যে কোনো দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতে খাদ্যনিরাপত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আর খাদ্যনিরাপত্তা বলতে প্রথমেই আমরা বুঝি চালের নিরাপত্তা বা পর্যাপ্ত চালের জোগান। দেশে চালের উৎপাদন বাড়াতে নানান উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিশেষ করে হাইব্রিড জাতের ধান চাষে কৃষকদের আগ্রহী করতে নেওয়া হয়েছে নানান পদক্ষেপ। হাইব্রিড ধান চাষে কৃষকদের প্রণোদনাও দিচ্ছে সরকার। এতে দেশে ধান-চালের উৎপাদন বাড়বে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।
Advertisement
বাংলাদেশে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চালের উৎপাদন আগের চেয়ে কমার পূর্বাভাস করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ)। কারণ, অর্থবছরের শুরুতে প্রচণ্ড তাপপ্রবাহে কমেছিল আউশের উৎপাদন। তবে পূর্বাভাসের পরপরই বেশ অনুকূলে আসে দেশের আবহাওয়া। ফলে চলতি আমন মৌসুমে উৎপাদন আশানুরূপ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: বোরো চাষে দরদি কৃষক, এ বছর সুখবরের সম্ভাবনা
এ পরিস্থিতিতে আসন্ন বোরো মৌসুমের উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে চায় সরকার। আউশের ঘাটতি এড়াতে প্রাথমিকভাবে আসন্ন বোরোর উৎপাদন তিন-চার শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। সেজন্য এ দফায় হাইব্রিড জাতের ধান চাষে দেওয়া হচ্ছে ‘বিশেষ গুরুত্ব’। এমনকি হাইব্রিড জাতের ধান চাষে কৃষক পর্যায়ে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার।
Advertisement
আসন্ন বোরো মৌসুমের উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে চায় সরকার। আউশের ঘাটতি এড়াতে প্রাথমিকভাবে আসন্ন বোরোর উৎপাদন তিন-চার শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। সেজন্য এ দফায় হাইব্রিড জাতের ধান চাষে দেওয়া হচ্ছে ‘বিশেষ গুরুত্ব’।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি (২০২৩-২৪) অর্থবছরের আসন্ন মৌসুমে ৫০ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর জমিতে ২ কোটি ১৭ লাখ টন বোরো উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে। যেখানে গত মৌসুমে (২০২২-২৩ অর্থবছর) উৎপাদন হয় ২ কোটি ৭ লাখ টন। তবে গত অর্থবছরের উৎপাদন তার আগের বছরের থেকে প্রায় দুই লাখ টন কম ছিল। আগের অর্থবছরে উৎপাদন হয় ২ কোটি ৯ লাখ টন।
ঘাটতি মেটাতে এবার (আসন্ন মৌসুমে) লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় দুই লাখ হেক্টর বেশি জমিতে বোরো চাষের উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। গত মৌসুমে বোরো আবাদ হয় ৪৮ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে। এবার বাড়তি জমির মধ্যে এক লাখ ৯২ হাজার হেক্টরে চাষ হবে হাইব্রিড জাতের ধান। সেখানে হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক ৯৫ টন ফলন ধরে ৯ লাখ ৫০ হাজার টন অতিরিক্ত চাল উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে।
আরও পড়ুন: জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় খরচ বেড়েছে বোরো চাষে, অস্বস্তিতে কৃষক
Advertisement
এসব বিষয়ে কথা হয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক তাজুল ইসলাম পাটোয়ারীর সঙ্গে। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘আমরা (কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর) উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়ে পরিকল্পনা তৈরি করেছি। কৃষি মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে শিগগির এটি চূড়ান্ত হবে। এবার আমরা হাইব্রিড চাষাবাদে গুরুত্ব দিচ্ছি।’
