কবি মোহাম্মদ রফিক মারা যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগেই শেষ ফোন করেছিলেন। সাধারণত শেষের দিকে উনি মেসেঞ্জারে ফোন করতেন। ওই সময় দেশের বাইরে ছিলাম। তাই খুব বেশি কথা বলতে পারেননি। উনি শুধু ফোন রাখার আগে বলেছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে তুমি আমাকে ফাঁকি দিচ্ছো। এবার দেশে ফিরে অবশ্যই তুমি আমার সঙ্গে দেখা করবে। তার কয়েকদিন পরই জানতে পারি ওনার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের পথে উনি মারা গেছেন।
Advertisement
কবি মোহাম্মদ রফিকের গ্রামের বাড়ি আমার অনেক পরিচিত। তার কবিতার সঙ্গেও পরিচয় দীর্ঘ সাড়ে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে। তার প্রায় সব কাব্যই পড়েছি। পত্রিকার দায়িত্বে বসে বিভিন্ন সময় তার কবিতা ছেপেছি অনেক আনন্দে। আনন্দে কথাটা বললাম এ জন্য, আধুনিক কবিতার যে রূপটি একজন পাঠক হিসেবে আমার বেশি ভালো লাগে মোহাম্মদ রফিকের কবিতার ভেতর সেটা অনেক বেশি পেতাম। তার পরেও তিনি মারা যাওয়ার পর পরই তাঁর কবিতা নিয়ে অনেক লেখালেখি হলেও কোনো কিছু লেখার সাহস পাইনি। এ লেখাও তার কবিতা নিয়ে নয়। বাস্তবে তাঁর কবিতা নিয়ে ঠিক তাড়াহুড়ো করে লেখার নয়। তাঁর কবিতা নিয়ে কিছু লিখবো বলে অনেক সময় তাঁর সঙ্গে আলোচনা করেছি। কিন্তু যখনই লিখতে বসেছি, দেখেছি কাজটি সহজ নয়। কারণ, তাঁর কবিতার নদী ও নারী তার নিজস্ব। তাঁর কবিতা থেকে ওই নদী ও নারীকে তুলে আনা খুব সহজ কাজ নয়।
নদী ও নারী পৃথিবীর এই দুই স্রষ্টার রূপকে তাঁর কবিতায় তিনি বার বার ভেঙেছেন ও গড়েছেন। যে কারণে কখনও কখনও তাঁর কবিতা পড়তে গিয়ে তাঁকে মনে হতো, তিনি আমাদের মাটির মূর্তি গড়া সহজাত কারিগরদের একটা সত্তা নিয়ে জম্মেছেন। একই মাটি দিয়ে তাঁরা যেমন একই নারীমূর্তি সহস্র বৈচিত্র্যতায় তৈরি করেন তাদের আঙুলের সহজাত ছোঁয়ায় তিনিও তেমনি তৈরি করতেন নারীকে তাঁর কবিতায়।
আর নদী তো তাঁর জীবনের সঙ্গে গেঁথে ছিল। আশৈশব ও কৈশোরে নদীর সঙ্গে বেড়ে ওঠা কবি নদীকে তাঁর শরীর ও মনের অঙ্গ করে নিয়েছিলেন সারা জীবন। নদী ও জল তাঁর কতটা পরিচিত ছিল তার একটি ঘটনা জীবনের বিভিন্ন সময়ে বার বার মনে আসে। কবি মোহাম্মদ রফিকের সঙ্গে বাগেরহাট যাই শেষবারের মতো সম্ভবত ১৯৮৪ সালে। কবিকে সেবার তাঁর এলাকার কলেজ বাগেরহাট পিসি কলেজের বাংলা বিভাগ ও একটি কবিতা সংগঠনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে। তখন কবি আবুল কাসেম পি সি কলেজের শিক্ষক। তাঁর উদ্যোগেই সেটা হয়। কবি মোহাম্মদ রফিকের থেকে তাঁর শ্রদ্ধেয় শিক্ষক পিতা বিষয়টিতে খুব বেশি আনন্দিত ছিলেন। যে কারণে তিনি ভোরে রওয়ানা হওয়ার আগে আবার তাঁর পিতাকে জানিয়ে আসেন, তিনি রওয়ানা দিচ্ছেন। তাঁর বাবাকে একথা জানিয়ে বাসে উঠেই তিনি খুব হাসি মুখে বলেন, আজ তাঁর বাবা সত্যিই খুবই খুশি যে জন্মভূমি বাগেরহাটে তাঁকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে।
