ঢাকা-১৭। রাজধানীর গুলশান, বনানী, বারিধারা ও ক্যান্টনমেন্ট এলাকা নিয়ে গঠিত আসন। অভিজাত এ আসনটিতে আওয়ামী লীগের মনোযোগ কম। টানা তিন নির্বাচনে দলের বাইরের প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে দলটি। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনেও এমন অমনোযোগী থাকলে ফলাফল বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।
Advertisement
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আসনটি মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে ছেড়ে দেয়। ২০১৪ সালের নির্বাচনে দেয় জোটের শরিক বিএনএফের এস এম আবুল কালাম আজাদকে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে সরাসরি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে আকবর হোসেন পাঠানকে (চিত্রনায়ক ফারুক) মনোনয়ন দেয়। এ তিনজনের কারওই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও জনসাধারণের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠেনি।
আরও পড়ুন>> ভোটকেন্দ্রে হিরো আলমকে ধাওয়া
ফলে টানা তিন মেয়াদে স্থানীয় সংসদ সদস্যের ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে যোগাযোগ ও সম্পর্ক ছিল না।। সম্প্রতি আকবর হোসেন পাঠানের মৃত্যুতে অনুষ্ঠিত উপ-নির্বাচনে মূলত আসনটিতে আওয়ামী লীগে অবস্থান আয়নার মতো ভেসে উঠেছে।
Advertisement
উপ-নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাতকে। এনিয়েও স্থানীয় নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ বা ক্ষোভ ছিল। যার প্রতিফলনও হয়েছে ভোটে। ওই সময়ে ক্ষমতাসীন দলটির চ্যালেঞ্জ ছিল ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসা। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীও দফায় দফায় এটি বলেছেন এবং চিহ্নিত এ সমস্যাটি সমাধানে ব্যর্থ হয়েছেন।
বিরোধীদল যদি মাঠে না থাকে, তাহলে আমাদের মূল্যায়নের দরকারটা কী? তখন তো দলের প্রধান যাকে ইচ্ছে মনোনয়ন দিয়ে দিতেই পারেন। এজন্য আমরা ওয়েলকাম জানাই বিএনপিকে, তারা নির্বাচনে আসুক। তারপরে আমাদের মূল্যায়ন হবে, তখন সঠিকভাবে নমিনেশন হবে।
এ আসনের উপ-নির্বাচনে ভোট পড়েছে ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ। তিন লাখ ২৫ হাজার ২০৫ ভোটারের মধ্যে ৩৭ হাজার ৪২০ জন ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছেন। এর মধ্যে বাতিল হয়েছে ৩৮৩ ভোট। ভোটে আওয়ামী লীগ মনোনীত মোহাম্মদ আলী আরাফাত (মোহাম্মদ এ আরাফাত) ২৮ হাজার ৮১৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। অপরদিকে, স্বতন্ত্রপ্রার্থী আলোচিত সোশ্যাল মিডিয়া কনটেন্ট ক্রিয়েটর মো. আশরাফুল আলম (হিরো আলম) পেয়েছেন ৫ হাজার ৬০৯ ভোট।
আরও পড়ুন>> সবচেয়ে খারাপ সময় পার করছি, এখন অপেক্ষা চূড়ান্ত বিজয়ের: ফখরুল
Advertisement
স্থানীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, ঢাকা-১৭ আসনে স্বাধীনতার আগ থেকেই কাজ করেন এমন নেতা আওয়ামী লীগে আছেন। স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগের সংগঠনে ধারাবাহিক নেতৃত্ব দেওয়ার লোকও আছেন। ডাকসাইটে থাকা নেতাদের এড়িয়ে অন্যদের মনোনয়ন দেওয়ায় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সমর্থক পর্যায়েও এর প্রভাব পড়েছে। সামনেও এর প্রভাব থাকবে।
ঢাকা-১৭ আসনে স্বাধীনতা-উত্তর আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেওয়া নেতাদের এড়িয়ে অন্যদের মনোনয়ন দেওয়ায় নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সমর্থক পর্যায়েও এর প্রভাব পড়েছে। সামনেও থাকবে।
সদ্য নির্বাচিত সংসদ সদস্য ও নেতাকর্মীরা বলছেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের চ্যালেঞ্জ হলো- ‘সংগঠনকে গুছিয়ে নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসা।’
বর্তমান সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী আরাফাত জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখানে প্রচুর নৌকার ভোট আছে। মোট ভোটারের মধ্যে ৪৭ হাজার উচ্চবিত্ত। এর বাইরে সব মধ্যবিত্ত ও নিম্নআয়ের। এদের অধিকাংশ ভোট নৌকার। এটা আনতে হবে ব্যালটে। এজন্য এখানকার সংগঠনকে গুছিয়ে সম্মিলিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’
আরও পড়ুন>> এখনো সময় আছে এক্সিট নেন: প্রধানমন্ত্রীকে ফখরুল
