জোবায়ের মিলন একাধারে কবি, কথাশিল্পী, বাচিকশিল্পী এবং গণমাধ্যমকর্মী। তার জন্ম ১৯৮১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ডেমরায়। তিনি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকোত্তর। এ পর্যন্ত দুটি কবিতার বই ‘স্বৈরাচারী দুঃখ ও বিবিধ’ (২০২২), ‘ঘন সাপের দেউড়ি’ (২০২৩) প্রকাশিত হয়েছে।
Advertisement
নিয়মিত লিখছেন বিভিন্ন দৈনিক এবং ম্যাগাজিনে। কবিতায় সময় বেশি ব্যয় করলেও সমসাময়িক বিষয়ে কলাম লেখেন সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে। শিশুর মানসিক বিকাশে করণীয় বিষয়ে ফিচার লেখেন। ছোটগল্প, ছড়া ও শিশুতোষ গল্পেও হাত চালান বিশেষ আগ্রহে। যুক্ত আছেন আবৃত্তি সংগঠন ‘স্বরশ্রুতি’র সঙ্গে।
সম্প্রতি বইমেলা ও বই প্রকাশ সম্পর্কে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন কবি ও কথাশিল্পী সালাহ উদ্দিন মাহমুদ—
জাগো নিউজ: আগামী বইমেলায় আপনার কয়টি বই প্রকাশিত হচ্ছে?জোবায়ের মিলন: বইমেলায় আমার একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হবে বলে আশা করছি। এ মুহূর্তে পাণ্ডুলিপির শেষ সম্পাদনার কাজ চলছে। প্রকাশনীর সঙ্গেও কথা বলছি। অনেক প্রকাশনীই প্রকাশের খরচ দাবি করছে। কিন্তু টাকা দিয়ে বই প্রকাশ করতে আগ্রহী নই বলে সময় লাগছে। কেননা আমার পূর্বের দুটি বই খরচ দিয়ে প্রকাশ করিনি। এটিও খরচ দিয়ে করবো না। একজন লেখক তার সমস্ত মেধা ও শ্রম দিয়ে সাহিত্য রচনা করবেন আবার খরচও বহন করবেন! এটা তো হতে পারে না। অনেকে হয়তো করেন, যারা করেন; তারা করুক। আমার কথা হলো, প্রকাশনী পাণ্ডুলিপি জমা নিতে পারে, তাদের প্যানেল থেকে যাচাই করতে পারে, মান দেখতে পারে কিন্তু লেখকের কাছ থেকে খরচ দাবি করতে পারে না। এতে লেখা ও প্রকাশ—দুইয়ের কারোরই গুণগত দিকটি থাকে না। ধরুন, আমি টাকা দিয়ে বই করলাম, প্রকাশক ছেপে দিলেন, এতে কি খুব সহজে ভালো কিছু প্রকাশ সম্ভব? যদিও বিশ্বসাহিত্যের বাজারে অনেক ভালো বই অনেক লেখককে নিজ খরচে প্রকাশ করতে হয়েছে। হয়তো প্রচলনটাই এমন। তবে আমি আশা করছি, নিঃশর্তে একটি প্রকাশনী পেয়ে যাবো। সেরকম কথা অল্প সময়ের মধ্যে হয়তো জানতেও পারবো।
Advertisement
আরও পড়ুন: বইমেলায় নিরাপদ পানির ব্যবস্থা থাকা উচিত: মামুন রশীদ
জাগো নিউজ: বাংলা একাডেমি আয়োজিত আগামী বইমেলা কেমন দেখতে চান?জোবায়ের মিলন: এখানে বইমেলা সম্পর্কে একটি চিত্র আমরা চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই। সব সময় যেমন দেখি, আগামী বছরও তার ব্যতিক্রম দেখবো বলে মনে হয় না। কারণ বাংলা একাডেমি এটির মূল পরিচালক, বাংলা একাডেমি রাষ্ট্রের ছায়ায় চলে, তারা চাইলেও (যে কোনো আমলে) নির্দিষ্ট কাঠামো থেকে বের হতে পারবে না। একার পক্ষে দশের মতো রাখা তো আর সম্ভব নয়। শুধু এখানেই নয়, যে কোনো প্রেক্ষাপটেই না। তারপরও আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই, বইমেলা ঠিক হাট-বাজারের মেলার মতো না