বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে ল্যাম্বারগিনির কার্বন কপি বানিয়ে ফেলার খবর নতুন নয়। কৃষি, খাদ্য, চিকিৎসা ও প্রযুক্তি খাতে নিয়মিত নতুন উদ্ভাবনের খবর পাই সংবাদমাধ্যমগুলোতে। কিন্তু এর শেষ সেখানেই। নতুন উদ্ভাবনকে স্বাগত জানিয়ে বাস্তবায়নে মেলে না সরকারি-বেসরকারি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা। একসময় হারিয়ে যায় সব প্রতিভা। অথচ আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত হাঁটছে ঠিক উল্টো পথে। তারা উদ্ভাবনী প্রতিভার কদর করতে জানে। তাই কাগুজে আইডিয়াগুলো সহজে রূপান্তরিত হয় ডিজিটালে।
Advertisement
দেশটির অনেক ইনস্টিটিউটের মতো হায়দরাবাদের টি-হাব ও টি-ওয়ার্ক করছে এ কাজটি। যে কোনো ফলপ্রসূ আইডিয়া নিয়ে টি-ওয়ার্কসে গেলে আপনি খালি হাতে ফিরবেন না। আর্থিক ও কারিগরি সব ধরনের সহযোগিতা দেয় প্রতিষ্ঠানটি। টি-ওয়ার্কস ভারতে সবচেয়ে বড় উদ্ভাবনী আইডিয়া বাস্তবায়নের প্রতিষ্ঠান। উদ্যোগ বেসরকারি হলেও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে যাচ্ছে দুটি প্রতিষ্ঠানই।
টি-হাবের ক্যাম্পাস
পাশাপাশি দুটি ভবন টি-হাব ও টি-ওয়ার্কস। নান্দনিক ভবনগুলো বানানো হয়েছে সরকারি খরচে। তেলেঙ্গানা রাজ্যের হায়দরাবাদের এ দুটি বিল্ডিংই এখন বিশ্বের বৃহত্তম ইনোভেশন ক্যাম্পাস। এটি সম্পূর্ণ বেসরকারি অলাভজনক ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত। টেক স্টার্টআপকে সহযোগিতা দিয়ে দেশি ও বিশ্ব বাজারে নিয়ে যাওয়াই এদের কাজ। এই সহযোগিতার জন্য কোনো শেয়ারও ছাড়তে হয় না উদ্যোক্তাকে। তরুণদের চিন্তা তাই কোনো গণ্ডিতে থেমে থাকছে না। ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। স্বল্পমূল্যে বিশ্বের প্রযুক্তি নেতৃত্ব দেওয়া চীনকে টেক্কা দেওয়ার কথা ভাবছেন প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা।
Advertisement
আরও পড়ুন>> বাংলাদেশে সৌরশক্তির ব্যবহার বাড়াতে কাজ করছে ভারত
সম্প্রতি মহাকাশ অভিযানের জন্য রকেট প্রস্তুতের সময় হঠাৎ একটি যন্ত্রাংশের সমস্যা দেখা দেয়। আকাশযাত্রার ঠিক এক সপ্তাহ আগে যন্ত্র বিকল হওয়ায় চিন্তায় পড়ে যায় ইসরো। তাদের বিজ্ঞানীরা শরণাপন্ন হন টি-ওয়ার্কসের। দুই প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্টায় সেই যন্ত্রাংশ সফলভাবে বানায় টি-ওয়ার্কস। এগুলোই তাদের সাহস জোগায়। প্রযুক্তিতে পরদেশ নির্ভরতা নয়, বরং দেশের প্রযুক্তিতে কীভাবে বিদেশেও রপ্তানি করা যায় সেটা নিয়ে কাজ করছে ভারত।
টি-হাব অফিসে ব্রিফ করছেন চন্দ্রলেখা
ভারত সফররত সাংবাদিক প্রতিনিধি দল গত ১৯ অক্টোবর হায়দরাবাদের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান দুটি পরিদর্শন করে। প্রথমে টি-হাব ঘুরিয়ে তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত করেন প্রতিষ্ঠানটির তরুণ কর্মকর্তা চন্দ্রলেখা চৌধুরী। তিনি মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার।
Advertisement
সুন্দর সাজানো কর্মক্ষেত্রটি ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে তিনি জানান, টি-হাব মূলত উদ্ভাবনী ইকোসিস্টেম নিয়ে কাজ করে। সমৃদ্ধ করে টেক স্টার্টআপ। ২০১৫ সালে প্রতিষ্ঠার পর বিশ্বের ৪২টি দেশের সঙ্গে দুই হাজারের বেশি স্টার্টআপ নিয়ে কাজ করেছে টি-হাব। নেতৃস্থানীয় জাতীয় ও বৈশ্বিক করপোরেশনগুলোর উদ্ভাবনকে উন্নত করতে কাজ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। করপোরেশনগুলোর ব্যবসায়িক মডেলগুলো নার্সিং করে আরও ভালো অবস্থানে নিতে কাজ করছে টি-হাব।