Advertisement
যা হোক, সেবার বাগেরহাটে গিয়ে তিনি ছিলেন বাগেরহাট রামকৃষ্ণ মিশনের গেস্ট হাউজে। সারাদিনের জার্নির ক্লান্তি দূর করতে আমরা বাগেরহাট রামকৃষ্ণ মিশনের তৎকালীন মন্দিরের পেছনের দিকে নীল জলে ভরা পুকুরে নেমেছি। আকাশে সেদিন ফুটফুটে চাঁদ। ওই চাঁদের আলো আর পুকুরের নীল জল কবিকে কেন যেন সেদিনের সন্ধ্যারাতে অনেক বেশি বাঙ্ময় করে তুলেছিল। সেদিন ওই জলে সাঁতার কাটতে কাটতে শুধু অনেক কবিতার লাইন নয় আরও অনেক কথা বলেন কবি মোহাম্মদ রফিক। তবে সেদিনের ওই পুকুরের জলে সাঁতার কাটতে কাটতে মোহাম্মদ রফিক হঠ্যাৎ হেসে বলেছিলেন, দেখো, শামসুর রাহমান ডুব সাঁতারে পদ্মা পার করেছেন। পদ্মা কি ডুব সাঁতারে পার হওয়া যায়? শামসুর রাহমানের ওই কবিতাটা যে কোনো বাঙালির মতো আমারও প্রিয়। তবে কবি মোহাম্মদ রফিকের মুখ সেদিন ওই কথা শোনার আগে আমি কখনও ভাবিনি, আসলে পদ্মা তো ডুব সাঁতারে পার হওয়ার নয়। আর সেদিন থেকে শুধু কবিতা নয়, গদ্য এমনকি রিপোর্ট লেখার সময়ও যদি উপমার দরকার হয় তখনও দ্বিতীয়বার ভেবে দেখি। এবং এরপর থেকে যখনই কবি মোহাম্মদ রফিকের কবিতা পড়েছি, খেয়াল করেছি তাঁর উপমা নিয়ে। তবে এটা সত্য যে নদী, নারী ও জল নিয়ে কবি মোহাম্মদ রফিকের হাতে উপমার জাদু বেশি খেলা করেছে। আর এই জলের সঙ্গে তার একটা ছোটবেলাও যে মিশে ছিল তা বুঝেছি, তাদের বাগেরহাটের বাড়ির সবুজ বাগান ঘেরা পুকুরের ঘাটে বসে। ওই পুকুরের জলে পা ডুবিয়ে তিনি যেন অন্য মানুষ হয়ে যেতেন।
সে সময়ে বাগেরহাটের বাসাবো এলাকা গাছপালা আর মাঠ মিলে একটা অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ছিল। ওর সঙ্গে ছিল কয়েকটি ফিশারিজের পুকুর। বাগেরহাট শহর থেকে একদিন রিকশায় বাসাবোর পথে যেতে যেতে হঠ্যাৎ রিকশা থামিয়ে রফিক ভাই হাত ধরে নিয়ে যান ওই নির্জন পুকুর পাড়ে। নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকেন পুকুরের জলের দিকে। ওই পুকুরের জল, শুকনো খড়ের বিস্তীর্ণ বিল আর তার ওপর দিয়ে সেদিনের সেই সূর্য অস্ত যাওয়া- সব মিলে যেন অন্য এক ধরনের নিস্তব্ধ সন্ধ্যা নেমে এসেছিল। যে সন্ধ্যায় কোনো কথা বলা যায় না। কেবলই নীরবে হালকা অন্ধকার গায়ে মাখা যায় নিস্তব্ধতার সঙ্গী হয়ে।
