ফিচার

পৃথিবীর বিচ্ছিন্নতম দ্বীপ, যেন গোটা একটি দেশ

চারদিকে নীল জলরাশি, এর মাঝে বুক উঁচু করে আছে ছোট্ট এক টুকরো ভূখণ্ড। নাম তার ত্রিস্তান দ্য কুনহা দ্বীপ। এর সবচেয়ে নিকটতম দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। কেপ টাউন (দক্ষিণ আফ্রিকা) থেকে প্রায় ২৭৮৭ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান।

Advertisement

এই দ্বীপে যাতায়াতের এক মাধ্যম মাছ ধরার নৌকা বা ক্রুজ জাহাজ। দুর্গম অবস্থানের কারণে একে পৃথিবীর বিচ্ছিন্নতম দ্বীপও বলা হয়। ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে দ্বীপটিতে বাস করছেন কিছু ব্রিটিশ নাগরিক। নিশ্চয় ভাবছেন, সমুদ্রের বুকে পৃথিবীর দূরতম প্রান্তের এই মানুষগুলো কীভাবে টিকে আছে? আটলান্টিকের বুকে এই ছোট্ট দ্বীপে কীভাবেই বা তারা পৌঁছালো?

আরও পড়ুন: রহস্যময় যে প্রাচীর নির্মাণ করতে গিয়ে মৃত্যু হয় ৪ লাখ মানুষের

দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসমুদ্রের মাঝে ত্রিস্তান দ্য কুনহার অবস্থান। সর্বমোট ৬টি ছোট ছোট দ্বীপ নিয়ে দ্বীপপুঞ্জটি গঠিত। এর মধ্যে তিনটি আগ্নেয় দ্বীপ। মাত্র ৩৮ বর্গমাইলের ‘ত্রিস্তান দ্য কুনহা’ এই দ্বীপপুঞ্জের সবচেয়ে বড় দ্বীপ। ১৫০৬ সালে পর্তুগিজ সেনাপতি ত্রিস্টাও দ্য কুনহা দ্বীপটি আবিষ্কার করেন। তার নাম অনুসারেই এই দ্বীপের নামকরণ।

Advertisement

১৮১৬ সালে এটিকে ব্রিটেন দখল করে । শুরুতে সামরিক কাজে ব্যবহৃত হলেও পরে দ্বীপটিতে বেসামরিক লোকজন বসবাস শুরু করে। ত্রিস্তান দ্য কুনহা বর্তমানে ব্রিটিশ ওভারসিস টেরিটরির অংশ। এর যাবতীয় প্রশাসনিক কাজ ২ কিলোমিটার দূরের সেন্ট হেলেনা দ্বীপ থেকে পরিচালিত হয়।

ত্রিস্তান দ্য কুনহা দ্বীপটি প্রায় বৃত্তাকার। এর মূল কেন্দ্রে আছে ৬৭৬০ ফুট উচ্চতার একটি আগ্নেয় মুখ। যেটি সব শেষ জেগে উঠেছিল ১৯৬১ সালের ১০ অক্টোবর। প্রচণ্ড কম্পন আর লাভা থেকে বাঁচতে অনেকেই তখন দ্বীপটি ছেড়ে যান।

চারদিক পাহাড় বেষ্টিত দ্বীপের উত্তর-পশ্চিমে রয়েছে সমতল ভূমি। তাতেই গড়ে উঠেছে একমাত্র স্থায়ী মানব বসতি। রানি ভিক্টোরিয়ার পুত্র প্রিন্স আলফ্রেড ১৮৬৭ সালে এই দ্বীপটিতে ভ্রমণে যান। তার সম্মানেই এই দ্বীপের বসতির নাম হয় ‘এডিনবার্গ অব সেভেন সিস’।

আরও পড়ুন: ভয়ংকর চেহারার পুতুলের বাস যে দ্বীপে

Advertisement

বর্তমানে আনুমানিক ২৫০ জন ব্রিটিশ নাগরিক স্থায়ীভাবে ত্রিস্তান দ্য কুনহা দ্বীপে বসবাস করছেন। এখানকার মানুষের প্রধান পেশা কৃষি। আলু প্রধান কৃষিজ পণ্য। পাশাপাশি স্ট্রবেরি ও পিচ ফল এখানকার মানুষরা চাষ করে থাকেন। মাছ ধরা, পশু পালন ইত্যাদি পেশার সঙ্গে সম্পৃক্ত তারা। নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে এগুলো তারা রপ্তানিও করে থাকেন। স্থানীয় ত্রিস্তান রক লবস্টার এর মধ্যে অন্যতম। দ্বীপবাসীর বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান উৎসও এটি।

বাসিন্দাদের জন্য প্রয়োজনীও সবকিছুই আছে এখানে। শিশুদের লেখাপড়ার জন্য আছে স্কুল, দ্বীপের বাইরে চিঠি আদান-প্রদানের জন্য আছে পোস্ট অফিস, প্রার্থনার জন্য চার্চ, আছে কমিনিউটি হল, ক্যাফে, হাসপাতাল, এমনকি জাদুঘর। যেন গোটা একটি দেশ।

বাতাসের শব্দ এবং গৃহপালিত পশু গরুর ডাক ছাড়া এই দ্বীপে তেমন কোন শব্দ বেশি শোনা যায় না। তবে দ্বীপপুঞ্জের যেখানেই যাবেন সেখানেই আপনি প্রচুর পাখি দেখতে পাবেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পেঙ্গুইন।

তবে গোটা জনপদে একটি মাত্র পাকা সড়ক। আর যাতায়াতের জন্য একটি মাত্র বাস সার্ভিস। বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থাও রয়েছে দ্বীপটিতে। বিনোদনের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় টেলিভিশন সম্প্রচার। স্থানীয় সংবাদপত্র, ইন্টারনেটের বন্দোবস্তও আছে দ্বীপটিতে।

কিন্তু ত্রিস্তান দ্য কুনহা দ্বীপে কোনো বিমানবন্দর নেই। তাই দ্বীপটিতে যাওয়ার একমাত্র উপায় নৌপথ। দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউন থেকে জাহাজে করে এই দ্বীপে আসতে সময় লাগে ৬-৭ দিন। প্রয়োজনীও রসদ ও পর্যটক পরিবহণের একমাত্র উপায়ও এটি।

ত্রিস্তান দ্য কুনহা দ্বীপটি ভৌগলিকভাবে দুর্গম তেমনি এখানে প্রবেশের অনুমতি পাওয়াও কষ্টসাধ্য। দ্বীপটিতে ভ্রমণের জন্য কোনো ভিসার ব্যবস্থা নেই। তাই এই দ্বীপে যেতে জাহাজের সময় সূচি মাথায় রেখে আবেদন করতে হবে ত্রিস্তান দ্য কুনহার আইল্যান্ড কাউন্সিল বরাবর। কখনো কখনো এই দ্বীপে ভ্রমণ করতে পেড়িয়ে যায় বছর। এখানে স্থানীয় পরিচিতদের বাড়ি, গেস্ট হাউজ, জাদুঘরে পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা ররেছে। ২০-২২ দিনের একটি ভ্রমণে জনপ্রতি খরচ পড়বে প্রায় ৮-২০ হাজার ডলার।

সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া, ব্রিটানিকা

কেএসকে/জেআইএম