তিনি বলেন, ‘খাদ্যনিরাপত্তা বলতে আমরা সবচেয়ে আগে চালের নিরাপত্তাকে বুঝি। সেক্ষেত্রে হাইব্রিড ধানের ফলন বেশি, দ্রুত উৎপাদন বাড়াতেও অধিক সহায়ক।’
তাজুল ইসলাম পাটোয়ারী আরও বলেন, ‘বাড়তি প্রায় দুই লাখ হেক্টর জমি থেকে ধান উৎপাদন তিন-চার শতাংশ বেশি হবে। গত কয়েক বছর দ্রুত হাইব্রিড জাত জনপ্রিয় হচ্ছে।’
গত কয়েক মৌসুমে চালের উৎপাদন সন্তোষজনক থাকায় দেশে চলতি অর্থবছরে চাল আমদানির প্রয়োজন হয়নি এখনো। তবে গত আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল- বাংলাদেশে এ বছর চালের উৎপাদন আগের চেয়ে ৭ লাখ টন কম হতে পারে। এতে বাংলাদেশকে চাল আমদানি ৩ লাখ টন বাড়িয়ে ১০ লাখ টনে উন্নীত করতে হতে পারে বলে আশঙ্কা করে সংস্থাটি।
আরও পড়ুন: ধান বেচে উঠছে না উৎপাদন খরচ, দিশেহারা কৃষক
তবে, ইউএসডিএ’র পূর্বাভাসের সময় আউশের উৎপাদন কম ছিল। এরপর চলতি মৌসুমে আমনের উৎপাদন কমার শঙ্কা থাকলেও তা কমেনি, বরং বেড়েছে। এমন তথ্য জানিয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিনে উইংয়ের উপ-পরিচালক (মনিটরিং) আবু জাফর আল মুনছুর জাগো নিউজকে বলেন, ‘গত আমনে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫৮ লাখ ৫৯ হাজার টন। যেখানে আমরা ৬০ লাখ টনের কাছাকাছি উৎপাদন করেছি।’
ইউএসডিএ’র পূর্বাভাসে বাংলাদেশে চাল উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে ধরার কারণ হিসেবে বলা হয়, শেষ আউশের ভরা মৌসুমে বাংলাদেশে টানা তাপপ্রবাহ ছিল। বৃষ্টিও কম হয়েছে। গত জুলাই মাসে আমন মৌসুমের শুরুতেও আবহাওয়া ছিল একই ধরনের।
ইউএসডিএ’র ওই পূর্বাভাসে বাংলাদেশে চাল উৎপাদনের পরিমাণ কমিয়ে ধরার কারণ হিসেবে বলা হয়, শেষ আউশের ভরা মৌসুমে বাংলাদেশে টানা তাপপ্রবাহ ছিল। বৃষ্টিও কম হয়েছে। গত জুলাই মাসে আমন মৌসুমের শুরুতেও আবহাওয়া ছিল একই ধরনের।
তবে পরে আগস্টে বাংলাদেশে ভারী বৃষ্টি হয়। যে কারণে আমনের উৎপাদন ভালো হয়েছে। যদিও বছরের শুরুতে তাপপ্রবাহে আউশের উৎপাদন কমেছিল। গত বছর আউশ ধান চাষ হয়েছিল ১১ লাখ হেক্টর জমিতে। এ বছর যা কমে হয়েছে ১০ লাখ ৪৫ হাজার হেক্টর। এতে উৎপাদন ৩২ লাখ টন থেকে কমে নেমে যায় ২৯ লাখ টনে।
হাইব্রিড জাত চাষে প্রণোদনাচাষিদের হাইব্রিড জাতের ধান চাষে উদ্বুদ্ধ করতে গত কয়েক বছর ধরে প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। সবশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৫ লাখ কৃষককে হাইব্রিড জাতের বীজ বিনামূল্যে দেওয়া হয়েছিল। এতে ২ লাখ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড জাতের ধানের আবাদ বৃদ্ধি পায়। চাল উৎপাদন বাড়ে ৯ লাখ ৮৩ হাজার টন।
আরও পড়ুন: সমলয় পদ্ধতিতে বোরো চাষে বেশি ফলন পাচ্ছেন কৃষকরা
আসন্ন বোরো মৌসুমেও হাইব্রিড জাতের ধানের আবাদ ও উৎপাদন বাড়াতে ৯০ কোটি টাকার প্রণোদনা দেওয়া হবে। মাঠ পর্যায়ে শিগগির শুরু হবে প্রণোদনা বিতরণ কার্যক্রম।
এ প্রণোদনার আওতায় ১৪ লাখ ৪০ হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এক বিঘা জমিতে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় দুই কেজি হাইব্রিড জাতের বীজ পাবেন বিনামূল্যে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, প্রণোদনার ফলে বোরো মৌসুমে হাইব্রিড জাতের ধানের আবাদ এক লাখ ৯২ হাজার হেক্টর বাড়বে। হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক ৯৫ টন ফলন ধরে অতিরিক্ত চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৯ লাখ ৫০ হাজার টন।
