বেশ কয়েকদিন ধরে ইসরায়েল আভাস দিয়ে যাচ্ছে যে, তাদের বিশাল সৈন্য বাহিনী হামাসকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে গাজায় অভিযান চালানোর জন্য প্রস্তুত। এরই মধ্যে ইসরায়েলের ডিফেন্স ফোর্স-আইডিএফের তিন লাখ সংরক্ষিত সেনা সদস্যকে ডাকা হয়েছে।
Advertisement
গাজা সীমান্তের অন্যপাশে ইসরায়েল অংশের ছোট ছোট শহর, মাঠ আর শস্যক্ষেত এখন ট্যাংক, গোলা বারুদ ও ভারী অস্ত্রে সুসজ্জিত হাজারও সেনাসদস্য দিয়ে ভর্তি। ইসরায়েলি বিমান ও নৌ বাহিনী হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের আস্তানা ও অস্ত্রাগার লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। এসব হামলায় অসংখ্য বেসামরিক নাগরিক হতাহত হচ্ছে। অন্যদিকে, অল্প সংখ্যক হামাস নেতা নিহত হয়েছেন।
কিন্তু কেন এখনো গাজায় স্থল অভিযানের ঘোষণা দিয়েও তা শুরু করছে না ইসরায়েল? বিবিসি বলছে, এর পেছনে আসলে অনেকগুলো কারণ রয়েছে।
বাইডেন ফ্যাক্টর
Advertisement
চলতি সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের তাড়াহুড়ো করে ইসরায়েল সফর জানান দেয়, পরিবর্তিত পরিস্থিতি নিয়ে হোয়াইট হাউজ কতটা চিন্তিত। ওয়াশিংটনের দুশ্চিন্তার জায়গা দুটো; মানবিক বিপর্যয় ক্রমেই বেড়ে যাওয়া ও মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে সংঘাত ছড়িয়ে পড়া।
জো বাইডেন এরই মধ্যে পরিষ্কার করে জানিয়েছেন, যে গাজা থেকে ২০০৫ সালে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিল ইসরায়েল, সেটা আবারও দখলে নেওয়ার বিরুদ্ধে তিনি। তার ভাষায়, এটা হবে ইসরায়েলের জন্য বড় একটি ভুল।
সরকারিভাবে তার এই ইসরায়েল সফরের প্রধান কারণ মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রকে কৌশলগত সহায়তা দেওয়া ও একই সঙ্গে গাজা নিয়ে ইসরায়েলের পরিকল্পনা শোনা।
তবে অপ্রকাশিত কারণ হলো বাইডেন এই সফরে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর ‘চরমপন্থী’ সরকারকে একটু ছাড় দেওয়ার ব্যাপারে কথা বলবেন। যুক্তরাষ্ট্র জানতে চায়, ইসরায়েল যদি গাজায় প্রবেশ করে, তবে তারা সেখান থেকে কখন ও কীভাবে বের হওয়ার পরিকল্পনা করছে।
Advertisement
ইরান ফ্যাক্টর
গত কয়েক দিনে ইরান স্পষ্ট হুমকি দিয়ে বলেছে, গাজায় ইসরায়েল যে বর্বর হামলা চালাচ্ছে তার যথাযথ উত্তর দেওয়া হবে। এখন এটার মানে কী?
