জাতীয়

কী আছে ঢাকা নগর জাদুঘরে?

ইমাম হাসান হোসেনের গল্পের দৃশ্য, ঢাকার প্রথম ছাপাখানা কিংবা নবাবি আমলের হুক্কা এরকম আরও বহু ঐতিহাসিক উপকরণ আর ঐতিহ্যের সমারোহে সমৃদ্ধ ঢাকা নগর জাদুঘর। তিলোত্তমা এই যান্ত্রিক নগরী কেমন ছিল উনিশ কিংবা বিশের দশকে, জানার জন্য নগর জাদুঘরে ঢুঁ মারেন অনেকেই।

Advertisement

১৯৮৭ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া ঢাকা নগর জাদুঘরে গেলেই কিছুটা হয়তো সেই ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারণা মেলে দর্শনার্থীদের। পুরান ঢাকার ঐতিহ্য, নানান কৃষ্টি-কালচার, চিত্রকর্ম, নবাবি আমলের তৈজসপত্র দিয়ে সাজানো এ জাদুঘর।

জাদুঘরে প্রবেশ করলেই দেখা মিলবে হোসেনী দালানের উত্তর দিকের প্রধান প্রবেশদ্বার, মহররম উপলক্ষে সুসজ্জিত হোসেনী দালান, ভিস্তিদের পতাকা মিছিলের দৃশ্য। মাতম বা বুক চাপড়িয়ে শোকপ্রকাশ এবং পানীয় পান করানোর দৃশ্য। মহররম মিছিলে বাদক দল কিংবা অশ্বারোহী দলও স্মৃতিপটে আঁকা রয়েছে এখানে।

ঢাকার মানুষের ঈদ উদযাপন বা রীতিনীতিরও বেশ কয়েকটি চিত্রকর্মও রয়েছে এতে। এসব চিত্রকর্ম আঠারো শতকের শেষ দিকে অথবা উনিশ শতকের শুরুর দিকের, ঢাকায় টিকে যাওয়া প্রাচীন চিত্রকর্মের অন্যতম নিদর্শন। ঢাকার ইতিহাস সংবলিত ১০১টি দুর্লভ আলোকচিত্র রয়েছে এই নগর জাদুঘরে।

Advertisement

আরও পড়ুন> উপমহাদেশে জাদুঘরের উৎপত্তি

উনিশ শতকে ঢাকার নবাবদের ব্যবহৃত পানের বাটা, সে আমলের মুদ্রা, পানদানিসহ নানান উপকরণও রয়েছে জাদুঘরে। দুর্লভ আলোকচিত্রের মধ্যে আছে পুরান ঢাকার রোজ গার্ডেন, রূপলাল হাউজ, হোসেনী দালানের আদি রূপ, বড় কাটরা, ছোট কাটরা, সাতগম্বুজ মসজিদ, উনিশ শতকে নির্মিত বিভিন্ন বাড়ি, সেন্ট জেমস গির্জা (বর্তমান বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে), পুরোনো হাইকোর্ট ভবন, ১৯০৪ সালে দিলকুশার নবাববাড়ি।

দেখা মিলবে বিশ শতকের প্রথম দিকে ঢাকার নারীদের ব্যবহৃত তারজালির ভ্যানিটি ব্যাগ, কোমরের বিছা, হাঁসুলিসহ নানান সামগ্রীর।

ঢাকায় প্রকাশিত প্রথম ইংরেজি সংবাদপত্র সাপ্তাহিক ‘ঢাকা নিউজ’র মুদ্রণ যন্ত্রটির দেখা মিলবে এই জাদুঘরে। এটি উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ের এবং স্থাপন করেন সুইজারল্যান্ডের স্যামুয়েল বোস্ট। পুরান ঢাকার একটি জরাজীর্ণ বাড়ি থেকে ১৯৮৯ সালে ঢাকা নগর জাদুঘরের ট্রাস্টি হাশেম শফি সংরক্ষণ করেন মুদ্রণটির।

