখেছি একটা ভালো সম্পর্ক আছে। একটা পারিবারিক সম্পর্কও আছে। সে জানে অবস্থাটা কি। আধুনিক ক্রিকেট সম্পর্কেও ধারণা আছে। সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে সিএবিতে সর্বোচ্চ সময় দিতে। আর তার জড়িয়ে পড়াটা ক্রিকেটের জন্য ভালো, ভারতীয় ক্রিকেটের জন্যও ভালো। সে সারা বিশ্বে খেলেছে, সর্বোচ্চ পর্যায়ে নেতৃত্ব দিয়েছে, তার অভিজ্ঞতা অনেক। তার মাধ্যমে সিএবি লাভবান হবে।প্রশ্ন: আপনার বাবা তো বাংলাদেশের জন্য অনেক করেছে, আপনার কি লক্ষ্য বাংলাদেশকে নিয়ে?অভিষেক: বিসিবি-সিএবি, আমাদের যৌথ প্রোগ্রাম আছে। বয়সভিত্তিক দল ট্যুর করে। দুই দিকের উন্নতির জন্য। এটা ছাড়া, আমাদের এখানে আমরা ভিশন প্রোগ্রাম করছি। মুরালিধরন, ভিভিএস লক্ষ্মণ যুক্ত আছে। ওখানে যারা উদীয়মান ক্রিকেটার আছে তারা আসতে পারে, অংশও নিতে পারে। এটা প্রোগ্রামের মানটাও বাড়াবে। এখন পর্যন্ত এটি শুধু রাজ্যের জন্য। আরেকটা দেশ যুক্ত হলে এটার মাত্রা বেড়ে যায়। বাংলাদেশের উদীয়মানরা এখান থেকে লাভবান হতে পারে। মুরালি-লক্ষ্মণরা বড় ক্রিকেটার, উনারা যে টিপস দিবেন এটা খুব কাজে লাগবে। বিসিসিআইয়ে, একটা কমিটি আছে নিউ এরিয়া কমিটি। আমি ওটার চেয়ারম্যান। আমাদের এখানে সে সব রাজ্য ভালো করছে না, বিসিসিআইয়ের পূর্ণ সদস্য নয়, ওদের ওখানে কীভাবে কাজ করা যায়। বিশেষ করে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল। ওগুলো বাংলাদেশের কাছাকাছি। ভারতের ওই জায়গাগুলোর সঙ্গে পাশাপাশি বাংলাদেশকে যুক্ত করা যায়। অনেক প্রোগ্রাম আছে এখানে। কোচেস ট্রেনিং, আম্পায়ারস ট্রেনিং প্রোগ্রাম, ভিডিও অ্যানালিস্টদের প্রোগ্রাম আছে। এসব প্রোগ্রামে বাংলাদেশের যে কেউ আসতে পারে চাইলে। এটা নিয়ে বিসিবি সভাপতির সঙ্গে কথাও হয়েছে। যেভাবে সম্ভব একসঙ্গে কাজ করা এবং সম্পর্কের উন্নতি করা।প্রশ্ন: বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ আয়োজনে নিজে বাংলাদেশের ভয়েস হিসাবে কিছু করবেন?অভিষেক: ইডেন বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচের জন্য আদর্শ ভেন্যু। এটা দুদেশের মানুষকেই সুযোগ করে দেয় খেলা দেখার জন্য। বাংলাদেশের মানুষ খুব সহজে আসতে পারে। আমি মনে করি, সিএবির দিক থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করা, তাদের সাহায্য করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। যে সম্পর্ক আছে তার কারণে। যে বন্ধন গত কয়েক দশক ধরে আছে।প্রশ্ন: তারকা সংগঠক হিসেবে বাবাকে কেমন দেখতেন?অভিষেক: যেটা আমি আগেও বলেছিলাম, একজন অনেক কিছু শিখতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে একজন এডমিনিস্ট্রেশনের লিডার হিসেবে আপনাকে একই সঙ্গে দলগত কাজটাও করতে হবে এবং সেটা সে খুব ভালোভাবে করেছেন। তা না হলে কেউ এতো সফল হতে পারে না। এটা তার একটি আলাদা গুণ এবং বড় গুণ। লোকজন আপনাকে মেনে নিয়েছে এবং লোকজন আপনাকে মেনে নেবে তখনই যখন আপনি সৎ থাকবেন এবং সকলকে সমানভাবে দেখবেন। এটাই সবচেয়ে বড় গুণ যা আমি তার কাছ থেকে শিখেছি। কীভাবে পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করতে হয়, কীভাবে লোকজনকে মানিয়ে নেয়া যায়।