জাতীয়

ঘোড়ার পিঠে আঘাত করলেই ঘোরে জীবিকার চাকা

ঢাকার সদরঘাট থেকে গুলিস্তানে ছুটে চলে প্রায় ২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী ঘোড়ার গাড়ি (টমটম)। একসময় এর ব্যাপক কদর ছিল। এখনো ঐতিহ্য আছে, তবে তেমন কদর নেই। চরম অনাদর-অবহেলায় চলছে টিকে থাকার লড়াই। যুগের পালাবদলেও অন্য বাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে রাস্তায়। তবে, এসব বাহনে চড়ে খুশি যাত্রীরা। যার কাঁধে ভর করে চলছে এসব গাড়ি, সেই ঘোড়ার প্রতি চলছে চরম অবহেলা। রুগণ দেহ আর ক্ষুধা নিয়ে ছুটে চলছে গুলিস্তান থেকে সদরঘাট। ঘোড়ার পিঠে আঘাত করলেই ঘোরে অনেকের জীবিকার চাকা।

Advertisement

তবে, ঘোড়ার চিকিৎসা নিয়ে কথা হলে ভেটেরিনারি চিকিৎসকরা বলেন, ঘোড়ার নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা দরকার। যেহেতু তাদের অধিক পরিশ্রম করতে হয়। কিন্তু পশু হাসপাতালে সেভাবে ঘোড়া নিয়ে আসেন না মালিকরা।

কেন্দ্রীয় ভেটেরিনারি হাসপাতালের চিকিৎসক ভেটেরিনারি সার্জন ডা. মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, টমটমের ঘোড়াগুলো দেখতেই বড্ড দুর্বল। প্রাণীগুলো যেহেতু প্রতিনিয়ত ভারী বোঝা টানে, তাই ওদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা দরকার। কম হলেও মাসে একবার চেকআপ করানো উচিত। তীব্র গরমে পর্যাপ্ত পানি ও স্যালাইন খাওয়ানো দরকার।

‘টমটম গাড়ি যদি চলতেই হয় সিটি করপোরেশন থেকে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন তৈরি করতে হবে। ঘোড়ার সুস্থতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।’

Advertisement

সরেজমিনে দেখা গেছে, সদরঘাটের কলেজিয়েট স্কুলের সামনে থেকে গুলিস্তান গোলাপ শাহ মাজার পর্যন্ত চলাচল করে টমটম। এ রুটে রয়েছে প্রায় ২৫টি ঘোড়ার গাড়ি। রোদ, ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করে ছুটছে গাড়িগুলো। তবে, টমটমসহ ১৫ থেকে ১৮ জন যাত্রী নিয়ে চলাচল করতে বেশ বেগ পেতে হয় ঘোড়াকে। একটু ধীরে চললেই চলন্ত ঘোড়ার পিঠে চাবুক চালান কোচোয়ান (ঘোড়াচালক)।

আরও পড়ুন>> আধুনিক ঢাকার বুকেও টিকে আছে ঘোড়ার গাড়ি

যান্ত্রিক শহরে কালের সাক্ষী হয়ে থাকলেও অযত্নেই রয়েছে ঘোড়া। সড়কে অন্য যানবাহনের উচ্চশব্দের কারণে মাঝে মধ্যে বেপরোয়া আচরণও করছে। আবার ধীরগতিতে চলার কারণে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। সবমিলে ঘোড়ার ওপর অত্যাচারের বিভীষিকা নেমে আসে। যাত্রীরা জানান, ক্লান্ত শরীর নিয়ে অনেক সময়ই থেমে যায় ঘোড়া। কিন্তু কোচোয়ানের চাবুকের আঘাতে বাধ্য হয়ে আবার চলতে হয়।

গুলিস্তানে কথা হলে টমটমের যাত্রী মামুনুর রশীদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমি বরিশাল থেকে এসেছি। বাবার গুলিস্তানে দোকান আছে। সদরঘাট থেকে টমটমে এসেছি। আজই প্রথম টমটমে উঠেছি। রাস্তায় যানজটের কারণে আসতে দেরি হয়েছে। তবে, প্রাণীগুলোর স্বাস্থ্যের অবস্থা ভালো নয়। ওদের দৌড় দেখেই বোঝা যাচ্ছে, শরীরের অবস্থা খারাপ। চাবুক মারা ছাড়া চলে না। দেখে খুব কষ্ট হচ্ছে।’

