দেশে ডেঙ্গুরোগের বড় প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ২০০০ সালে। ওই বছর ডেঙ্গুতে ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। এরপর থেকে প্রতি বছরই দেশে ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হয়, মৃত্যুর তথ্যও পাওয়া যায়। ২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গু সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গুতে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়, আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ২০২২ সালেও ডেঙ্গুতে ২৮১ জন মারা যান। তবে চলতি বছর দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে।
Advertisement
২০২৩ সালে ডেঙ্গু মহামারি আকার ধারণ করে গত আগস্টে। ওই মাসেই ডেঙ্গুতে মারা যান ২০৪ জন। আর আগস্টে এক মাসের মৃত্যুর সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ২০২২ সালের ১২ মাসের মৃত্যুর রেকর্ড। ওই মাসে ডেঙ্গুতে ৩৪২ জনের প্রাণহানি ঘটে। তবে সেপ্টেম্বর মাসে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ৩৯৬ জনের মৃত্যু হয়। যদিও চলতি অক্টোবরে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কমেছে।
এবছর হাসপাতালে ডেঙ্গুরোগী ভর্তির সংখ্যা ঢাকার চেয়ে ঢাকার বাইরে বেশি। যদিও শুরুর দিকে এ চিত্র বিপরীত ছিল। তবে মৃত্যুর সংখ্যা বাইরের এলাকাগুলোর চেয়ে ঢাকায় অনেক বেশি। সম্প্রতি ঢাকা মহানগরীতে ডেঙ্গুরোগীর চাপ কমেছে। ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুর প্রকোপ এখনো বেশি। রোববার (২২ আগস্ট) সকাল ৮টা পর্যন্ত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন দুই হাজার ৫৬ জন ডেঙ্গুরোগী। এর মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৫০০ জন, ঢাকার বাইরের এক হাজার ৫৫৬ জন।
আরও পড়ুন>> ডেঙ্গুতে ৯ মৃত্যু, সাতজনই ঢাকার বাইরের
Advertisement
চলতি বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের তথ্য যাচাই করে দেখা যায, এবার ঢাকার বাইরের জেলাগুলোতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। মোট আক্রান্তের ৩৮ শতাংশ ঢাকার ও ৬২ শতাংশ ঢাকার বাইরের।
বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি আছেন সাত হাজার ৬৭৭ জন রোগী। এর মধ্যে ঢাকায় দুই হাজার ১৮৯ জন। এছাড়া ঢাকার বাইরে ভর্তি রয়েছেন পাঁচ হাজার ৪৮৮ জন। ঢাকায় বর্তমানে সবেচেয়ে বেশি রোগী ভর্তি আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ৩২৬ জন। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ঢামেকে ভর্তি হয়েছেন ৩৪ জন রোগী।
শনিবার ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, সেখানে ডেঙ্গুরোগীর চাপ কমেছে। হাসপাতালের আউটডোরে রোগীর ভিড়ও কমেছে অনেক। হাসপাতালের বেড ও আইসিইউও ফাঁকা রয়েছে। ঢাকার মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৬২ ডেঙ্গুরোগী ভর্তি রয়েছেন এই হাসপাতালে। গত জুলাই মাসে ডেঙ্গুরোগীদের সেবা নিশ্চিত করতে রাজধানীর মহাখালীতে অবস্থিত ৮০০ শয্যার ডিএনসিসি হাসপাতালকে ‘ডেঙ্গু ডেডিকেটেড হাসপাতাল’ ঘোষণা করা হয়।
হাসপাতালের তথ্যে জানা যায়, হাসপাতালটিতে ১৬২ জন ডেঙ্গুরোগী ভর্তি রয়েছেন। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছে ৩৮ জন। এছাড়া ছাড়পত্র পেয়েছেন ৪৭ জন রোগী। হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি রয়েছেন ২২ জন রোগী। এছাড়া ২৪ ঘণ্টায় আউটডোরে রোগী এসেছেন ১৬০ জন।
Advertisement
আরও পড়ুন>> ডেঙ্গুতে আক্রান্ত আড়াই লাখ ছাড়ালো, একদিনে ১২ মৃত্যু
এই হাসপাতালের চতুর্থ তলার ওয়ার্ডে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি সাহেদুল ইসলাম। রাজধানীর মহাখালী এলাকার বাসিন্দা তিনি। সেখানে কথা হয় তার স্ত্রীর সঙ্গে জাগো নিউজকে জানান, ১৫ অক্টোবর থেকে তার জ্বর। ১৭ তারিখে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। স্যালাইন আর ওষুধ চলছে। এখন অনেকটাই ভালো আছেন।
এই হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা জানান, এ মাসের শুরু থেকে ডেঙ্গুরোগীর সংখ্যা কমতে শুরু করে। এখানে বেশিরভাগ রোগীই ঢাকার বাইরে কিংবা বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে স্থানান্তর হয়ে আসতেন। বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমায় হাসপাতালেও চাপ কমেছে।