হোক। বইমেলার একটি একক স্বকীয়তা থাকুক। সৌন্দর্য থাকুক। সৌন্দর্য বলতে আমি রূপের-রঙের কথা বলছি না। গুণাগুণের কথা বলছি। বলছি, বইয়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি করতে বিশেষজ্ঞদের মত নিয়ে কিছু ইভেন্ট তৈরি হোক। বইমেলায় বিশাল বিশাল খাবারের দোকানের আড়ালে আমাদের বইয়ের বিষয়গুলো ঢাকা না পড়ে যাক। বইয়ের ক্রয়-বিক্রয় বাড়াতে কী কী করা যায়, সেরকম মার্কেটিং পলেসি প্রয়োগ করা হোক। ভালো ভালো বইয়ের সন্ধান দেওয়া হোক, আগন্তুকদের। শৃঙ্খলায় আরও মনোযোগ দেওয়া হোক। প্রকাশিত বইগুলো একটি সেলের মাধ্যমে প্রকাশ হোক। জানি, সততার ঘাটতি হলে কোনো ব্যবস্থাই কোনোভাবে সফল হতে পারবে না। সে সততার জায়গাটিকে ঠিক করে ব্যবস্থা নিতে পারলে ভালো কিছু পেতে পারি আমরা। আমাদের একটি বইমেলা হয়, সে বইমেলায় ভরপুর পুলিশ, গোয়েন্দা থাকতে হয়, হাতব্যাগ থেকে মানিব্যাগ পর্যন্ত খুঁটে খুঁটে দেখতে হয়, কেন? এটি আমি ও আমাদের সবার জন্য দুঃখজনক অথবা একটি কাঠোমোর জন্যও দুঃখজনক। ভালো বই আসুক, ভালো বই আসতে ও প্রচার হতে পরিবেশ তৈরি হোক, সেটি চাই।
জাগো নিউজ: আপনার দেখা বিগত বইমেলায় কোনো অসঙ্গতি চোখে পড়েছে?জোবায়ের মিলন: গত বইমেলার আগের বইমেলায় অর্থাৎ ২০২২ সালে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পূর্বদিকে, মৎস্য ভবনের ওদিকে একটি গেইট রাখা ছিল। পূর্ব এবং দক্ষিণ দিক থেকে আসা লোকেরা সহজেই মেলায় প্রবেশ করতে পেরেছেন, বের হতে পেরেছেন। কিন্তু ২০২৩ সালে কী হলো? পূর্বদিকের গেইট সময়ে সময়ে বন্ধ, সময়ে খোলা। এটি প্রচণ্ড বিরক্ত করেছে অনেককে। আমি নিজেও ধোকা খেয়েছি ও অনেককে একেবারে ফিরে যেতেও দেখেছি। যা খুবই বিব্রতকর ছিল। লেখক বলছি মঞ্চটির কী হলো গতবার! আপনারাও অবশ্যই দেখেছেন। লেখক, প্রকাশক, দর্শকসহ সবাই দেখেছেন, বড় বড় খাবার হোটেলের গলিতে একটি খুপড়ি বসালেন। পরে তা পরিবর্তন করলেন, সেটিও সুখকর জায়গায় ছিল না। লিটল ম্যাগের কথা না-ই বলি। এটি তো প্রতি বছরই অবহেলিত। এখান থেকে সেখানে, সেখান থেকে এখানে। তবে ভাই, শুরুতেই কেন সেটি যত্নসহকারে দেখা হয় না? সমালোচনার পর কেন সিদ্ধান্ত চেঞ্জ করতে হয়? বইমেলাটি আরও পরিপাটি, আরও গুণগত মানের দিকে খেয়ালি না হলে ভবিষ্যতে এর চাহিদা কতটুকু ধরে রাখা যায়, সেটি সন্দেহ করছি একজন সামান্য লেখক হিসেবে, একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে। এরই মধ্যে আমরা অনেকের কাছে শুনতে পাই, যারা সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য জড়িত, তারা অনেকে মেলায় আসেন না। এলেও দু-একবার। কেন? শেকড়টি সন্ধানের প্রয়োজন আছে।
আরও পড়ুন: মেলাকে পাঠক উপযোগী করা হোক: খান মুহাম্মদ রুমেল
Advertisement
