মতামত

পরিপাটি ও গোছানো মানুষ ছিলেন

২৫ অক্টোবর সকালেই দুঃসংবাদটি শুনে হতবাক হয়ে পড়েছিলাম। সৈয়দ আবুল হোসেন আর নেই- এই খবরটি শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। ঢাকার বেসরকারি ইউনাইটেড হাসপাতালে ২৫ অক্টোবর ভোরে হৃদরোগে মৃত্যু হয় ৭২ বছর বয়সী সাবেক এই যোগাযোগ মন্ত্রীর। তিনি বয়সে আমার চেয়ে কয়েক বছরের ছোটই ছিলেন। আওয়ামী লীগ করার সুবাদেই তার সঙ্গে পরিচয় এবং এই পরিচয়ের বন্ধন ছিন্ন হয়নি কখনো। তার জীবনে এবং আমার রাজনৈতিক জীবনে খারাপ সময় এসেছে কিন্তু আমাদের পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্কে কোনো কিছুই চিড় ধরাতে পারেনি।

Advertisement

তিনি এক সময় আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। আমি ছিলাম বিজ্ঞান ও গবেষণা সম্পাদক। অত্যন্ত অমায়িক, বন্ধুবৎসল, হাসিখুশি ও উদারমনা মানুষ ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন। তার সঙ্গে যাদের ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল তারাই জানেন কত মানবিক গুণ সম্পন্ন একজন মানুষ ছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন। তিনি ১৯৫১ সালের ১ আগস্ট মাদারীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৬৬ সালে বরিশালের আগৈলঝাড়া উপজেলার গৈলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তার সহপাঠী, সাংবাদিক অজয় দাশগুপ্ত লিখেছেন : সৈয়দ আবুল হোসেন মাদারিপুরের ডাসার থেকে এ বিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন। থাকতেন এক আত্মীয়ের বাসায়। প্রতিদিন পরিপাটি হয়ে ক্লাসে উপস্থিত হতেন। হাল্কা নীল কিংবা সাদা রংয়ের জামা এবং সাদা পাজামা পরতেন। চুল সুবিন্যস্ত। কোনো দিন তাকে মলিন মুখে দেখিনি, পোশাকেও কখনও ময়লা লাগতে দিতেন না। পড়াশোনায় ভাল ছিলেন। প্রতিদিন নিয়ম করে কয়েকটি নতুন ইংরেজি শব্দ শিখতেন এবং অন্যদেরও জানিয়ে দিতেন। পরীক্ষার খাতায় ইংরেজি ও বাংলা কোটেশন ব্যবহারে তাঁর সমকক্ষ কেউ ছিল না।

সৈয়দ আবুল হোসেন ১৯৬৮ সালে বাণিজ্য অনুষদে ভর্তি হন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। বিশ্বিবদ্যালয় জীবন শেষ করে প্রথমে তিনি একটি সরকারি চাকরিতে যোগ দিলেও ১৯৭৫ সালে তিনি ব্যবসা শুরু করেন। সাকো ইন্টান্যাশনাল নামের একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে তিনি সুনামের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে থাকেন। একজন সৎ ও দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে তিনি কখনো বিদেশে যেমন অর্থ পাচারের মতো ঘটনার সঙ্গে জড়াননি, তেমনি দেশের বাইরে কোনো সম্পদ গড়েনমি।

আবুল হোসেন নিজেই সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলতেন, ‘আমি ব্যবসা করে উপার্জন করি। এর একটি অংশ জনকল্যাণ ও শিক্ষার প্রসারে ব্যয় করি।’ কত জনহিতকর কাজে যে তিনি যুক্ত ছিলেন তার সবটা হয়তো আমরা জানিও না। কারণ তিনি আত্মপ্রচারে বিশ্বাসী ছিলেন না। নিজের এলাকায় তিনি কলেজ, স্কুল, মাদ্রাসাসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে তিনি ছিলেন দারাজদিল। সেজন্য এলাকায় তিনি ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয়।

