রাজনীতি

নাগরিক সুবিধায় নজর নেই, বিভক্ত আওয়ামী লীগ

ঢাকা-৭। জাতীয় সংসদের ১৮০ নম্বর আসন। ঐতিহ্যবাহী পুরান ঢাকার আসন হিসেবে খ্যাত এটি। পুরোনো এ শহরে নাগরিক ভোগান্তি অনেক। ঘিঞ্জি পরিবেশ, সরু সড়ক, জলাবদ্ধতা নিত্যসঙ্গী। রয়েছে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি। তবে সেদিকে নজর নেই এখানকার সংসদ সদস্যদের। তিনবার বিএনপি, দুবার আওয়ামী লীগ ও একবার স্বতন্ত্র থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন এ আসনে। কোনো আমলেই খুব উন্নতি হয়নি।

Advertisement

সবশেষ তিন সংসদ নির্বাচনে দুবার আওয়ামী লীগ ও একবার আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হন। বর্তমানে সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের হাজী সেলিম। তিনি বিদ্রোহী হিসেবেও একবার জয়ী হন। এবার মনোনয়নের জন্য লড়ছেন হাজী সেলিম, সাবেক এমপি ডা. মহিউদ্দিনসহ ছয়জন। আর মনোনয়ন প্রশ্নে তিন গ্রুপে বিভক্ত দলটি।

গত কয়েকদিন সংসদীয় এ আসনটির বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে এবং স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ এলাকার মূল সমস্যা অল্প বৃষ্টিতে রাস্তায় পানি জমে যাওয়া, সরু রাস্তায় যানচলাচলে সমস্যা। বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে কেমিক্যাল-প্লাস্টিক-রঙের কারখানা থাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে থাকতে হয় বাসিন্দাদের। অন্য নাগরিক সুবিধা নিয়েও রয়েছে অসন্তোষ।

স্থানীয় বাসিন্দা আকরামুল হোসেন বলেন, স্থানীয় জনগণ হিসেবে আমরা সব সময় ভালো জনপ্রতিনিধি চাই। আমরা চাই এমন একজন এমপি হয়ে আসুক যিনি সাধারণ মানুষের নিয়মিত খোঁজ রাখবেন। বিপদে-আপদে সাধারণ মানুষের পাশে থাকবেন এবং এলাকার উন্নয়ন করবেন।

Advertisement

গত ছয়টি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তিনটিতেই জয় পেয়েছে বিএনপি। দুটিতে আওয়ামী লীগ আর একটিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী। ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে এ আসন থেকে জয় পেয়েছিলেন বিএনপির প্রার্থী সাদেক হোসেন খোকা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে জয় পান আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। ২০১৪ সালের নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে হাজী সেলিম জয়লাভ করেন। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে হাজী সেলিম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর আগে পূর্ব সীমানায় ঢাকা-৮ আসন থেকে ১৯৯৬ সালেও আওয়ামী লীগের মনোনয়নে দলীয় প্রতীকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন হাজী সেলিম।

স্থানীয় জনগণ ও তৃণমূল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ আসনে আওয়ামী লীগের রাজনীতি মূলত তিনটি গ্রুপে বিভক্ত। বর্তমান সংসদ সদস্য হাজী সেলিম রাজনীতির একটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেন। হাজী সেলিম অসুস্থ থাকায় তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বড় ছেলে মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিম এবং আরেক ছেলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইরফান সেলিম দেখাশোনা করেন। গ্রেফতার হওয়া, কাউন্সিলর পদ থেকে বহিষ্কার হওয়াসহ নানান বিতর্ক আছে ইরফান সেলিমকে নিয়ে।

আরেকটি গ্রুপের নেতৃত্ব দেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং এই আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন দেন আরেকটি অংশের নেতৃত্ব।

বর্তমান সংসদ সদস্য হাজী সেলিম দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। সংসদীয় এলাকায় এমন কথা প্রচলিত আছে যে, সংসদ সদস্য হাজী সেলিম হলেও স্থানীয়ভাবে দায়িত্ব পালন করেন তার ছেলে সোলায়মান সেলিম ও ইরফান সেলিম। যে কোনো সমস্যা সমাধান বা ক্রান্তিলগ্নে বাবার পাশেই থাকেন তারা।

Advertisement

২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে করা দুদকের মামলায় ২০২২ সালে গ্রেফতার হন হাজী সেলিম। এ মামলায় ২০০৮ সালের এপ্রিলে ১৩ বছরের কারাদণ্ড হয় সেলিমের। পরে আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ২০১১ সালে ওই দণ্ড বাতিল করলে দুদক আবার উচ্চ আদালতে আপিল করে। শুনানি শেষে ২০১৫ সালে হাইকোর্টের রায় বাতিল করে আপিল বিভাগ আবারও হাইকোর্টে শুনানির নির্দেশ দেন। শুনানি শেষে ২০২১ সালের ৯ মার্চ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের দায়ে তার ১০ বছরের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট। আর সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে তিন বছরের সাজা থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়।

পরে হাজী সেলিমকে আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন আদালত। নির্দেশ অনুযায়ী আত্মসমর্পণ করলে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। হাজী সেলিমের করা লিভ টু আপিল মঞ্জুর করে তাকে গত বছরের ৬ ডিসেম্বর জামিন দেন আপিল বিভাগ। পরে মুক্তি পান তিনি।

পুরান ঢাকাসহ ঢাকা-৭ আসনের সংসদীয় এলাকায় গুঞ্জন আছে হাজী সেলিমের বিপরীতে মনোনয়ন চাইতে পারেন তার বড় ছেলে মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিম। লালবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যানার-পোস্টার লাগিয়ে প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে তাকে।

