স্বাস্থ্য

ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুরা নিউমোনিয়া ও ফুসফুসে সমস্যা নিয়ে আসছে

# চলতি বছর ডেঙ্গুতে ১৩০৬ জনের মৃত্যু# ১-১৫ বছর বয়সী শিশুমৃত্যুর সংখ্যা ১৪০# আক্রান্ত শিশুদের বেশিরভাগেরই সর্দির সমস্যা থাকে# ৭৫ শতাংশ শিশুই সেরোটাইপ-২ বা ডেন-২ সংক্রমিত# আক্রান্ত শিশুদের শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ার লক্ষণ বেশি

Advertisement

এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুর প্রকোপ উদ্বেগ ছড়িয়েছে সারাদেশে। ঢাকায় রোগী কিছুটা কমলেও দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় এখনো হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গুরোগীর চাপ রয়েছে। প্রতিদিনই নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। এরই মধ্যে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু তেরশো ছাড়িয়েছে। যেখানে শূন্য থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত বয়সী রয়েছে ১৪০ জন।

ডেঙ্গুতে শিশুমৃত্যু এ বছর নিয়মিত ঘটনা হয়ে ওঠেছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ডেঙ্গুতে ১৩০৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের মধ্যে ১-১৫ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ১৪০ জন। এরমধ্যে শূন্য থেকে পাঁচ বছরের ৫৩ জন, ৬ থেকে ১০ বছরের ৫৩ জন এবং ১১ থেকে ১৫ বছরের রয়েছে ৩৪ জন। অতীতে কোনো বছরে দেশে ডেঙ্গুতে এত শিশু মারা যায়নি।

আরও পড়ুন: বাচ্চাদের কান্নায় ভারী শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ড

Advertisement

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দ্বিতীয়বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত, ডেঙ্গুর লক্ষণ পরিবর্তন, দেরিতে হাসপাতালে নিয়ে আসার কারণে শিশুমৃত্যু বাড়ছে। শিশুর জ্বর হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা ও সতর্কতার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

ডেঙ্গুতে শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে/ফাইল ছবি

সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের ওপর একটি সমীক্ষা পরিচালনা করা হয়। সমীক্ষায় দেখা গেছে, হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের প্রতি চারজনে একজনের ডেঙ্গুর শক সিনড্রোম (ডেঙ্গু জ্বরের ভয়াবহ রূপ) ছিল। চিকিৎসকরা যেটিকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন। এছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের বেশিরভাগই নিউমোনিয়া ও ফুসফুসে সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে আসছে।

চলতি বছরের জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৭৮১ জন শিশুর ওপর করা এ সমীক্ষায় দেখা গেছে, ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ২৬৯ (৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ) জনের সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর, ২৩৫ (৩০ দশমিক ০ শতাংশ) সতর্ক চিহ্নসহ ডেঙ্গু জ্বর, ১৯৩ (২৪ দশমিক ৭ শতাংশ) ডেঙ্গু শক সিনড্রোম ও ৮৪ (১০ দশমিক ৯ শতাংশ) ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (শরীরে রক্তক্ষরণ) ছিল।

Advertisement

আরও পড়ুন: ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের দেখভাল করছে শিশুরাই, অসহায় বাবা-মা

সমীক্ষায় আরও দেখা গেছে, সাধারণ ডেঙ্গুতে আক্রান্তদের বেশিরভাগেরই সর্দি সমস্যা দেখা দেয়৷ তাদের ৪৫ শতাংশই সর্দিতে ভুগছিল। এছাড়া সাধারণ ডেঙ্গুতে গলা ব্যথা ও কাশি থাকে।

জ্বর হলেও প্রথম দিন অনেক শিশুর ডেঙ্গু পরীক্ষা করা হচ্ছে না/ফাইল ছবি

তবে ডেঙ্গু হেমোরোজিক ফিভার ও শক সিনড্রোমকে সবচেয়ে বেশি বিপজ্জনক হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া ডেঙ্গু আক্রান্ত যেসব শিশুর নিউমোনিয়া ও শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দেয় তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকে। ডেঙ্গু হেমোরোজিক ফিভারে আক্রান্তদের ১৭ শতাংশেরই নিউমোনিয়া বা শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা দেখা দেয়।

ঢামেক হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. ইফফাত আরা শামসাদ, অধ্যাপক ডা. লুৎফন নেসা ও কনসালটেন্ট ডা. নূসরাত জাহান পাপড়ি এ সমীক্ষা পরিচালনা করেন। তাদের মধ্যে দুজনের সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের।

আরও পড়ুন: ‘আমাগো ঘরই নাই, মশারি টাঙামু কই’

ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসায় উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ৭৮১ শিশুর মধ্যে অনেকেই বিপজ্জনক চিহ্ন নিয়ে হাসপাতালে এসেছিল। তাদের মধ্যে মারা গেছে তিনজন।

