খেলাধুলা

ডালমিয়ার স্মৃতি বিজড়িত বাড়িতে কিছুক্ষণ

২০০০ সালের ২৬শে জুন। নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় দিন। এদিন বিশ্ব ক্রিকেটের অভিজাত শ্রেণি টেস্ট পরিবারের সদস্য হিসেবে আনুষ্ঠানিক পথ চলা শুরু হয় বাংলাদেশের। ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে টেস্ট অভিষেক হল বাংলাদেশের। দশম টেস্ট খেলুড়ে দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায় টাইগাররা। অথচ প্রথম থেকেই বাংলাদেশের টেস্ট স্ট্যাটাস নিয়ে প্রবল বিরোধিতা বাকি ক্রিকেট বিশ্বে। সাবেক ক্রিকেটার থেকে শুরু করে ক্রিকেট বোদ্ধা, সবারই বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিল বাংলাদেশ। অথচ আজ আমাদের টাইগাররা বিশ্বের যে কোন দলকে হারানোর ক্ষমতা রাখে। ২০০০ সাল যদি টেস্ট মর্যাদা না পেতো, তবে কী বিশ্ব ক্রিকেটে আজকের এই বাংলাদেশকে দেখা যেতো?১৯৯৯ সালে প্রথমবার আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপে খেলেছিল বাংলাদেশ। অথচ এর আগেরবার (১৯৯৬ সালে) বিশ্বকাপ খেলেছিল কেনিয়া। এমনকি সে বছর তারা তখনকার টপ ফেভারিট ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পর্যন্ত পরাজিত করে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। এরপর ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ ও কেনিয়াকে নিয়ে ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্ট খেলে ভারত। সেখানে ভারতকে হারিয়ে দিয়েছিল কেনিয়া এবং ফাইনালও খেলেছিল তারা। ২০০৩ সালের বিশ্বকাপের কথাই ধরুন না। শ্রীলংকাকে হারিয়ে তারা সেমিফাইনালও খেলেছিল তারা। অথচ সেই কেনিয়া আজ ক্রিকেট থেকেই যেন হারিয়ে গেলো। টেস্ট মর্যাদা না পাওয়ার কারণে।কাগজে কলমে তো বটেই, খেলার মাঠেও তখনকার সময়ে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল কেনিয়া এবং টেস্ট মর্যাদা পাওযারও যোগ্য দাবিদার ছিল তারা। অথচ তখন সেই কেনিয়াকে হটিয়ে বাংলাদেশের টেস্ট মর্যাদা প্রাপ্তি হয়েছিল শুধুমাত্র একজন ব্যক্তির জন্য। তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের অকৃত্তিম বন্ধু জগমোহন ডালমিয়া।সেই কেনিয়া আজ আইসিসির সহযোগী দেশ থেকে বাদ পড়ে রীতিমত বিলুপ্তির পথে। টেস্ট স্ট্যাটাস তখন বাংলাদেশ না পেয়ে কেনিয়া পেলে হয়তো এমনটি হতো না। হয়তো কেনিয়ার জায়গায় আজ থাকতো মাশরাফিরা; কিন্তু বাংলাদেশকে হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে ভালোবাসতেন বলেই তা হতে দেননি ডালমিয়া। সেই ডালমিয়া আজ নেই। গত বছর ছেড়ে গেছেন পৃথিবীর মায়া। তবে রয়ে গেছে তার স্মৃতি। সেই স্মৃতির একটু পরশ পেতে ছুটে গিয়েছিলাম তার বাড়িতে।সোমবার সকালেই ঘুম থেকে উঠেই আমরা রওয়ানা হলাম এ কিংবদন্তীর বাড়ি উদ্দেশ্যে। হোটেল থেকে খুব দূরে নয়। বাসে চড়ে গেলাম আলিপুর। সেখান থেকে স্থানীয় লোকদের কাছ থেকে জেনে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম ১০ নম্বর রোড। একটু সামনে যেতেই ডালমিয়ার সেই বিখ্যাত বাড়ি। গেটে দারোয়ান জানালেন অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া ঢোকা যাবে না। বাড়িতে ঢোকার জন্য ডালমিয়ার ছেলে অভিষেককে মুঠো ফোনে খোঁজার চেষ্টা; কিন্তু ফোন না ধরায় দারোয়ানকে বিশেষ অনুরোধ করলাম। অনেক অনুরোধের পরও তিনি অটল। আমরাও নাছোড়। উপায়ান্তর না দেখে দারোয়ান বললেন, আপনি কি আমার চাকরি খেতে চান?