ইরান মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীকে তহবিল, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে ও কোনো কোনো এসব সশস্ত্র গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণও করে থাকে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কার্যকর লেবাননের হিজবুল্লাহ, যাদের অবস্থান একেবারে ইসরায়েলের উত্তর সীমান্ত ঘেঁষে।
হিজবুল্লাহ ২০০৬ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী ও বিধ্বংসী যুদ্ধে জড়ায়, যখন ইসরায়েলের আধুনিক সব অস্ত্র প্রতিপক্ষের পরিকল্পিত হামলা ও লুকানো মাইনের কাছে হার মানে।
তারপর থেকে ইরানের সহায়তায় হিজবুল্লাহ পুনরায় নতুন করে নিজেদের সংগঠিত করেছে এবং ধারণা করা হয় তাদের কাছে এখন অন্তত দেড় লাখ রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যার অনেকগুলোই দূরপাল্লার ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যে আঘাত হানতে সক্ষম।
ফলে একটা হুমকি তো আছেই যে, যদি ইসরায়েল গাজায় অভিযান শুরু করে তাহলে হিজবুল্লাহ হয়তো ইসরায়েলের উত্তর সীমান্ত দিয়ে পাল্টা হামলা শুরু করবে, যা তাদের দুই দিকে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিতে পারে।
তবে এর কোনো নিশ্চয়তা নেই যে, হিজবুল্লাহ এসময় এরকম একটা যুদ্ধে জড়াবে। বিশেষ করে, যখন ভূমধ্যসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের দুটি রণতরী প্রস্তুত হয়ে আছে ইসরায়েলকে সহায়তা করার জন্য। এটি বরং ইসরায়েলকে ভরসা দিচ্ছে যে হিজবুল্লাহর দিক থেকে যদি কোন আঘাত আসে তাহলে তাদের মার্কিন বিমান বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে।
তবে এক্ষেত্রে স্মরণ করা যেতে পারে যে, ২০০৬ সালের যুদ্ধের সময় হিজবুল্লাহর একটি অত্যাধুনিক অ্যান্টি-শিপ মিসাইল ইসরায়েলের একটি যুদ্ধজাহাজকে আঘাত করতে পেরেছিল।
মানবিক ফ্যাক্টর
ইসরায়েলি সরকার গাজা থেকে হামাসকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করতে গিয়ে মানবিক বিপর্যয়ের বিষয়টি যেন বাকি বিশ্বের উপর চাপিয়ে দিয়েছে।
ইসরায়েলের টানা বিমান হামলায় যখন ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের মৃত্যু সংখ্যা বাড়তে শুরু করে, তখন সারা বিশ্ব সাতই অক্টোবর হামাসের নজিরবিহীন হামলার পর ইসরায়েলিদের দিকে যে সমবেদনা দেখিয়েছে, তা ধীরে ধীরে গাজায় বিমান হামলা বন্ধ ও নিরাপরাধ বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষার দিকে গিয়েছে।
যদি কখনো ইসরায়েলি বাহিনী স্থল অভিযান শুরু করে তাহলে হতাহতের এ সংখ্যা আরও বাড়বে। গুপ্ত হামলা, স্নাইপার ও বুবি ট্র্যাপে ইসরায়েলি সেনারাও মারা পড়বে। আর বেশিরভাগ যুদ্ধই হয়তো হবে মাটির নিচে ছড়িয়ে থাকা মাইলের পর মাইল টানেলে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও শেষ পর্যন্ত এর মূল্য হয়তো দিতে হবে সাধারণ মানুষকেই।
বড় গোয়েন্দা ব্যর্থতা
ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থার জন্য খুবই খারাপ একটা মাস যাচ্ছে। দেশটির ঘরোয়া গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত হামাসের এত বড় মারাত্মক হামলার পরিকল্পনা আগে থেকে আঁচ করতে না পারায় কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছে।
গাজার ভেতরে তাদের তথ্যদাতা ও স্পাইয়ের একটা নেটওয়ার্ক থাকার কথা, যারা হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদের নেতাদের গতিবিধির উপর নজর রাখে। কিন্তু এরপরও সেই ভয়ংকর শনিবারের সকালে যা ঘটেছে, তা ১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপুর যুদ্ধের পর দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলে মনে করা হচ্ছে।
ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা সেটি কাটিয়ে উঠতে গত ১০ দিন ধরে অবিরাম কাজ করছে। হামাসের হাতে আটক জিম্মিদের নাম শনাক্ত করতে ও তাদের কোথায় রাখা হয়েছে সেই অবস্থান খুঁজে বের করার জন্য তারা কাজ করছে। একই সঙ্গে হামাস নেতারা কোথায় লুকিয়ে রয়েছেন, সেটার তথ্য দিয়েও আইডিএফকে সহায়তা করছে তারা।
ফলে এই সম্ভাবনাও রয়েছে যে, তারা তথ্য সংগ্রহের জন্য আরেকটু সময় চেয়েছে যাতে, সামরিক অভিযান শুরু হলে উত্তর গাজার ধ্বংসস্তুপের মধ্যে এলোমেলো ঘুরে বেড়িয়ে হামলার শিকার হওয়ার চেয়ে একেবারে নির্দিষ্ট জায়গায় যেতে পারে।
ইসরায়েলের একের পর এক বিমান হামলার পরও হামাস ও ফিলিস্তিনি ইসলামিক জিহাদ তাদের কার্যক্রম চলমান রেখেছে। তাছাড়া তারা নিশ্চয় ইসারয়েলি সৈন্যদের জন্য পরিকল্পিত হামলার নকশা ও ফাঁদ পেতে রেখেছে, যা মাটির নিচে তৈরি করা টানেলে ইসরায়েলিদের জন্য আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
সূত্র: বিবিসি
এসএএইচ