এবছর ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যু অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন মোট দুই লাখ ৫৫ হাজার ৪৬ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৯৫ হাজার ৫৩০ জন। আর ঢাকার বাইরের হাসপাতালগুলোতে ভর্তি হয়েছেন এক লাখ ৫৯ হাজার ৫১৬ জন। ২৪ ঘণ্টায় মারা গেছেন নয়জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা দুইজন এবং ঢাকার বাইরের সাতজন। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু এক হাজার ২৫৫ জনে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া এখন পর্যন্ত হাসপাতাল থেকে মোট ছাড়পত্র পেয়েছেন দুই লাখ ৪৬ হাজার ১১৪ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার বাসিন্দা ৯২ হাজার ৫৭২ জন এবং ঢাকার বাইরের এক লাখ ৫৩ হাজার ৫৪২ জন।
আরও পড়ুন>> ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালকে ডেঙ্গু ডেডিকেটেড করার সিদ্ধান্ত
এবছর ডেঙ্গুতে সব বয়সী মানুষই কম-বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ২১ থেকে ২৫ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ রোগীই এই বয়সের। এছাড়া দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক আক্রান্ত হয়েছেন ২৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী, যা মোট আক্রান্তের ১৩ শতাংশ। সর্বোচ্চ সংখ্যক রোগী মারা গেছেন ৩৬ থেকে ৪০ বছর বয়সী। এছাড়া ২৬ থেকে ৩০ ও ৩০ থেকে ৩৫ বছরের বয়সে মারা গেছেন ৯ শতাংশ করে ১৮ শতাংশ রোগী।
ডেঙ্গুতে নারীদের চেয়ে পুরুষের আক্রান্তের হার বেশি। মোট আক্রান্তের ৬০ দশমিক ২ শতাংশ পুরুষ আর বাকি ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। তবে মৃত্যুতে নারীদের হার বেশি। মোট এক হাজার ২৫৫ জনের মধ্যে নারী ৭০৮ জন, আর পুরুষ ৫৩৮ জন। তাদের মাঝে শূন্য থেকে ২০ বছর বয়সী শিশু ও কিশোর মারা গেছেন মোট মৃত্যুর ১৭ শতাংশ। ডেঙ্গুতে এ বয়সীদের মধ্যে মারা গেছেন ২১৩ জন।
চিকিৎসকদের মতে, ডেঙ্গুর চিকিৎসা খুব গুরুতর বিষয় নয়। একজন রোগী জ্বরে আক্রান্ত হলে নিয়মিত চেকআপ ও ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট করা গেলে রোগী মৃত্যুর আশঙ্কা থাকে না। যদি কোমরবিড (দুরারোগ্য অসংক্রামক ব্যাধি) রোগে আক্রান্ত থাকে সেক্ষেত্রে সমস্যা হতে পারে। কিন্তু দেশের মানুষকে কোনোভাবেই সচেতন করা যাচ্ছে না। রোগীরা দ্রুত পরীক্ষা করছেন না এবং চিকিৎসা নিচ্ছেন না। এতে ক্ষতির মুখে পড়ছেন তারা।
আরও পড়ুন>> ‘ভুল ধারণায়’ আটকে থাকায় বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা
ঢাকায় রোগীর চাপ কেমন জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর জাগো নিউজকে বলেন, ঢাকায় রোগীর চাপ কমেছে। তবে ঢাকার বাইরে সারাদেশেই ডেঙ্গু ছড়িয়েছে। আমরা সারাদেশেই ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিচ্ছি। ডেঙ্গু চিকিৎসার প্রধান বিষয় ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট করা। হাইটেক কিছুর দরকার পড়ে না। সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিলে মৃত্যুর হারও কম হতো। এই রোগে মৃত্যুর প্রধান কারণ হাসপাতালে দেরিতে আসা।
ঢাকায় আক্রান্ত কম হলেও মৃত্যু বেশি কেন- জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, ঢাকায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে দেখা যায় বেশিরভাগ রোগীই দূরদূরান্ত থেকে আসা। ঢাকায় যারা চিকিৎসা নিচ্ছেন তাদের মধ্যেও অনেকে খারাপ অবস্থায় ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন। ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রভাব কিছুটা কমেছে, তবে ঢাকার বাইরে এখনো বেশি।
সারাদেশে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কখন কমতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, একবার বৃষ্টিপাত হলে নতুন করে মশার জন্ম হয়, ফলে ডেঙ্গুর আক্রান্তের ঝুঁকি আবারও ২০ দিনের মতো বেড়ে যায়। সামনে শীত আসছে, এর মধ্যে যদি বৃষ্টি না হয় তবে এডিস মশার জন্ম কম হবে, এতে ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে।
এএএম/ইএ/জেআইএম