বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দিয়ে আসছে সরকার। তবু কমেনি হুন্ডিতে টাকা পাঠানোর প্রবণতা। গত কয়েক মাসে রেমিট্যান্স প্রবাহে ভাটা পড়ায় ব্যাংকগুলো আরও আড়াই শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। সব মিলিয়ে বৈধ পথে কেউ রেমিট্যান্স পাঠালে এখন এক ডলারের বিপরীতে ১১৬ টাকার বেশি পাচ্ছেন। হুন্ডিতেও প্রায় সমপরিমাণ টাকা মেলে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হুন্ডি বন্ধ না করতে পারলে এ প্রণোদনাও এক সময় কাজে আসবে না।
Advertisement
দেশে ডলারের বিপরীতে টাকার দরের বেশি পার্থক্য থাকলে প্রবাসীদের অবৈধ পথেই ডলার পাঠানোর প্রবণতা থাকবে। এজন্য হুন্ডি বন্ধ করতে হবে। হুন্ডি বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কঠোর অবস্থানে রয়েছে আর্থিকখাতের গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউ। তারপরও আটকানো যাচ্ছে না হুন্ডিতে লেনদেন। প্রণোদনার পাশাপাশি সচেতনতা বাড়ালে রেমিট্যান্স বাড়বে বলে প্রত্যাশা খাত সংশ্লিষ্টদের।
আরও পড়ুন>> বাড়তি প্রণোদনায় রেমিট্যান্স প্রবাহে সুবাতাস
দেশের মধ্যে ডলার সংকট এখনো তীব্র। বাজার নিয়ন্ত্রণে প্রতিনিয়ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ডলার সরবরাহ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে টান পড়েছে রিজার্ভেও। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী, দেশে খরচ করার মতো রিজার্ভ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাস্তবে এ রিজার্ভ আরও অনেক কম।
Advertisement
ডলার বাজারের পরিস্থিতি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। এখন থেকে ব্যাংক নিজস্ব আয় থেকে প্রবাসীদের ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেবে। তবে এটা আবার আমদানিকারকদের থেকে নিতে পারবে না। নতুন এ সিদ্ধান্তে প্রবাসীরা উৎসাহিত হবেন। বৈধপথে রেমিট্যান্স বাড়বে।– বাফেদা চেয়ারম্যান আফজাল করিম
অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম মাধ্যম প্রবাসী আয়ও আসছে না আশানুরূপ। প্রবাসী বাড়লেও বাড়ছে না বৈধ পথে রেমিট্যান্স। এ কারণে বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়াতে প্রণোদনাও বাড়ানো হয়েছে।
এখন বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনতে সরকার ও ব্যাংক মিলে পাঁচ শতাংশ প্রণোদনা দিচ্ছে। প্রবাসীদের আয়ে ব্যাংকে এক মার্কিন ডলারের দাম ১১০ টাকা ৫০ পয়সা। এর সঙ্গে সরকার আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয়। তাতে এক ডলারে পাওয়া যেত ১১৩ টাকা ২৬ পয়সার কিছু বেশি। ব্যাংকগুলো দিচ্ছে আরও ২ দশমিক ৫ শতাংশ। ফলে এখন থেকে প্রবাসীরা এক ডলারে ১১৬ টাকার কিছু বেশি পাচ্ছেন।
নতুন এ পদক্ষেপের ফলে প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত হবেন। এতে প্রবাসীরা হুন্ডির ঝুঁকি না নিয়ে নিরাপদে অর্থ পাঠাবেন। এরই মধ্যে গত কয়েকদিনে এর ইতিবাচক সাড়াও মিলেছে।
Advertisement
দামের পার্থক্য থাকলে প্রবাসীরা অবৈধ পথেই ডলার পাঠাবেন। যারা হুন্ডির মাধ্যমে ব্যবসা করে সেই চ্যানেলটা বন্ধ করার জন্য শক্ত পদক্ষেপ দরকার। এদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ফরেন কারেন্সিতে আশঙ্কা থেকেই যাবে।-গবেষণা পরিচালক (সানেম) ড. সাইমা হক বিদিশা
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদন মতে, অক্টোবর মাসের প্রথম ২৭ দিনে ব্যাংকিং চ্যানেলে ১৬৫ কোটি ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা আগের সেপ্টেম্বরে ছিল ১৩৪ কোটি ডলার। সে হিসাবে প্রথম ২৭ দিনেই গত মাসের তুলনায় ৩১ কোটি ডলার বেশি এসেছে। প্রতি ডলারে আগের আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দ্বিগুণ করে ৫ শতাংশ করায় রেমিট্যান্স বেড়েছে এমনটা বলছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা।
আরও পড়ুন>> ৪১ মাসে সর্বনিম্ন রেমিট্যান্স এলো সেপ্টেম্বরে
