মতামত

আবার হরতাল যুগে বাংলাদেশ!

বাংলাদেশের এখন এক নাম্বার সমস্যা কী? সাধারণ মানুষের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে বিবেচনা করলে অবশ্যই দ্রব্যমূল্য। আরো একটু বড় করে বললে অর্থনৈতিক সঙ্কটই এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা। রিজার্ভ কমছে আর দ্রব্যমূল্য বাড়ছে। ‘দ্রব্যমূল্য বাড়ছে’ এটুকু বললে অবশ্য পুরোটা বলা হয় না। দ্রব্যমূল্য আসলে আকাশ ছুঁয়ে আছে অকে আগেই। নির্দিষ্ট আয়ের সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস দশা। কেউ জানে না, এই সঙ্কট কবে শেষ হবে।

Advertisement

জানলে তবু একটা প্ল্যান করা যেতো। কিন্তু সেই প্ল্যান করারও কোনো উপায় নেই। কেউ জানে না পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে। দ্রব্যমূল্য সবচেয়ে বড় সঙ্কট বটে। কিন্তু গণমাধ্যমের শিরোনাম, টক শোর আলোচনা দেখলে বোঝার উপায় দেশ এমন এক মহাসঙ্কটে আছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অর্থনীতির সঙ্কটের আসল চিত্রটা নেই।

আমরা সবাই ব্যস্ত রাজনীতি নিয়ে। বিএনপি আর আওয়ামীর লীগের পাল্টাপাল্টি একদফাই যেন দেশের মূল সঙ্কট। রাজনীতিতে সঙ্কট আছে, অচলাবস্থা আছে। কিন্তু আগে তো মুখে খাবার জোগাতে হবে। তারপর রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করা যাবে। আমাদের নীতি নির্ধারক, রাজনীতিবিদ সবার উচিত আগে একসাথে বসে অর্থনীতির সঙ্কট নিরসনের উপায় বের করা।

পণ্ড হয়ে যাওয়া সমাবেশ থেকে বিএনপি রোববার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেই পালিয়েছে। একদিনের সকাল-সন্ধ্যা হরতালেই কি সরকারের পতন হয়ে যাবে? তাহলে এই অর্থহীন হরতাল পালন করে লাভ কী? এই হরতালে বিএনপির কোনো লাভ না হলেও দেশের অনেক ক্ষতি হবে। আমাদের ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি আরো ঝুঁকিতে পড়বে। জিনিসপত্রের দাম আরো বাড়বে।

Advertisement

তবে অর্থনীতির সঙ্কট আছে বলেই রাজনীতি থেমে থাকবে তেমন তো কোনো কথা নেই। রাজনীতিও রাজনীতির মত চলবে। ভালো হতো যদি রাজনীতিবিদরাও দ্রব্যমূল্যকে তাদের প্রায়োরিটিতে রাখতেন। কিন্তু তাদের কোনো আলোচনায় দ্রব্যমূল্যকে রাখতেন। কিন্তু তাদের দুই পক্ষেরই একদফার মূল কথা ক্ষমতা।

বিএনপির একদফা হলো বর্তমান সরকারের পদত্যাগ। আর আওয়ামী লীগের একদফা হলো, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন। কার প্রায়োরিটি কোনটা হবে সেটা নিয়ে আমার কোনো কথা নেই। সবাই নিশ্চয়ই নিজ নিজ স্বার্থটাই দেখবে। তবে সরকারের পদত্যাগ চাওয়ার দাবি করা এবং সেই দাবি আদায়ে কর্মসূচি পালন করার অধিকার সবারই আছে। প্রতিবাদ করার, সমাবেশ করার, মতপ্রকাশ করার অধিকার আমাদের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। কিন্তু সংবিধানেও এই অধিকার দেয়া হয়েছে জনশৃঙ্খলার শর্তসাপেক্ষে।