টি-হাবে কাজ করছেন কর্মীরা
আরও পড়ুন>> চিকুনগুনিয়া ও লাম্ফি ভাইরাসের টিকা অনুমোদন পর্যায়ে
উদ্ভাবনী আইডিয়ার মতো অফিসের ডেকোরেশনও নজর কাড়বে যে কারও। প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের গড় বয়স ৩৮ বছর। এখানে চাকরির ক্ষেত্রেও ব্যাপক যাচাই-বাছাই করা হয় বলে জানান তিনি। মোট আবেদন থেকে হয়তো দুই অথবা তিন শতাংশ ব্যক্তিকে চাকরি দেওয়া হয়। এজন্য এখানে যারা কাজ করে তাদের অত্যন্ত ট্যালেন্ট ভাবা হয়। প্রতিষ্ঠানটি বিনিয়োগ ছুঁয়েছে প্রায় দুই হাজার কোটিতে। টি-ব্রিজ প্রোগ্রামের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী স্টার্টআপ নিয়ে সহযোগিতা করে টি-হাব।
ঘরে বসেই হার্ট মনিটরিংয়ের জন্য ‘মনিত্রা’ নামে একটি অ্যাপস বাজারজাত করছে টি-হাব। এটি বুকে রেখে হার্টের পালস রেটসহ হার্টের সম্ভাব্য সমস্যা আগাম জানান দিতে সক্ষম। তবে এটিকে শতভাগ সঠিক ধরে নেওয়া যাবে না বলে জানান চন্দ্রলেখা।
টি-ওয়ার্কসের প্যাকেজিং মেশিনের কাজ
আরও পড়ুন>> পূর্ণ স্কলারশিপে আইআইটি হায়দ্রবাদে দুই বাংলাদেশি তরুণ
পরে পাশের বিল্ডিং টি-ওয়ার্কসে নিয়ে যাওয়া হয় আমাদের। হায়দরাবাদ শহরের হাইটেক সিটির প্রাণকেন্দ্রে ৪ দশমিক ৭৯ একর জমির ওপর টি-ওয়ার্কস ক্যাম্পাস। সেখানে বীরা চাপ্পি, ডিরেক্টর-পার্টনারশিপস, পিপল অ্যান্ড কালচার আমাদের পুরো প্রতিষ্ঠান ঘুরিয়ে দেখান। যখন সেখানে হাজির হই দুর্গাপূজার ষষ্ঠী উদযাপন চলছিল। প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা নাচ-গানের মাধ্যমে উদযাপন করছিলেন উৎসব। বাংলাদেশি সাংবাদিকদের পেয়ে তারাও উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। এক পর্যায়ে তাদের সঙ্গে নাচে যোগ দেন কয়েকজন সহকর্মী। অফিসে এমন পরিবেশ সত্যি অভাবনীয়।
বীরা চাপ্পি জানান, যেসব নির্মাতা ও উদ্ভাবক ব্যর্থতা ভয় পান না, তাদের উদ্ভাবন ও পরীক্ষামূলক কার্যক্রমকে উৎসাহিত করতে ২০১৭ সালে টি-ওয়ার্কস প্রতিষ্ঠা করে তেলেঙ্গানা সরকার। নতুন এ ভবন উদ্বোধন হয় ২০২৩ সালের মার্চে। উদ্বোধনের আগে এটি ছিল পুরোটাই ঢাকা। সুইচ টিপে উন্মোচন করা হয় বিশাল এ ভবন। ভারতের এভাবে এত বড় ভবনের উদ্বোধন এটাই ছিল প্রথম।
রকেটের জন্য তৈরি যন্ত্রাংশ দেখাচ্ছেন বীরা চাপ্পি
তিনি বলেন, ভবনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে দিনের বেলা বেশি বিদ্যুৎ লাগে না। প্রচুর আলো-বাতাস আসার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ইকোসিস্টেমকে সর্বোচ্চ কাজে লাগায় প্রতিষ্ঠানটি।
এখানে কেউ কোনো আইডিয়া বা সমস্যা নিয়ে এলে পূর্ণ সহযোগিতা করা হয়। এখানে আধুনিক সব মেশিন আছে। কেউ কোনো ডিজাইন নিয়ে এলে যদি কাটিং করা প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয় যদি তিনি ন্যূনতম অভিজ্ঞও হন। কাগজ, কাঠ, স্পঞ্জ, লোহা সব কিছুর ডিজাইন কাটিং হয় প্রতিষ্ঠানটিতে- জানান বীরা চাপ্পি।
টি-ওয়ার্কসের মেশিনারিজের একাংশ
প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন মেশিনারিজ ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে তিনি বলেন, আমাদের কাছে তরুণরা কোনো উদ্ভাবন নিয়ে এলে তাকে ৯৫ শতাংশ সাপোর্ট আমরা দেওয়ার চেষ্টা করি; সেটা আর্থিক কিংবা মেশিনারিজ যাই হোক। ভারত প্রযুক্তিকে সর্বোচ্চ এগিয়ে নিতে কাজ করছে। একসময় আমরা চীন নির্ভরতা কাটাতে চাই।
এসময় চন্দ্রযানের জন্য তৈরি মেটাল যন্ত্রাংশও যে কদিন আগে এখানেই তৈরি হয়েছে সেটাও জানান তিনি। কোনো কিছুকেই অসম্ভব মনে করে না টি-ওয়ার্কস।
এএসএ/জিকেএস