ভারতের কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩১ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে তিন দিনব্যাপী বহুভাষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলন। সম্মেলনে ‘১৯৪৭-এর দেশভাগ: সমাজ ও সাহিত্যে তার প্রভাব’ বিষয়ক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশের প্রায় ৫০ জন অধ্যাপক ও গবেষক, পাকিস্তান ও আমেরিকা থেকে কয়েকজন ও ভারতের প্রায় ২৩টি রাজ্যের প্রায় ২ শতাধিক অধ্যাপক ও গবেষক অংশগ্রহণ করেন।
Advertisement
এছাড়া বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষক, শিক্ষার্থীবৃন্দ এ বহুভাষিক আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রে অংশগ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ এবং IoE SRICC যৌথভাবে এ আয়োজন করে। বাংলা বিভাগের শিক্ষকদের এমন চমৎকার ও নিখুঁতভাবে আয়োজন সবাইকে বিস্মিত করেছে।
আয়োজনের অংশজুড়ে ছিল অভিনবত্বের ছোঁয়া। শুরুতেই কপালে চন্দন ফোঁটা পরিয়ে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথানুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা পণ্ডিত মদনমোহন মালভিয়াকে পুষ্পমাল্য অর্পণ, মঙ্গলাচারণ এবং কুলগীতির মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রধান পৃষ্ঠপোষক হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সুধীর কুমার জেইনের। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক সভা থাকায় তাঁর আসন অলংকৃত করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক অরুণ কুমার সিং।
আয়োজনের সভাপতি বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সুমিতা চ্যাটার্জি প্রধান অতিথি মালদাহের গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর রজত কিশোর দেসহ অতিথিদের উত্তরীয় পরিধানের মাধ্যমে সম্মেলনের সূচনা করেন। সম্মেলনের আহ্বায়ক বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুবীর ঘোষকে উত্তরীয় প্রদানের মাধ্যমে অতিথি বরণ পর্ব সমাপ্তি করেন।
Advertisement
সভাপতি সুমিতা চ্যাটার্জি অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, ‘বহুভাষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের বিষয় অত্যন্ত আবেগ মোহিত। বাংলার ভাষাভাষি মানুষের কাছে দেশভাগের বিভাগজনিত বেদনা শেকড়প্রোথিত। কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের উদ্যোগে আয়োজিত এ বহুভাষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের মাধ্যমে আমরা পুনরায় স্মরণ করছি আমাদের পূর্বপুরুষের সেই যুগযন্ত্রণার কথা।’
সুবীর ঘোষ সম্মেলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে ধন্যবাদ জানানোর মধ্য দিয়ে আয়োজনের কথা শুরু করেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে দেশভাগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বিশেষ কৃতজ্ঞা প্রকাশ করেন বাংলাদেশের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রাহেল রাজিবকে। কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পঞ্চানন দালাইয়ের প্রতি।
আরও পড়ুন: আত্মশ্রাদ্ধ করলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ!
ড. সুবীর ঘোষ বলেন, ‘তিন মাসের অক্লান্ত পরিশ্রম আজ সার্থকতার মুখ দেখছে। তিনশ’র কাছাকাছি অংশগ্রহণকারী এবং চারটি দেশের অংশগ্রহণকারী ও ভারতের ২৩টি রাজ্যের অংশগ্রহণকারীর মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে এ কনফারেন্স। কনফারেন্স প্রসিডিংস ও কনফারেন্স পেপারগুলো দুই খণ্ডে প্রকাশিত দুটো বইয়ের মোড়ক উন্মোচনও হয়েছে। যা একটি বিরল ঘটনা। কারণ কনফারেন্স পেপার সমন্বয়ে অধিকাংশ বুকস বা জার্নাল অপ্রকাশিত থেকে যায় নানা সীমাবদ্ধতায়। কিন্তু আমরা এ দুটো খণ্ড প্রকাশ করতে পেরেছি। সম্পাদনা পর্ষদ ও দ্বৈত নিরীক্ষক টিম অক্লান্ত পরিশ্রম করে প্রবন্ধগুলো জাজ করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন। গবেষকবৃন্দও পরামর্শমাফিক যথাসময়ে প্রবন্ধ কারেকশন করে দেওয়ায় সেটি সম্ভব হয়েছে। বই দুটোর প্রকাশক বাংলাদেশের প্রকাশনা সংস্থা নৈঋতা ক্যাফে।’
Advertisement
কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক পঞ্চানন দালাই বলেন, ‘বাংলা বিভাগের এ আন্তর্জাতিক আলোচনা চক্রের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পেরে সৌভাগ্যবান মনে করছি। দেশভাগের কারণে মানুষের জীবনে যে দুর্বিষহ যন্ত্রণা নেমে আসে; সেদিকেই আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। বাংলাদেশসহ ভারত ও পাকিস্তানের মানুষের দেশভাগের ফলে যে অস্তিত্ব-সংকট, সংখ্যালুঘু সম্প্রদায়ের কথা, উদ্বাস্তু সমস্যা সর্বোপরি তাদের ভিটেমাটি অর্থাৎ দেশভাগের ফলে শেকড়হীন মানুষের কথাই তুলে ধরতে চেয়েছি।’
বাংলাদেশের জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. রাজিব মণ্ডল (রাহেল রাজিব) বলেন, ‘বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত ত্রি-দিবসীয় এ কনফারেন্সে বাংলাদেশের ৮টি পাবলিক ও ৫টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়সহ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থী ও গবেষকবৃন্দ অংশগ্রহণ করেছেন। বাংলাদেশ থেকে ৬৮ জন শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থী এতে অনলাইন ও অফলাইনে অংশগ্রহণ করছেন। বিএইচইউ ভারতের অন্যতম গবেষণা নির্ভর বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে দারুণ সুনাম আছে। এখানে এসে শিক্ষার্থী ও গবেষকবৃন্দ দেশ-বিদেশের একাডেমিশিয়ানদের সঙ্গে পরিচিত হবেন, গবেষণায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার সমান্তরালে এ যোগসূত্র তাঁদের গবেষণা চিন্তায় যেমন কাজ করবে; তেমনই একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এ শিক্ষাভ্রমণ উদারনৈতিক ও মানবিক করে তুলবে। প্রকাশিত কনফারেন্স প্রসিডিংস ও কনফারেন্স জার্নালে তাঁদের এ লেখা প্রকাশিত হয়েছে, যা গবেষকদের কাজে লাগবে।’
মালদাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রজত কুমার দে বলেন, ‘দেশভাগ ১৯৪৭: সমাজ ও সাহিত্যে তার প্রভাব’ এ শিরোনাম থেকে আমি শুধু দেশভাগ, সমাজ, সাহিত্য শব্দ বেছে নেবো। আমাদের মনে রাখতে হবে, কেনো দেশভাগের প্রয়োজন ছিল? কারা দেশভাগ চাইল? আমার ধারণা, ভারতীয় উপমহাদেশে যে দাঙ্গার সূত্রপাত হয় তা সমাধানের উপায়ই ছিল দেশভাগ। তৎকালীন অনেকেই ভেবেছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশকে বিভক্ত করলেই সর্বপ্রকার দাঙ্গার করালগ্রাস থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের সদ্যপ্রয়াত কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের লেখায় দেশভাগের নানা প্রসঙ্গের পাশাপাশি বিশ্বের অন্য ভাষায়ও দেশভাগ নিয়ে সমাজ ও সাহিত্যে প্রতিফলনের অপরাপর বিষয়গুলোর উঠে আসে।’
অধ্যাপক অরুণ কুমার সিং বলেন, ‘দেশভাগ আসলে ফ্রেম ছাড়া ফটোর মতো। যেমন ভূগোল ছাড়া ইতিহাস। বিভিন্ন উপমা, উৎপ্রেক্ষার প্রসঙ্গ এনে দেশভাগের ওপর আলোচনা করেছি। সমাজ, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও দেশভাগের বিরূপ প্রভাবের বিষয়ও উঠে এসেছে। আগস্টকে আমরা বিভাজন বিভীষিকা দিবস হিসেবে পালন করছি। দেশভাগের ফলেই মানুষ মানবিকতা হারিয়ে ফেলে।’
আরও পড়ুন: ৫ কবি-লেখককে চিন্তাসূত্র সাহিত্য পুরস্কার প্রদান
প্রধান বক্তা বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক অমৃত সেন তাঁর বক্তব্যে দেশভাগের ফলে সৃজিত বিভিন্ন ভাষায় রচিত দেশভাগের সাহিত্য নিয়ে আলোচনা করেন। মান্টোর ছোটগল্প, খুশবন্ত সিংয়ের ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’, ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘সুবর্ণরেখা’, সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’, সৃজিত মুখার্জির ‘রাজকাহিনি’, বাংলাদেশের আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্যে দেশভাগের প্রসঙ্গ, হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যে দেশভাগের নানামাত্রিকতা নিয়েও আলোচনা করেন।
আয়োজনের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক প্রকাশ কুমার মাইতি বলেন, ‘দেশভাগকে ঘটনা থেকে দুর্ঘটনা বলাই শ্রেয়। যা বাংলার মানুষকে বেশি প্রভাবিত করেছে। এর দুঃখ-যন্ত্রণা অতিক্রম করলে এর শেষ নেই। স্বাধীনতার ‘অমৃতকাল’ (৭৫ বছর পূর্তি) চললেও দেশভাগের বিষ নির্বাপিত হয়নি। কারণ এখনো স্মৃতির বেদনায় আমরা মেদুর হয়ে উঠি।’
বহুভাষিক আন্তর্জাতিক সম্মেলনটি আয়োজন করা হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈদিক বিজ্ঞান কেন্দ্রে। প্রতিদিন প্রায় শতাধিক গবেষকের গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে আগামী ২ নভেম্বর দেশভাগের ওপর আন্তর্জাতিক সম্মেলনটি শেষ হবে।
এসইউ/জেআইএম