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ অথরাইজড ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনের (বাফেদা) চেয়ারম্যান ও সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আফজাল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘ডলার বাজারের পরিস্থিতি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। এখন থেকে ব্যাংক নিজস্ব আয় থেকে প্রবাসীদের ২ দশমিক ৫ শতাংশ প্রণোদনা দেবে। তবে এটা আবার আমদানিকারকদের থেকে নিতে পারবে না। নতুন এ সিদ্ধান্তে প্রবাসীরা উৎসাহিত হবেন। বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়বে।’
দেশে চলমান ডলার সংকট নিরসনে নতুন করে ঘোষিত আড়াই শতাংশ প্রণোদনার সিদ্ধান্ত নিলেই হবে না, এটা কার্যকর করতে ডলার রেট পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে, নজরদারি বাড়াতে হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। ডলারের দর বাজারভিত্তিক করতে পারলেই ভালো ফল পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মত তাদের।
বিষয়টি নিয়ে গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) গবেষণা পরিচালক ড. সাইমা হক বিদিশা জাগো নিউজকে বলেন, ‘রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে ব্যাংকের পক্ষে আরও আড়াই শতাংশ পর্যন্ত প্রণোদনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটা দীর্ঘ মেয়াদে কাজে আসবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ডলারের অফিসিয়াল-আনঅফিসিয়াল রেটে পার্থক্য না কমবে। দামের পার্থক্য থাকলে প্রবাসীরা অবৈধ পথেই ডলার পাঠাবেন। যারা হুন্ডির মাধ্যমে ব্যবসা করে সেই চ্যানেলটা বন্ধ করার জন্য শক্ত পদক্ষেপ দরকার। এদের নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ফরেন কারেন্সিতে আশঙ্কা থেকেই যাবে।’
আরও পড়ুন>> ফের নিম্নমুখী রেমিট্যান্স
একই কথা জানান একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের প্রধান। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশ থেকে প্রবাসী বাড়ছে অথচ সে তুলনায় রেমিট্যান্স আসছে না। শুধু প্রণোদনায় কাজে আসবে না। বৈধ পথে রেমিট্যান্সের দাম বাড়লেও হুন্ডিতে আরও দাম বাড়বে। এক্ষেত্রে তাদের হুন্ডি বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এটা করতে পারলে আমাদের ডলার সংকট কখনই হবে না।’
অর্থপাচার প্রতিরোধে সক্রিয় এমএফএস কোম্পানিগুলো। সন্দেহজনক লেনদেন পেলেই তার বিষয়ে পর্যবেক্ষণ করছে নিজেরাই। এ বিষয়ে নগদের জনসংযোগ বিভাগের প্রধান মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কোনো ব্যক্তি রাত ২টার পর একাধিক দিন লেনদেন করলে সেটা যাচাই-বাছাই করি। এটা দু-একদিন হতে পারে। প্রতিদিন একই সময়ে লেনদেন হলে সেটা নিয়ে আমরা পর্যবেক্ষণ করি। আবার কোনো একটা হিসাব থেকে শুধু সেন্ড মানি হচ্ছে আর মাধ্যম ব্যবহার হচ্ছে না, সেখানে সন্দেহের বিষয় থাকে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম অঞ্চলেও তিনশর বেশি সিম বন্ধ করা হয়েছে বিভিন্ন অপরাধে। সেখানেও আমরা ছিলাম না। তবে দেশের স্বার্থে অর্থপাচার রোধে এগিয়ে আসতে হবে।’
অন্যদিকে হুন্ডি, গ্যাম্বলিং, ক্রিপ্টো কারেন্সি প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন প্রতিরোধে গঠিত বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। সংস্থাটির প্রধান মাসুদ বিশ্বাস বলেন, ‘হুন্ডি প্রক্রিয়ায় পাচার বেড়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশ প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে। হুন্ডি, অনলাইন গ্যাম্বলিং, গেমিং, বেটিং, ফরেন্স ও ক্রিপ্টো ট্রেডিং প্রতিরোধে জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সন্দেহজনক লেনদেনে প্রতিদিন ২০০ অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হচ্ছে। জুয়া বা হুন্ডিতে জড়িত ২০ হাজার ৭২৫টি ব্যক্তিগত হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। ৮১৪টি ওয়েবসাইট, ১৫৯টি অ্যাপ, ৩৩৭টি ফেসবুক পেজসহ একাধিক ইনস্টাগ্রাম-ইউটিউব লিংক আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে রয়েছে। এছাড়া অনেকেই আইনের আওতায় এসেছে, অভিযান চলছে বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতায়।’
ইএআর/এএসএ/এএসএম