এভাবে বিভিন্ন সময়ে কবি মোহাম্মদ রফিককে দেখে বার বার মনে হয়েছে, পৃথিবী ও প্রকৃতিকে তিনি জীবনের কোনো এক আলাদা সত্তা দিয়ে উপলব্ধি করতেন। যে সত্তার মধ্যে গভীর নীরব ভালোবাসা ছিল, দ্রোহ ছিল, আবার ঋষির মতো এক ধ্যান গম্ভীর উপলব্ধি খোঁজার তাড়না ছিল। তাঁর জীবদশ্মায় আমাদের এ ভূখণ্ডের রাষ্ট্র ও সমাজ কখনই সুস্থ ছিল না, নানান অসুখ এই সমাজ ও রাষ্ট্রকে বার বার আক্রান্ত করেছে, যার ফল ভোগ করতে হয়েছে সমাজের মানুষ থেকে প্রকৃতি অবধি। এ ভূখণ্ডে যেমন মানুষের মৃত্যু হয়েছে, মানুষকে ভূখণ্ড থেকে হারিয়ে যেতে হয়েছে, তেমনি এ ভূখণ্ডে মৃত্যু ঘটেছে নদী, বৃক্ষ, পশু পাখি সবারই। কেউই এ অসুস্থতা থেকে রক্ষা পায়নি।
আধুনিক পৃথিবীতে সমাজের বদলে রাষ্ট্র, সমাজপতির বদলে রাজনীতিকরা ভূখণ্ডের কর্তৃত্ব নিয়েছে। তারা সবাই তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য যা প্রয়োজন তাই করেছে। কখনই তাদের উপলব্ধিতে নেয়নি মানুষ ও প্রকৃতিকে। এমন একটি সমাজে কোনো প্রকৃত কবি জন্ম নিলে তাঁর ভেতর নানানভাবে দ্রোহের জন্ম নেবে। কবি মোহাম্মদ রফিকের যৌবনে পৃথিবীতে সমাজতন্ত্রের নামে, জাতীয়তাবাদের নামে এই দ্রোহ নানান ভূখণ্ডে নানা রূপে জন্ম নিয়েছিল। কবি মোহাম্মদ রফিক তাঁর যৌবন ও জীবনের বিভিন্ন স্তরে এসব দ্রোহের সঙ্গী হয়েছেন। এজন্য কখনও তাকে বেশিভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে সমাজতান্ত্রিক মতবাদের কবি হিসেবে, আবার কখনও জাতীয়তাবাদী মতবাদের কবি হিসেবে। কিন্তু তার কবিতার গভীরে গিয়ে এবং তাঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলোচনায় যে সত্য বুঝেছি, এসব মতবাদের সংকীর্ণতা তার উপলব্ধিতে অনেক পরিচিত ছিল। তাই এ সবের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেও তিনি কখনই ওই সংকীর্ণ গলিতে যাননি। বরং পৃথিবী, সভ্যতা ও সভ্যতার ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা এক মানব সমাজের পথিক ছিলেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করতেন মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিতে হলে প্রকৃত কবির মতো একটা স্রষ্টার মন থাকতে হয়। কবির এই মন এই বোধকে তিনি অনেক উচ্চে স্থান দিতেন। তাই হয়তো তিনি কবি'র প্রতি ও কবিতার প্রতি ছিলেন অনেক বেশি সংবেদনশীল। যে কারণে আফ্রিকার কবি মলয়েঁজের ফাঁসি হলে সে সময়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিএসসি চত্বরে ছাত্ররা যে প্রতিবাদ সভা করে সেখানে পরিচিত মুখ হিসেবে তিনিই ছিলেন সেদিন প্রধান বক্তা।
Advertisement