আপনি প্রতিবাদ করবেন, কিন্তু আপনি আইন হাতে তুলে নিতে পারবেন না, কাউকে আঘাত করতে পারবেন না, সম্পদের ক্ষতিসাধন করতে পারবেন না। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে প্রতিবাদ মানেই সহিংসতা, প্রতিবাদ মানেই ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ। যত বেশি সহিংসতা, আন্দোলন তত বেশি তীব্র। এমনটাই ছিল পারসেপশন। অহিংস আন্দোলন করে নাকি দাবি আদায় করা যায় না। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের আন্দোলন বা আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির আন্দোলন অহিংস ছিল না। দিনের পর দিন হরতাল, অবরোধ, অগ্নিকাণ্ড, সন্ত্রাসের পথ বেয়েই আন্দোলন চলেছে। সন্ত্রাসের পথেই জয়পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে।

বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে ২০১৪, ২০১৫ সালে বিএনপির আন্দোলনের নামে অগ্নিসন্ত্রাস বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসেই এক কালো অধ্যায়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে রাজনীতির নামে সহিংসতার এই ধারণা পাল্টে গেছে। বিএনপিও বুঝতে পেরেছে ২০১৪, ২০১৫ সালে অগ্নিসন্ত্রাস করে দাবি তো আদায় হয়ইনি, উল্টো তাদের নামের সাথে সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা জুটেছে। দেশে-বিদেশে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীর নামে মামলা হয়েছে। সেই ধকল সামলাতে তাদের অনেক সময় লেগেছে।

Advertisement

গতবছর থেকে বিএনপি নতুন করে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছে। গতবছর বিভাগীয় সমাবেশ করে সারাদেশে বিপুল চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল বিএনপি। তাদের প্রতিটি সমাবেশেই বিপুল লোকসমাগম হয়েছিল। নেতাকর্মীরাও দারুণ চাঙা হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় গত জুলাই থেকে সরকার পতনের একদফা আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। এবার তারা নতুন রূপে আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনের এই পর্যায়ে বিএনপি অনেক সংযত ছিল। বিএনপি বারবার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের অঙ্গীকার করেছে।

সাম্প্রতিক অতীত বিবেচনায় আওয়ামী লীগও অনেক সংযত আচরণ করেছে। দুই পক্ষের এই সংযত আচরণের পেছনে অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতিরও একটা দারুণ প্রভাব আছে। বাংলাদেশের জন্য ঘোষিত নতুন ভিসানীতিতে বলা হয়েছে, যারা বাংলাদেশের অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করবে; তারা মার্কিন ভিসা পাবে না। এই ভিসা নীতি সরকারি ও বিরোধী দল সবার জন্যই প্রযোজ্য। ভিসা নীতির প্রভাবে রাজপথে দুই পক্ষই সংযত ছিল। কিন্তু ২৮ অক্টোবর যেন রাজনীতির এই সংযমের বাধ ভেঙ্গে গেল। বিএনপি ফিরে এলো তাদের পুরোনো চেহারায়। আবার হত্যা, অগ্নিসংযযোগ, ভাংচুর, ককটেল, টিয়ার গ্যাস; আবার হরতাল।

২৮ অক্টোবরকে সামনে রেখে গত কয়েকদিন ধরেই রাজনীতিতে উত্তেজনা চলছিল। কিন্তু সেটা যে মাঠে এভাবে ফলে যাবে, এটা ভাবেননি অনেকে। আওয়ামী লীগ অনেকদিন ধরেই চাইছিল, বিএনপি যেন কোনো একটা ঝামেলা করে, যাতে তাদেরকে আবার সন্ত্রাসী দল হিসেবে চিত্রিত করা যায় এবং সেই সূত্রে আবার দমন-পীড়ন চালানো যায়। বিএনপি আওয়ামী লীগের সেই চাওয়া নিপুনভাবে পূরণ করেছে। ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ নির্বিঘ্নে তাদের শান্তি সমাবেশ করেছে। আর পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে নিজেদের সমাবেশ ফেলে পালিয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীরা। এখন ২৮ অক্টোবরের এই সংঘাতে কার লাভ হলো, কার ক্ষতি হলো?