প্রশ্ন: আনুষ্ঠানিকভাবে তো প্রশাসক হিসেবে যাত্রা শুরু করে দিলেন। এখন নিজের লক্ষ্য কি?অভিষেক: আমরা তার কাছ থেকে যা শিখেছি তার সঠিক প্রয়োগ। আমরা যাই করি না কেন, তা যেন সততা এবং আত্মোৎসর্গের মাধ্যমে করতে পারি এবং আমরা এতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিছুদিন আগে আমার দায়িত্ব ছিল, বাবাকে সাহায্য করা। এখন আমার দায়িত্ব ভিন্ন। তাই এটা তুলনা করা ঠিক হবে না। কারণ তিনি একজন কিংবদন্তী ছিলেন। আর সবেমাত্র প্রশাসনিক কার্যে যাত্রা শুরু করেছি। এটা প্রথম কথা। আর দ্বিতীয় কথা হচ্ছে, আমি এখানে ময়াদান ক্লাবের হয়ে পাঁচ বছর আগে কাজ করেছি। এছাড়াও আমি এখানকার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনেও কাজ করেছি। সেখানে আমি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলাম। ক্রিকেট না হলেও আমি খেলাধুলার প্রশাসন দিয়েই শুরু করেছি। ক্রিকেটের এই লেভেলে অবশ্য প্রথম। এখন লক্ষ্য আমাদের ফাইনাল (টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের), এরপর আমাদের আরও অনেক টুর্নামেন্ট আছে। স্থানীয় পর্যায়ের অবকাঠামো কীভাবে আরও ভালো করে করা যায়। মাঠগুলো সংস্কার করা, তরুণদের সুবিধা আরও বাড়ানো। এগুলি আমার বেসিক জিনিস আমার মনে রয়েছে।প্রশ্ন: আপনার বোনের রাজনীতিতে যোগ দেয়াঅভিষেক: ভাই হিসেবে আমি এটাই বলবো যে, আমরা পরিবার হিসেবে খুব ক্লোজ। আমাদের পরিবার খুব ছোট। মাত্র ছয় জনের, আমার মা, বাবা, বোন, আমার স্ত্রী, এবং আমার ভাগ্নে। বাবা মারা যাবার পর আরও ছোট হয়ে গেছে। ভাই হিসেবে আমি অবশ্যই তার ভালো চাই। আমার বিশ্বাস সে যা করবে তা সততার সঙ্গেই করবে। তার সামাজিক কর্মকাণ্ডে এর আগেও অনেক অভিজ্ঞতা আছে। সে পিপল ফর এনিমেল, রোটারি ক্লাব ওল্ড ইজ হোম এবং অনেক এতিমখানার হয়ে কাজ করেছে। তার সামাজিক কর্মকাণ্ডে আগে থেকেই অনেক সংযোগ রয়েছে। আমার বিশ্বাস সে সততা এবং ডেডিকেশনের মাধ্যমেও সব কাজ করবে।প্রশ্ন: বাংলাদেশকে ভারত আমন্ত্রণ জানায় না, এখানে যে বাংলাদেশ খেলতে আসতে পারছে না এ বিষয়ে আপনার মতামত কী? অভিষেক: বড় উদাহরণ হল এখানে বাংলাদেশের দুটা খেলা হলেঅ, দেখেছেন কেমন দর্শক হয়েছে। এটা অনেক বড় স্টেডিয়াম। এটা যদি অন্য স্টেডিয়াম হত তাহলে হাউজফুল হয়ে যেত। এমনকি ভারত না খেলা সত্বেও। ভারত খেললে কেমন হত! এটা একটা ম্যাসেজ। এখানকার মানুষ বাংলাদেশের খেলা কেমন দেখতে চায় এবং এখানে বাংলাদেশ থেকে খুব সহজেই লোক আসতে পারছে। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচেই দেখেন কেউ বাঘ সেজেছে। এটাই হচ্ছে এখানকার দর্শকদের খেলা দেখার আগ্রহ। ওই ম্যাচে যা ছিল ভারতের এমন কিছু মাঠ আছে যে দেড় গুণ গ্যালারি ভরে যেত। তাই আমার মনে হয় ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচ খেলার জন্য এই ম্যাসেজই যথেষ্ট। খেলা পাগল লোক যদি দেখতে চায় তাহলে ম্যাচ না হবার কোনো কারণ নেই। আর কলকাতায় দুই দেশের জন্যই ভালো। কারণ, খুব সহজে বাংলাদেশের মানুষ চলে আসতে পারে। আরটি/আইএইচএস/পিআর