বোরো চাষে ব্যয় বাড়বেসেচ, কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি, সারসহ নানা খাতে এবার বোরো উৎপাদন খরচ আগের তুলনায় বাড়বে। সামনের দিনগুলোয় তা আরও বাড়তে পারে। এতে চিন্তিত কৃষকরা। তারা বলছেন, উত্তরাঞ্চলে বোরো ধান চাষে দু-তিন বছরের ব্যবধানে প্রতি বিঘা জমিতে বাড়তি পাঁচ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। কিন্তু গত মৌসুম শেষে ধানের ন্যায্যমূল্য না পেয়ে উৎপাদন খরচ উঠছে না।
নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার কোলা গ্রামের কৃষক ফজলুল হক বলেন, এ বছর প্রায় সাত বিঘা জমিতে বোরো চাষের প্রস্তুতি নিচ্ছি। গত মৌসুম থেকে এ বছর বোরো ধান চাষাবাদে খরচ অনেক বেশি পড়বে। কারণ, গত বছর প্রতি ঘণ্টায় (পুরো মৌসুমে) সেচের পানি নিতে খরচ প্রায় দুই হাজার টাকা বেড়েছে। এছাড়া সার, কীটনাশক ও বীজের দামও বাড়তি।
কয়েকজন কৃষক জানান, প্রতি কেজি বীজধান গত বছর ২০০-২৫০ টাকা ছিল, সেটা এখন ৩৫০ টাকা। এছাড়া সরকার সারের দাম বাড়ানোর পরে এ খাতে খরচ ২ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। একই সঙ্গে কীটনাশক, ধান রোপণের মজুরি, শ্রমিকের পারিশ্রমিক, ধান মাড়াইসহ পরিবহনে গুনতে হবে বাড়তি খরচ।
আরও পড়ুন: আউশের মৌসুমে বোরো ধান চাষ
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) হিসাবে, চলতি মৌসুমে বোরোতে এক কেজি চাল উৎপাদনের খরচ ৩ টাকা বেড়ে হবে প্রায় ৪১ টাকা। ধানের খরচ কেজিপ্রতি ২৮ টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৩১ টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত বছর থেকে বেশি দামে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও সার কেনায় বেড়েছে খরচ।
চলতি মৌসুমে বোরোতে এক কেজি চাল উৎপাদনের খরচ ৩ টাকা বেড়ে হবে প্রায় ৪১ টাকা। ধানের খরচ কেজিপ্রতি ২৮ টাকা থেকে বেড়ে প্রায় ৩১ টাকায় দাঁড়িয়েছে। গত বছর থেকে বেশি দামে জ্বালানি তেল, বিদ্যুৎ ও সার কেনায় বেড়েছে খরচ।
এসব বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ এম আসাদুজ্জামান জাগো নিউজকে বলেন, ‘কৃষকদের খরচ অস্বাভাবিক বেড়েছে। শুধু হাইব্রিড নয়, অন্য জাতের ধান চাষের জন্যও প্রণোদনা প্রয়োজন। পাশাপাশি কৃষকের ফসলের ভালো দাম দিলেই যথেষ্ট উৎপাদন সম্ভব। দাম না পেলে তারা আগ্রহ হারাবে।’
বেড়েছে চালের উৎপাদন বাংলাদেশে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ কোটি ৮০ লাখ টন চাল উৎপাদিত হয়েছিল। পরের অর্থবছর (২০২২-২৩) উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৯০ লাখ ৯৫ হাজার টন। দশ বছর আগের তুলনায় এখন অন্তত ৫০ লাখ টন চাল বেশি উৎপাদন হচ্ছে। ২০১০-১১ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৮০ হাজার টন।
বাংলাদেশে তিন মৌসুমে চাল উৎপাদন হয়। সবচেয়ে বড় মৌসুম বোরো। এ মৌসুমে ধান আবাদ করা হয় ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে। চাল ওঠে এপ্রিল ও মে মাসে। বোরোর পরই আউশের আবাদ হয়। আমনের আবাদ হয় ভরা বর্ষায়। আউশ ও আমন বৃষ্টিনির্ভর হলেও বোরো সেচনির্ভর।
গত অর্থবছর (২০২২-২৩) দুই কোটি ৭ লাখ টন বোরো, এক কোটি ৫৪ লাখ টন আমন ও ২৯ লাখ টন আউশ ধান উৎপাদন হয়েছে। গত এক দশকে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বোরোর উৎপাদন। তবে এসময় আউশের উৎপাদন কমেছে।
এনএইচ/কেএসআর/এসএইচএস/জিকেএস