ক্ষতিটাই আগে বলি। ক্ষতি পুরোটাই হয়েছে বিএনপির। এমন নয়, ২৮ অক্টোবরের ঘটনা তাদের আন্দোলনকে চাঙা করে দেবে। বরং ২৮ অক্টোবরের সহিংসতার ফলে বিএনপি আরো পিছিয়ে যাবে। প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ হত্যা, গাড়িতে আগুন, ভাংচুর, ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে সরকার এখন বিএনপির ওপর আরেকদফা নিপীড়ন চালানোর যুক্তি খুঁজবে। আন্তর্জাতিক মহলের কাছেও এই যুক্তিগুলো তারা তুলে ধরতে পারবে। লাভ হয়েছে পুরোটাই সরকারের। তারা যেটা চাচ্ছিল, বিএনপি সেটা করে দিয়েছে।

২৮ অক্টোবরের মহাসমাবেশ থেকে বিএনপির আন্দোলনের মহাযাত্রা শুরুর কথা ছিল। কিন্তু এখন হচ্ছে আন্দোলনের উল্টোযাত্রা। বিএনপি মহাসচিবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের আরো অনেকে হয়তো গ্রেপ্তার হয়ে যাবেন। নেতাকর্মীদের নামে মামলা হবে। আরো অনেকে গ্রেপ্তার হবেন, অনেকে পালিয়ে বেড়াবেন। আন্দোলনের মাঠে নেতৃত্ব দেয়ার মত লোক খুঁজে পাওয়াই কঠিন হবে এখন। বিএনপির একদফা আন্দোলনের গন্তব্য কোথায় এখন? তাদের পরবর্তী কর্মসূচি কী? সরকার যদি পদত্যাগ না করে নির্ধারিত সময়ে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায় বিএনপি কী করবে? কীভাবে ঠেকাবে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়ার মতও কেউ নেই এখন।

২৮ অক্টোবর স্বাভাবিকভাবে মহাসমাবেশ শেষ হলে বিএনপি কী কর্মসূচি দিতো, তা এখন আর জানার উপায় নেই। কিন্তু পণ্ড হয়ে যাওয়া সমাবেশ থেকে বিএনপি রোববার সারাদেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেই পালিয়েছে। একদিনের সকাল-সন্ধ্যা হরতালেই কি সরকারের পতন হয়ে যাবে? তাহলে এই অর্থহীন হরতাল পালন করে লাভ কী? এই হরতালে বিএনপির কোনো লাভ না হলেও দেশের অনেক ক্ষতি হবে। আমাদের ধুঁকতে থাকা অর্থনীতি আরো ঝুঁকিতে পড়বে। জিনিসপত্রের দাম আরো বাড়বে।

রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার সুবাদেই বাংলাদেশের অর্থনীতি দারুণ মোমেন্টাম পেয়েছিল। কিন্তু বৈশ্বিক পরিস্থিতি সেই গতি রুদ্ধ করে দিয়েছে। অর্থনীতির এই দুঃসময়ে আমাদের যখন আরো বেশি করে স্থিতিশীলতা দরকার, তখনই আবার হরতাল-সহিংসতার যুগে ফিরলো বাংলাদেশ। শুধু অর্থনীতি নয়, বছরের শেষ প্রান্তে এসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যখন বার্ষিক পরীক্ষার প্রস্তুতি, তখন এই হরতাল আবার সেখানে বিঘ্ন ঘটাবে। আমার ভয়টা এখানেই। হরতালের জড়তা যখন কেটে গেছে, সামনে বিএনপি নিশ্চয়ই আরো হরতাল বা অবরোধ নিয়ে মাঠে নামবে। বা মাঠে নামতে না পারলে দূর থেকে কর্মসূচি ঘোষণা করে নিজেরা পালিয়ে থাকবে। তবে এর মূল্য দিতে হবে জনগণকে।

২৯ অক্টোবর, ২০২৩ লেখক: বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/এএসএম