ডেঙ্গু চিকিৎসায় সার্বিক অবস্থা ও সমীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক ডা. লুৎফন নেসা জাগো নিউজকে বলেন, ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার ও ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এ দুটিই বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। শকে যারা যায় তারা কিডনি, লিবার এসব আক্রান্ত হয়। অন্য দিকটি হচ্ছে রক্তপাত হওয়া যেমন ফুসফুসে রক্তক্ষরণ। এছাড়া আরেকটা বিষয় ছিল এলেভোমিনের (মানবদেহের অপরিহার্য প্রোটিন উপাদান, যা শরীরের কোষগুলোকে সুস্থ রাখতে, রক্তক্ষরণ প্রতিরোধে সাহায্য করে) মাত্রা কমে যাওয়া। এতে করে পেটে ও ফুসফুসে পানি জমে যায়। এসময় আমরা স্যালাইন দেই। তবে এসময়ে সঠিক চিকিৎসা ও সেবা না পেলে রোগীর হার্ট ফেইলিউর হতে পারে। তাই আমরা কিছুক্ষণ পরপর রক্তচাপ পরীক্ষা করি। এসব রোগীর ক্ষেত্রে আমরা প্রতি দুই ঘণ্টা পর পর রক্তচাপ পরীক্ষা করি।

আরও পড়ুন: ডেঙ্গুর সঙ্গে লড়ছে চার সন্তান, দিশেহারা মা আসমা আক্তার

তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গুর মূল বিষয় হচ্ছে ম্যানেজমেন্ট। শক সিনড্রোমে যাওয়া রোগীর শিরাগুলো রক্ত ধরে রাখতে পারে না। তখন রক্তের জলীয় অংশ বিভিন্ন অঙ্গে চলায় পেটে ও ফুসফুসে পানি জমে যায়। রোগীর তখন শ্বাসকষ্ট হয়। আবার কোনো কারণে যদি রোগীকে ফ্লুইড বেশি দেওয়া হয় তখনো এমনটি হতে পারে।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি অ্যান্ড মেডিসিন রেফারেল সেন্টারের তথ্যানুযায়ী, এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের ৭৫ শতাংশই ভাইরাসটির সেরোটাইপ-২ বা ডেন-২ দ্বারা সংক্রমিত।

হাসপাতালগুলোতে এখনো ডেঙ্গুরোগী ভর্তি হচ্ছে/ফাইল ছবি

এ বছর ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪ ধরনের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে ৮৭ শতাংশই ‘ডেন-২’ ধরনে এবং বাকি ১৩ শতাংশ শিশু ‘ডেন-৩’ ধরনে আক্রান্ত হয়েছে বলে বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের গবেষণায় উঠে এসেছে।

ডা. লুৎফন নেসা বলেন, এ বছর ডেঙ্গুর সেরোটাইপ ডেন-২ বেশি হওয়ায় প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে এনএস-১ (নন স্ট্রাকচারাল প্রোটিন ১) ভুলভাবে নেগেটিভ দেখাচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা রোগীর অন্য উপসর্গগুলো ও রক্ত পরীক্ষা করে ডেঙ্গু বুঝে নিতাম।

আরও পড়ুন: ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের ৮৭ শতাংশই ডেন-২ ধরনে আক্রান্ত

এছাড়াও সমীক্ষায় দেখা গেছে, ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের ক্ষেত্রে ১৪ শতাংশের ফুসফুসে পানি জমা, যেটি সাধারণ ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ ছিল। আবার ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারের ক্ষেত্রে ফুসফুসে পানি ছিল ১০ শতাংশ রোগীর।

শিশুর জ্বর হওয়ার প্রথম দিনেই এনএস-১ ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে/ফাইল ছবি

শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ার মতো লক্ষণ নিয়ে রোগীরা বেশি আসছে বলে জানান সমীক্ষা পরিচালনা করা আরেক চিকিৎসক ডা. নূসরাত জাহান পাপড়ি। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, শ্বাসকষ্ট ও নিউমোনিয়ার মতো লক্ষণ নিয়ে রোগীরা বেশি আসছে। তবে যেসব রোগীর নাক দিয়ে সর্দি পড়া বা কাশির মতো লক্ষণ দেখা দিয়েছে তাদের মারাত্মক ডেঙ্গু হয়নি বলে ধরা হয়। কিন্তু যেসব রোগী নিউমোনিয়া, বুকে পানি জমা, ফুসফুসে পানি জমা, আবার হার্ট আক্রান্ত হচ্ছে, তাদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি।

আরও পড়ুন: ডেঙ্গু থেকে শিশুদের রক্ষায় ২১৮০ কোটি টাকা দিলো বিশ্বব্যাংক

ডা. নূসরাত আরও বলেন, শিশুর জ্বর হওয়ার প্রথম দিনেই এনএস-১ ডেঙ্গু পরীক্ষা করার কথা বলা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সবসময় তা করা হচ্ছে না। কারণ, নরমাল জ্বর-সর্দি-কাশিকে অনেকে ডেঙ্গুর লক্ষণ মনে করছে না। এসব শিশুর ফুসফুসে পানি বা নিউমোনিয়া আছে কি না তা পরীক্ষার মাধ্যমে জানা জরুরি। এতে আক্রান্ত শিশুর দ্রুত সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা যেমন বাড়বে, মৃত্যুঝুঁকিও থাকবে না।

এএএম/এমকেআর/এএসএম