আবার রাষ্ট্র ক্ষমতাকে কবি হওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করারও প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। ক্ষমতাকে ব্যবহার করে কবি হওয়ার চেষ্টার প্রতিবাদে তাঁর ওই কবিতাও মূলত কোনো এক বিশেষ সামরিক শাসক বা স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে নয়। মূলত সভ্যতার মূল শক্তি অর্থাৎ তার শান্ত ও সমাহিত রূপ যে বার বার দানবের গদার আঘাতে মুষলের আঘাতে বার বার লন্ডভন্ড হয়, আর তখন যে দেবতাকে দানব দমনের মন্ত্র পড়তে হয়- ওই কবিতা মূলত সেই দানব দমনের মন্ত্রকেই মনে করিয়ে দেওয়া। কারণ, এ সত্য তো মনে রাখতে হবে, পৃথিবীতে দানবের দাপট ছিল শুরুতে। দেবতা এসেছে পর যুগে। তাই পৃথিবীর রক্তে রয়ে গেছে দানবের আদিম রক্তস্রোত। এ কারণে যে কোনো রক্তই যে কোনো সময় দানবের রক্ত হয়ে ওঠে- আর তখন প্রয়োজন হয় ওই মন্ত্রের। এ সত্য মেনে বলতেই হবে, মোহাম্মদ রফিক কোনো অর্থেই একটি স্লোগানের বা কোনো একটি আন্দোলনের জন্যে ওই কবিতা লেখেননি।
তবে এও সত্য তাঁর সব প্রতিবাদের মূল চাহিদা ছিল তার একটি সুস্থ সমাজ ও রাষ্ট্র। যে কারণে আশির দশকের দিকে তাঁর অনেক চাহিদার ভেতর একটি বড় চাহিদা দেখেছি সমাজ ও রাষ্ট্র প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের মাধ্যমে পরিচালিত হোক। সে সময়ে একদিন তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ চত্বরে হাঁটতে হাঁটতে বলেছিলেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কত শিক্ষিত মানুষ আছেন অথচ রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনায় তাদের কোনো সংযোগ নেই। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাঁর চিন্তা এখান থেকে সরে না এলেও তাঁর ভেতর আমাদের সবার মতো একটা আপস কিছুটা কাজ করতো। তিনি মন্দের ভালো খুঁজতেন। আর যে বিষয়টি তাঁকে পীড়া দিতো তা হলো, যৌবনে যা চেয়েছিলেন, তার কোনো সফলতা তিনি দেখে যেতে পারলেন না? তাই তিনি ফোনে খোঁজ নিতে চাইতেন অনেক কিছু। ফোনে প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে গেলেই তিনি হেসে বলতেন, কবে আমার সঙ্গে দেখা করবে বলো?
অনেকবার সময় দিয়েছি। কিন্তু দুই বছরের কোভিড আর তারপরে বেশি সময় নানান কাজে ঢাকায় না থাকার ফলে তাঁর কাছে যেতে পারতাম না। তাই তিনি শেষ টেলিফোনে বলেছিলেন, এবারও যেন ফাঁকি দিয়ো না। এ কথা তিনি আরও কয়েকবার বলেছিলেন। আজ তাকে নিয়ে লিখতে বসে জীবনের এ উপলব্ধি বার বার ফিরে আসছে, আমরা সবাই কি নিজেই নিজেকে ফাঁকি দিয়ে দিয়ে চলছি না প্রতি মুহূর্তে এ সমাজে! আমরা সাধারণরা বুঝতে পারি না এই ফাঁকি দেওয়া। কিন্তু কবিকে তো আর ফাঁকি দেওয়া যায় না!
লেখক: সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার প্রাপ্ত।
এইচআর/ফারুক/এএসএম