জাগো নিউজ: বইয়ের প্রচারণাকে কোন দৃষ্টিতে দেখেন?জোবায়ের মিলন: নিঃসন্দেহে ভালো দিক থেকে দেখি। কেন দেখব না? বইও তো পণ্য, তবে এ পণ্য অন্য পণ্যের চেয়ে ভিন্ন। এটি জাতি গঠনের অন্যতম উপাদান। মেধা, মনন তৈরির ওষুধ। মন, মানসিকতা, মানবিকতা তৈরির খোরাক। তাহলে বইয়ের প্রচারণা করলে দোষের কী? আমাদের এ সময়ের যারা লেখক; তারা কি তাদের বইয়ের প্রচারণা করছেন না। আমাদের আগের প্রজন্মের যারা, তারা কি করেননি? তারও আগের যারা; তারাও তো করেছেন। সব যুগে, সব কালে লেখকের পক্ষে তার লেখার বা বইয়ের প্রচারকার্য ছিল, আছে, থাকবে। যারা এতে নাক ছিটকান, তারা যেন ইতিহাস ঘেটে দেখেন। আমাদের এখানে আবার একটি শ্রেণি আছে দেখবেন, যারা তারুণ্যে চুটিয়ে বেরিয়েছেন কিন্তু একটু ডাক-নাম হওয়ার পর বা একটু সিনিয়র হওয়ার পর সব খারিজ করে দিচ্ছেন এবং তিনিও যে শুরুর দিকে তা করেছেন, তা যেন স্বীকারই করতে চান না। বললে বলেন, ভুল করেছি। কেন বলেন জানেন? কারণ তারা জাতে উঠে গেছেন। জামায় টোকা দিয়ে চলতে পারেন বলে। দ্বিতীয় কথা হলো, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবকিছুই যেমন পাল্টায়, বইয়ের প্রচার-প্রচারণার দৃশ্যটিও পাল্টাবে, এটাই তো স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে কায়দায় বইয়ের প্রচারে কাজ করতেন, নিশ্চয়ই আমি সে কায়দায় করবো না এই ২০২৩-২৪ সালে এসে, তাই না? আমি প্রত্যেককে বলবো, আপনার বইয়ের প্রচার আপনি করুন। লোকে জানুক, কিনুক। যদি ভালো লাগে, লোকে আবার আপনার সৃষ্টির কাছে আসবে। আর যদি ভালো না লাগে, লোকে আসবে না, ব্যাস। কেউ কেউ মনে করেন, মাগি-মদ, গাজা, ঘুষ খেলে জাত যায় না, বইয়ের প্রচার করলে বুঝি জাত চৌচির হয়ে যায়।
জাগো নিউজ: বইমেলায় পাঠকের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?জোবায়ের মিলন: পাঠক আমার কাছে সব সময়ই শ্রদ্ধার। শুধু লেখক হিসেবে বলছি না, পাঠক হিসেবেও বলছি। পাঠকের প্রতি কোনো পরামর্শ নেই। আমাদের পাঠকেরা যথেষ্ট জ্ঞানী, সচেতন, শিক্ষিত। আমি সবাইকে কিন্তু পাঠক বলছি না। এখন এখানে কেবল বইমেলায়ই বই বিক্রি হয় এমন না। এখানেও আমি আবার বলছি, কেউ কেউ উচ্চ গলায় বলে থাকেন, ‘আমাদের বই তো শুধু বইমেলায় বিক্রি হয়, বইমেলায় প্রকাশ হয়।’ সত্য না। বইমেলায় বেশি বই প্রকাশ হয়, মিথ্যা না। ভালো বই সারাবছরই প্রকাশ হয়। সারাবছরই বই বিক্রি হয়। না হলে বইয়ের বড় বড় শপ কীভাবে হচ্ছে? মিষ্টির দোকানের মিষ্টির মতো নিশ্চয়ই ভূতে বইও কেনে না, কী বলেন। বই মানুষেই কেনে, পাঠকেই কেনে। একটি বইয়ের দোকানে কিছু সময় নিয়ে বসে দেখবেন, কারা বই কেনেন, কখন কেনেন, কিভাবে কেনেন। খালি খালি বুলি আউড়িয়ে মাঠ গরম করার এক ধরনের পাবলিক আছে, তাদের কাজ বাজার গরম করা, মিলুক বা না মিলুক। আমার লেখার পাঠককে বলবো, শুধু আমার না, যে কোনো লেখকের ভালো বই পড়ুন। বাজারদর, আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক কিংবা বিশ্বপরিস্থিতি, অস্ত্রের ও পুঁজির হুঙ্কার আমাদের অনেক কিছু এলোমেলো করে দিচ্ছে বটে। তবু দুইটার জায়গায় একটি বই কিনুন, পড়ুন। যারা পড়তে পারেন, তাদের জীবনে কোনো দুঃখ-কষ্ট থাকে না।
এসইউ/জেআইএম