Advertisement

আবুল হোসেন আওয়ামী লীগের হয়ে মাদারীপুর-৩ আসন থেকে ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য (এমপি) নির্বাচিত হন। এরপর তিনি সপ্তম, অষ্টম ও নবম সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৯৬ সালের ২৩ জুন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা মাত্র ২০ সদস্যের মন্ত্রিসভা গঠন এবং সৈয়দ আবুল হোসেনকে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করেন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জয়ী করার জন্য সৈয়দ আবুল হোসেন প্রাণান্ত পরিশ্রম করেছিলেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে এটা আমি জানি যে ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনের সময় আবুল হোসেন প্রায় দুই কোটি টাকা দিয়েছিলেন।

১৯৯৬ সালে শাহ এ এস এম কিবরিয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিসার্চ (বিএফডিআর) গঠিত হলে সৈয়দ আবুল হোসেন এই প্রতিষ্ঠানের বোর্ড অফ গভর্নেন্সের সম্মানিত সদস্য হয়েছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে সৈয়দ আবুল হোসেনের কাছে আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কারো বিপদের কথা শুনলে তার পাশে দাঁড়ানো ছিল আবুল হোসেনের সহজাত স্বভাব। ২০০১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয়ের পর আমার ওপর অহেতুক দোষারোপ করে কিছু বিরূপ প্রচারণা চালানো হয়েছিল। এমনকি নির্বাচনে পোস্টার ছাপানো বাবদ প্রেসে টাকা বাকি ছিল, সে টাকাও পরিশোধের দায় আমার ওপর চাপানো হয়। সে সময় আমাকে সাহায্য করেছিলেন কিবরিয়া সাহেব ও সৈয়দ আবুল হোসেন।

২০০১ সালের পর সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী শাহ এ এস এম কিবরিয়া মৃদুভাষণ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করলে সৈয়দ আবুল হোসেন যথেষ্ট আর্থিক সহযোগিতা করেছেন। কিবরিয়া সাহেবের মৃত্যুর পর আমি ব্যক্তিগতভাবে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নিলেও সৈয়দ আবুল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ এতটুকু শিথিল হয়নি। তিনি বরাবর আমাকে বড় ভাইয়ের মতো সম্মান করেছেন। আমার কোনো সমস্যা, রোগ-ব্যাধির কথা শুনলে ছুটে এসেছেন আমার চামেলিবাগের বাসায়। তার মধ্যে কোনো অহংবোধ ছিল না।

Advertisement

২০০৯ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলে সৈয়দ আবুল হোসেনকে যোগাযোগ মন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সে অন্যান্য কাজের মধ্যে বিশেষ অগ্রাধিকার হিসেবে পদ্মা সেতু নির্মাণে উদ্যোগী হন।

 

তাকে যে শেষপর্যন্ত দল ও সরকার যথাযথ মূল্যায়ন করলো না- এটা নিয়ে তার মনে চাপা দুঃখবোধ থাকা অস্বাভাবিক নয়। তার মতো মানবিক গুণ সম্পন্ন মানুষ আমাদের দেশের রাজনীতি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে খুব বেশি নেই। ব্যস্ত মানুষ ছিলেন, তারপরও তার লেখালেখি ও পড়াশোনার অভ্যাস আমাকে মুগ্ধ করে সব সময়। তার লেখা কয়েকটি বই আমার সংগ্রহে আছে।

 

সৈয়দ আবুল হোসেন যোগাযোগ মন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ায় তার নিজের এলাকাসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের মনে এই আশাবাদ সৃষ্টি হয় যে এবার স্বপ্নের সেতু হবেই। তিনি কাজ শুরু করেছিলেন প্রবল উৎসাহে। বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে ঋণের জন্য দৌড়ঝাঁপ করেন। নকশা প্রণীত হয়। চীন এগিয়ে আসে। ২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের চুক্তি সই করে সরকার, কিন্তু বছরের শেষ দিকেই তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। পরে ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি যোগাযোগমন্ত্রীর পদ থেকে সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন। সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকেও দায়িত্ব থেকে সরে যেতে হয়। ওই সময় তাদের গ্রেপ্তারের দাবিও ওঠে।