মনোনয়নের বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ সোলায়মান সেলিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমার বাবা দীর্ঘদিন এ অঞ্চলে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করে আসছেন। এখন পর্যন্ত তার কাজের জন্য যে স্পৃহা তা অনেকের মধ্যে পাওয়া যায় না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্যই ঢাকা-৭ আসনের মাঝি হিসেবে বাবাকেই মনোনয়ন দেবেন।’

‘সবকিছু ছাপিয়ে যদি তরুণ ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যদের প্রাধান্য দেওয়া হয়, একজন যোগ্য উত্তরসূরিকে প্রাধান্য দেওয়া হয় সেক্ষেত্রে আমি সদা প্রস্তুত।’

রাজনীতিতে গ্রুপিংয়ের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শেখ হাসিনা যাকেই মনোনয়ন দেবেন আমরা তার জন্যই কাজ করবো। নৌকার জন্য কাজ করবো। অতএব এখানে দলীয় কোনো ভেদাভেদ বা গ্রুপ করে দেখার বা ভাগাভাগি করার কোনো জায়গা নেই।’

আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে কোনো দলীয় পদে আছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন গর্বিত ক্ষুদ্র কর্মী। এর চেয়ে আমার বড় কোনো সাংগঠনিক পরিচয় দরকার নেই। এই ক্ষুদ্র কর্মী হওয়ার মাধ্যমেই আমি চেষ্টা করি আমাদের ঢাকা-৭ আসনের চারটি থানা এবং ১৩টি ওয়ার্ডের নেতাকর্মীদের একসঙ্গে রাখার, সুখ-দুঃখে তাদের পাশে থাকার।’

একই সংসদীয় এলাকার বিভিন্ন স্থানে ব্যানার-পোস্টার টাঙিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ‘দীর্ঘ ৫২ বছর আমি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমি ছাত্রলীগের রাজনীতি করতাম। তৃণমূল থেকে এ পর্যন্ত এসেছি। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ ও থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম ২৩ বছর। কাউন্সিলর ছিলাম দীর্ঘদিন। আবার মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলাম। সেই হিসেবে মনোনয়নের আশা করতেই পারি।’

২০১৫ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হন হাসিবুর রহমান মানিক। পরে ২০১৯ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে আবারও কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ২৬ নম্বর ওয়ার্ডসহ বিভিন্ন এলাকায় ব্যানার-ফেস্টুন লাগিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছেন এই কাউন্সিলর। মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়েও আশাবাদী তিনি।

হাসিবুর রহমান মানিক জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি এর আগে চারবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়েছি। এবারও চাইবো। আমি তৃণমূলের রাজনীতি করি। আগে ছাত্রলীগ করতাম। কোনোদিনই কোনো অপকর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না। আমার জীবনে রাজনীতি থেকে কখনো পথচ্যুত হইনি। লালবাগের মানুষ পরিবর্তন চায়।’

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক সংসদ সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বলেন, ‘আমি কর্মীদের সঙ্গে দেখা করছি। উঠান বৈঠক করছি। মনোনয়নের ব্যাপারে আশাবাদী। মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচিত হলে পুরান ঢাকাকে নতুন করে সাজানোর পরিকল্পনা আছে।’

পুরান ঢাকায় প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণের পর্যাপ্ত জায়গা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এখানে বড় রাস্তাঘাট করতে পারি না, একটা বাসার সঙ্গে আরেকটা বাসা লাগানো। আমি বেশি জোর দিতে চাই শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। এ এলাকায় মেয়েরা একটু বড় হলেই বিয়ে দিয়ে দেয়। ছেলেরা বড় হলে ব্যবসায় লাগিয়ে দেয়। এ বিষয়ে আমি বেশি চিন্তিত।’

স্থানীয় আওয়ামী লীগে গ্রুপিংয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একজন আরেকজনের বিষয়ে বলতেই পারে। যারা গ্রুপিং করে তাদের রাজনীতিতে কে এনেছে? তারা কীভাবে রাজনীতিতে এসেছে? আমি গতকাল বা পরশু থেকে রাজনীতি করি না। অনেকেই আছে অন্য দল থেকে আমাদের দলে এসে পপুলার হতে চায়। পার্লামেন্টে আমরা আইন প্রণয়ন করবো, কথা বলবো। যারা কথা বলতে পারে না তারাও পার্লামেন্টে যাবে! যার দুই আনা আওয়ামী লীগের সদস্য পদ নেই তারাও পার্লামেন্টে যাবে! তাহলে মানুষ রাজনীতি করে কেন!’

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ২৩, ২৪, ২৫, ২৬, ২৭ ২৮, ২৯, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩, ৩৫ এবং ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে এই আসন। ঢাকা মহানগরের বংশালের একাংশ, কোতোয়ালির একাংশ, চকবাজার, লালবাগ, কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ ও ধানমন্ডির একাংশ পড়েছে ওয়ার্ডগুলোতে। আসনটির পূর্বে নাজিরাবাজার, পশ্চিমে হাজারীবাগ, উত্তরে পলাশী ও দক্ষিণে কামরাঙ্গীরচর।

হাজী সেলিম, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ছাড়াও আসনটিতে আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট কাজী নজিবুল্লাহ হিরু মনোনয়ন চাইতে পারেন বলে তৃণমূলে গুঞ্জন আছে। তিনি আগে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, জগন্নাথ কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি, ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।

এমএনএইচ/এএসএ/জিকেএস