শেষে আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম বাড়ির সামনে, অপেক্ষা তার ছেলের ফোন ধরার। প্রায় ঘণ্টা দুই পর ডালমিয়ার ছেলে ফোন ধরলে বাড়িতে ঢোকার অনুমতি মিলল। ঢুকেই অভিভূত হয়ে গেলাম। মনে হলো- রাজ প্রাসাদ। প্রথমেই চোখে পড়লো সাদা শুভ্র একটি ঘোড়া। বাড়ির আঙিনার এক কোণে আপন মনে ঘাস খাচ্ছে। এরপর ঢুকলাম তার অন্দর মহলে। একজন মাঝবয়সী গৃহকর্মী আমাদের বসার ঘরে নিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ বসার পর আরও একজন এসে আমাদের ডালমিয়ার নিজস্ব অফিস রুমে নিয়ে গেলেন। এটাই সেই রূম, যেখানে বসে ডালমিয়া ভারতীয় ক্রিকেট এবং বিশ্ব ক্রিকেট শাসন করতেন। ঢুকেই প্রথমেই চোখে পড়লো ডালমিয়ার বড় একটি ছবি। চারপাশে সাজানো নানা রকম উপহারসামগ্রী। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) দেয়া একটি স্মারকও চোখ এড়ালো না। যেখানে লেখা,  ’ You walk beside us every step of way’ । তবে মুগ্ধতায় খনিকের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়ালো টেবিলের সামনের চেয়ারে তাকিয়ে। শুন্য চেয়ার। এক সময় এখানে বসেই বড় বড় সিদ্ধান্তের ফাইলগুলোতে স্বাক্ষর করতেন ডালমিয়া। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম, আর ভাবলাম- কিংবদন্তীর কথা। মাথায় আসলো, মানুষ কত অসহায়। বিশ্ব শাসন করলেও, এক সময় এসব একা ফেলে রেখে চলে যেতে হবে ওপারে।অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখলাম তার বাড়ির চারপাশ। নানা রকম উপহারসামগ্রী ও স্মৃতিচিহ্ন। অনেকক্ষণ কিংবদন্তীর ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকলাম। যার জন্য বাংলাদেশের ক্রিকেট আজ এতোটা এগিয়ে, যার জন্য বাংলাদেশ ক্রিকেটের সাংবাদিকতা করে নিজেকে গর্বিত করি, তাকে সামনে থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি; কিন্তু তার অফিসে দাঁড়িয়ে তাকে স্মরণ করে সম্মান জানাতে পেরেও নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছিলাম তখন।এর মাঝে কোমল পানীয় দিয়ে আমাদের আতিথেয়তা করা হলো। প্রায় আধঘণ্টা পর জগমোহন ডালমিয়ার ছেলে অভিষেক ডালমিয়া আসলেন। জানালেন উষ্ণ অভ্যর্থনা। এরপর আমাদের বাড়ির ভিতরের দিকগুলো দেখালেন। যেখানে রয়েছে ডালমিয়ার নানা স্মৃতি। জানালেন তার কিংবদন্তী বাবার নানা অজানা কথা। অনেক কথার মাঝে বললেন, ‘আমি সৌভাগ্যবান যে বাবার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ২০০৬ সাল থেকে ছায়া হয়ে ছিলাম। এমনকি যখন ছোট ছিলাম, তখন অপেক্ষা করতাম, কখন ফিরবেন বাসায়। জিজ্ঞাসা করতাম, সারাদিন কি হলো। বোর্ড মিটিংয়ে কি হলো, কে কি বললো, তার জবাব তুমি কিভাবে দিলে। ২০০১ সাল থেকে আমি বাবার অফিসে জয়েন করি। তখন তার সঙ্গে একসাথে কাজ করা শুরু হয়। ২০০৬ থেকে পরিপূর্ণভাবে কাজ শুরু করেছিলাম। তার জন্যও কঠিন সময় যাচ্ছিল। গত ১০ বছর অন্তরালে উনার অফিসের কাজটাও আমি দেখতাম কিছুটা। সেখান থেকে শিখেছি কীভাবে সমস্যা সমাধান করতে হয়, কঠিন অবস্থা থেকে বের হয়ে আসা যায়। ২০১৩ সালে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হওয়ার পরও উনার সাথে ছিলাম। বিসিসিআইয়ের টালমাটাল অবস্থা ছিল। আমি সেটাও দেখেছি।’দেখতে দেখতে অনেক সময় পার হয়ে গেল। বিদায় নেবার সময়ও অভিষেক আমাদের এগিয়ে দিয়ে গেলেন। ফিরে আসলাম কিছু স্মৃতি নিয়ে যা কখনো ভোলার নয়। ভাবছিলাম বাংলাদেশ হয়তো একদিন বিশ্বকাপ জিতবে; কিন্তু সবচেয়ে বেশি খুশি যিনি হতেন বাংলাদেশের এই সাফল্য দেখে, সেই তিনিই থাকলেন না। বলতে পারলেন না আমি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম একদিন, দেখো সেটাই সঠিক হল। সে দায়িত্ব তিনি দিয়ে গেছেন আমাদের। আমাদের কোটি বাংলাদেশিদের। তিনি বেঁচে থাকবেন কোটি বাঙালি হৃদয়ে। আরটি/আইএইচএস/এমআর/এমএস

Advertisement