যদিও ওই বছরের ২ ফেব্রুয়ারি সেতুর ঠিকাদার নিয়োগে দুর্নীতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে প্রতিবেদন দেয় দুদক, কিন্তু ৩০ জুন পদ্মা সেতুর ঋণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। অথচ দুর্নীতির অভিযোগ ছিল কাল্পনিক। ‘মিডিয়া ট্রায়াল ও সুশীল সমাজের ট্রায়ালের’ শিকার করা হয় তাকে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রথম দিন থেকে বলছিলেন কোনো দুর্নীতি হয়নি। সেতুর কাজে শুরু থেকে জড়িত খ্যাতিমান দুই প্রকৌশলী অধ্যাপক জামিল রেজা চৌধুরী ও অধ্যাপক আইনুন নিশাত বার বার বলেছেন, কোনো দুর্নীতি হয়নি।

পরবর্তী সময়ে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগে কানাডার আদালতে একটি মামলা হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছরের বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০১৭ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কানাডার আদালত জানায়, পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের যে অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ঋণ বাতিল করেছিল, তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। গালগল্প ও গুজব রটিয়ে এ অভিযোগ আনা হয়েছিল। বিশ্বব্যাংকও বলেছে পদ্মা সেতু থেকে সরে গিয়ে তারা ভুল করেছে।

৯ জুলাই মন্ত্রিসভার বৈঠকে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বাংলাদেশের অর্থে এ সেতু নির্মাণ করে বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন ‘বাংলাদেশ পারে’। ২০২২ সালের ২৫ জুন সেতু উদ্বোধনের সময় শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংক এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগী একটি মহলের ভন্ডামি ও মিথ্যাচারের দুই শিকার ড. মশিউর রহমান ও সৈয়দ আবুল হোসেনকে পাশে রেখে সেতু উদ্বোধন করেছিলেন। তাদের যোগ্য সম্মান দিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী।

সৈয়দ আবুল হোসেনের সাকো ইন্টারন্যাশনাল অফিস ছিল সবার জন্য অবারিত। প্রতিদিন সকালে তিনি অফিসে যেতেন। একের পর এক দর্শনার্থী তার উদার সহায়তা পেয়ে হাসিমুখে বিদায় নিয়েছে। সবকিছু করতেন হাসিমুখে। তার কাছে সাহায্য কামনা করে কেউ বিফল হয়েছেন, এটা ছিল বিরল ঘটনা।

তবে তাকে যে শেষপর্যন্ত দল ও সরকার যথাযথ মূল্যায়ন করলো না- এটা নিয়ে তার মনে চাপা দুঃখবোধ থাকা অস্বাভাবিক নয়। তার মতো মানবিক গুণ সম্পন্ন মানুষ আমাদের দেশের রাজনীতি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে খুব বেশি নেই। ব্যস্ত মানুষ ছিলেন, তারপরও তার লেখালেখি ও পড়াশোনার অভ্যাস আমাকে মুগ্ধ করে সব সময়। তার লেখা কয়েকটি বই আমার সংগ্রহে আছে।

সৈয়দ আবুল হোসেনের মতো একজন দেশপ্রেমিক মানুষ এত দ্রুত বিদায় নেবেন, কেউ ভাবেনি। যোগ্য ও সৎ মানুষের অভাব যখন আমাদের জাতীয় জীবনে প্রবলভাবে অনুভূত হচ্ছে, তখন আবুল হোসেনের এই চলে যাওয়া একটি বড় শূন্যতার সৃষ্টি করলো। তাঁর অভাব অনুভূত হবে দীর্ঘদিন। বিএফডিআরও ক্ষতিগ্রস্ত হলো। ব্যক্তিগতভাবে অসংখ্য মানুষ তাকে প্রতিদিন স্মরণ করে কষ্ট পাবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

সৈয়দ আবুল হোসেন স্ত্রী খাজা নার্গিস, দুই মেয়ে সৈয়দা রুবাইয়াত হোসেন এবং সৈয়দা ইফফাত হোসেনের প্রতি জানাই সহমর্মিতা। তাদের দুঃখ-শোকের আমিও ভাগিদার। সৈয়দ আবুল হোসেনের আত্মার শান্তি কামনা করি।

৩০ অক্টোবর, ২০২৩

লেখক: রাজনীতিক, লেখক ও মহাপরিচালক, বিএফডিআর।

এইচআর/জিকেএস