Advertisement

আরও পড়ুন>> পুরান ঢাকার বিখ্যাত ঘোড়ার গাড়ির বেহাল দশা

আরেক যাত্রী আলমগীর বলেন, সদরঘাট ফুটওভার ব্রিজ থেকে গোলাপ শাহ মাজার পর্যন্ত জনপ্রতি ভাড়া ৩০ টাকা। ভাড়া একটু বেশি গেলেও বিভিন্ন কারণে প্রায়ই টমটমে যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু রোদ-বৃষ্টিতে যাত্রী ও চালকের জন্য ছায়ার ব্যবস্থা থাকলেও ঘোড়ার জন্য নেই। এসব দেখলে খুব খারাপ লাগে। ওদের (ঘোড়া) স্বাস্থ্যের বিষয়টা মালিকদের দেখা উচিত।

কথা হলে ঘোড়ার গাড়ির এক কোচোয়ান (চালক) জাগো নিউজকে বলেন, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত প্রায় ১২ ঘণ্টা চলে ঘোড়ার গাড়ি। সকালে গাড়ি চালানোর আগে একবার ঘোড়াকে খাবার দেওয়া হয়। আবার গাড়ি চালানো শেষে রাতে খাবার দেওয়া হয়। মাঝের সময়গুলো চাহিদা অনুযায়ী কোনো খাবার দেওয়া হয় না।

আরও পড়ুন>> ঢাকার কাছেই ঘুরে আসুন বাঁশ-কাঠের তৈরি ‘রূপগাঁও রিসোর্টে’

কোচোয়ান জহিরুল বলেন, শুধু ঘোড়া নয়, গাধা, গরুসহ সব প্রাণীকেই একটু আঘাত না করলে দৌড়ায় না। তবে, দিন দিন যাত্রী কমে যাচ্ছে। আমাদের তো জীবিকা নির্বাহ করতে হবে। সময় কম লাগার কারণে এখন সবাই বাসে যায়। সকালে ঘোড়াকে টমটমের সঙ্গে বাঁধার আগে ভালো করে খাবার দেওয়া হয়। রাত ৮টার পর টমটম বন্ধ করে আবার খাবার দিই।

ঘোড়ার চিকিৎসা ও দেখভালের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে মাঝে মধ্যে ঘোড়ার চিকিৎসা করা হয়। আমরা তো কেবল চাকরি করি। খাবারসহ অন্য বিষয়গুলো মালিকই দেখেন।

এ বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. অনির্বাণ সরকার বলেন, ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে— আগের ঘোড়ার গাড়িতে রাজা-জমিদাররা চলাচল করতেন। দুটি ঘোড়া বিশিষ্ট গাড়িতে একজন কিংবা দুজন উঠতেন তারা। তখনকার ঘোড়া ছিল সুঠাম দেহের অধিকারী। এখন ঐতিহ্যের নামে দুটি ঘোড়া দ্বারা ১২ থেকে ১৫ জন মানুষকে বহন করা হয়, যা অত্যন্ত অমানবিক। এছাড়া পরিমাণ পরিশ্রম করানো হচ্ছে ঘোড়ার সেই সক্ষমতা নেই। পরিশ্রমের লিমিট রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই চাবুক মেরে বেশি পরিশ্রমে বাধ্য করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন>> সঙ্গীকে নিয়ে ঘুরে আসুন ভারতের ‘ছোট্ট স্কটল্যান্ডে’

তিনি আরও বলেন, আগের দিনের পরিবেশ আর বর্তমান পরিবেশ তো এক নয়। অন্যান্য গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে অনেক সময় গাড়ির সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে ঘোড়া। এতে গায়ে ক্ষত ও ঘা হচ্ছে। এছাড়া গাড়ির বিকট শব্দ তো প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর। ঘোড়াগুলোকে দেখেও সুস্থ-সবল মনে হয় না। একটি প্রাণীর শারীরিক সুস্থতার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্যালোরি দরকার, সেটি ঘোড়াকে দেওয়া হয় না। তপ্ত গরমে পর্যাপ্ত পানি খাবার ও বিশ্রাম দরকার সেটি নিশ্চিত হচ্ছে না।

এ শিক্ষকের মতে, এ যুগে এসে শুধু নির্দিষ্ট একটি রুটে ঘোড়ার গাড়ি চালানোর কোনো মানে নেই। টমটম যদি চালাতেই হয় সিটি করপোরেশন থেকে নির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন তৈরি করতে হবে। ঘোড়ার সুস্থতার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।

জানা যায়, ব্রিটিশ শাসনামল ১৮৫৬ সালের দিক পুরান ঢাকায় ঘোড়ার গাড়ির প্রচলন শুরু হয়। প্রধানত সেসময় জমিদার ও অভিজাত শ্রেণির মানুষরাই এ বাহনে চলাফেরা করতেন। এছাড়া মালামাল পরিবহনের জন্য ঘোড়াকে ব্যবহার করা হতো। ব্রিটিশ আমলে টমটম গুরুত্বপূর্ণ বাহন হিসেবে গণ্য হলেও সময়ের পরিক্রমায় এখন তা বিলীনপ্রায়।

আরএ/এমএএইচ/জেআইএম