Advertisement

মোগল ও ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন দলিল, ছবি ও গ্রন্থসহ আরও অনেক মূল্যবান উপকরণও আছে এতে। ১৯৫২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, এমনকি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ নানা আন্দোলনের বেশকিছু দুর্লভ আলোকচিত্র ও পোস্টার দেখা যায় এই জাদুঘরে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনার ওপর কার্ড, পোস্টার, পুস্তিকা এবং ঢাকার বিভিন্ন বিষয়ে বেশ কয়েকটি গবেষণাগ্রন্থও প্রকাশ করে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে রয়েছে শামসুর রাহমানের স্মৃতির শহর, আবদুল করিমের ঢাকাই মসলিন ও মুনতাসীর মামুনের ঢাকার হারিয়ে যাওয়া কামান।

জাদুঘর দেখতে আসা মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, খুবই ভালো লাগলো। অনেক আগে ঢাকা কেমন ছিল তার একটু হলেও ধারণা পাওয়া যায় এখানে এলে। আমার মনে হয় অনেকেই জানে না যে এখানে জাদুঘর আছে। প্রচার প্রচারণা বাড়ালে ভালো হয়। এখান থেকে ইতিহাসের অনেক কিছু জানার আছে।

১৯৯৭ সাল থেকে ঢাকা নগর জাদুঘরের কেয়ারটেকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ভূপেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। ভূপেন জাগো নিউজকে বলেন, দীর্ঘদিন এ জাদুঘরের কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত তিনি। দর্শকের আনাগোনার বিষয়ে তিনি বলেন, একটা সময় ছিল অনেক দর্শনার্থী আসতো। এখনো আসে তবে কম। জাদুঘর যখন এখানে স্থানান্তর হয় তখন প্রচুর দর্শনার্থী পেতাম। এখন কোনোদিন ১৫ জন বা ২০ জন আসে, কোনোদিন আবার তার চেয়েও কম। তিনি জানান, গত মাসে (সেপ্টেম্বর) মোট ২১৫ জন দর্শনার্থী ঘুরতে এসেছেন। চলতি মাসের ১২ অক্টোবর পর্যন্ত ১১৩ জন। জাদুঘরে টিকিটের প্রবেশমূল্য মাত্র ২ টাকা।

আরও পড়ুন> মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে যা আছে দেখার

দিন দিন দর্শনার্থী কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. প্রদীপ চাঁন দুগার জাগো নিউজকে বলেন, জাদুঘরে দর্শনার্থী কমে যাওয়ার পেছনে দুটি বিষয় কাজ করছে, একটা অর্থনৈতিক ও সময় স্বল্পতা। অন্যটি জাদুঘর আকর্ষণীয় করে তুলতে না পারা। বাইরের দেশে জাদুঘরগুলোতে বেশ আকর্ষণীয় ভিন্ন ভিন্ন বিষয় ফুটিয়ে তোলা হয়। এছাড়া আধুনিক যুগে ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি মানুষের আগ্রহও কমে গেছে।

ইতিহাসের এই অধ্যাপক আরও বলেন, জাদুঘরে নতুনত্ব কিছু আনতে হবে। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ প্রাচীনকাল নিয়েই পড়ে আছে, তাহলে দর্শনার্থী কেন আসবে। নতুনত্ব আনলে দর্শনার্থীর সংখ্যাও বাড়বে।

ঢাকার ১৩৩, গ্রিন রোডের ‘জাহানারা গার্ডেন’ ছিল বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত নগর জাদুঘরের প্রথম অস্থায়ী কার্যালয়। এর আগে পুরান ঢাকার পাঁচভাই ঘাট লেনের একটি বাড়িতে প্রথম প্রতিষ্ঠা করা হয় এই জাদুঘর। ১৯৯৬ সালের ২০ জুলাই নগর ভবনে স্থানান্তর করা হয়। তবে সেটি আবারও স্থানান্তর করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে।

জাদুঘরটির সার্বিক দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা (সিনিয়র সহকারী সচিব) আকন্দ মো. ফয়সাল উদ্দিন। জাদুঘরটি সম্প্রসারণের ব্যাপারে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, নগর জাদুঘরটি স্থানান্তর করে রোজ গার্ডেনে নিয়ে যাওয়া হবে। জাতীয় জাদুঘর কর্তৃপক্ষ স্থানান্তরের কাজটি করবে। তখন হয়তো নতুন কিছু করা হবে।

এমএনএইচ/এসএনআর/এসএইচএস/জেআইএম