তবে এ আসনে নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আসনটিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন প্রায় নির্ধারিত। উপ-নির্বাচনে আসা মোহাম্মদ আলী আরাফাতই পাবেন মনোনয়ন। এছাড়া এ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চান ডাকসাইটে থাকা আওয়ামী লীগের জাতীয় কমিটির সদস্য মোহাম্মদ ওয়াকিল উদ্দিন, ঢাকা মহানগর উত্তরের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আবদুল কাদের খান ও বনানী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম জসিম উদ্দিন। যদিও এসব নেতা অভিমানে নিশ্চুপ ও নিষ্ক্রিয়। তবে, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হলে মাঠে নামবেন তারা।
সাংগঠনিকভাবে এলাকাটি গোছানো নেই। আমার কাজ হলো, এখানে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করা। এটা আমি করতে চেষ্টা করছি। নমিনেশন যেই পাক, সেটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। —মোহাম্মদ এ আরাফাত
মনোনয়নের বিষয়ে ঢাকা মহানগর উত্তরের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ আবদুল কাদের খান বলেন, ‘রাজনীতি করি। প্রার্থী ছিলাম, সামনেও হতেই পারি। কিন্তু দলের প্রধানের সঙ্গে আলাপ করে পরে বলতে পারবো।’
তিনি বলেন, ‘বিরোধীদল যদি মাঠে না থাকে, তাহলে আমাদের মূল্যায়নের দরকারটা কী? তখন তো দলের প্রধান যাকে ইচ্ছে মনোনয়ন দিতেই পারেন। এজন্য আমরা ওয়েলকাম জানাই বিএনপিকে, তারা নির্বাচনে আসুক। তারপরে আমাদের মূল্যায়ন হবে, তখন সঠিকভাবে নমিনেশন হবে।’
উপ-নির্বাচনের ভোটের চিত্র নিয়ে কথা হয় সংশ্লিষ্ট এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর মফিজুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন ও উপ-নির্বাচন তো এক নয়। জাতীয় নির্বাচনে সবদলের অংশগ্রহণে উৎসবমুখর হয়। দীর্ঘ পাঁচ বছর পরের এ নির্বাচনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেন নাগরিকরা।
আরও পড়ুন>> নির্বাচনে পর্যবেক্ষক টিম পাঠাবে ইইউ, থাকবে দুই মাস
এমপির বরাদ্দ পান কি না, জানতে চাইলে এ কাউন্সিলর বলেন, ‘এর আগে তো পাইনি। তবে, বর্তমান এমপি তিনদিন আগে আমাদের থেকে তালিকা নিয়েছেন। এ সপ্তাহে অর্থ ছাড় করবে। আগামী সপ্তাহে আরও একটা বরাদ্দ পাবো। এছাড়া আমাদের সরকার ১৪ বছরে বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, রেশন কার্ডসহ বিভিন্ন ধরনের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করেছে।’
নেত্রী যাকে মনোনয়ন দেবেন, আমরা তার নির্বাচনই করবো। আমরা নৌকা চিনি, ব্যক্তি নয়। নেত্রী যাকে নৌকা প্রতীক দেবেন আমরা তার পক্ষে নির্বাচন করবো। আমরা বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার সৈনিক।
ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর উত্তর যুবলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি জাকির হোসেন বাবুল বলেন, ‘উপ-নির্বাচনে তো এমনিতেই লোক কম যায়। তারপরও যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে অন্তত বেশি ছিল। সামনে জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব থাকবে না। ওটা ভালো হবে।’
প্রার্থী নিয়ে নেতাকর্মীদের ক্ষোভের কথা জানিয়ে তিনি বলেন, এটা তো মাঠে অবশ্যই আছে। যারা কষ্ট করছে দীর্ঘদিন, তারা আশা করছে, আওয়ামী লীগ করে নমিনেশন পাবে। একটু তো ক্ষোভ থাকতেই পারে। কিন্তু আমাদের দলে বা সংগঠনে ক্ষোভ থাকলেও রাখে না, থাকে না। কারণ নেত্রী যাকে নৌকা দেবেন, তার নির্বাচন করতে হবে। এ পর্যন্ত এরশাদ, আবুল কালাম আজাদ, নায়ক ফারুককে দিছে আমরা ভোট করেছি। নেত্রী যাকে দেবেন, আমরা তার নির্বাচনই করবো। আমরা নৌকা চিনি, ব্যক্তি নয়। প্রার্থী কাকে দিলেন, না দিলেন দেখার বিষয় নয়। নৌকা যাকে দেবেন আমরা তার পক্ষে নির্বাচন করবো। যেহেতু বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার সৈনিক।
আরও পড়ুন>> বিএসটিআইয়ের রিপোর্ট হাতে পেলে মাঠ পর্যায়ে যাবে ব্যালট বক্স
জাকির বলেন, এমপির বরাদ্দ আগে পাইনি, নায়ক ফারুক বা আবুল কালাম আজাদ দেননি। এখন আরাফাত সাহেব ডাকছিলেন, তালিকা নিয়েছেন। উনি দেবেন। উনি ১০ লাখ টাকা হয়তো প্রতি ওয়ার্ডে দেবেন। সব মসজিদ-মাদরাসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের লিস্ট নিয়েছেন, বরাদ্দ দেবেন। আমার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে আমি অনেক কাজ করেছি। আমি আশা করি, এখানে নৌকার জয় হবে।
ভোটকেন্দ্র পরিদর্শনে গিয়ে ধাওয়ার শিকার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলম, ফাইল ছবি
এলাকার সাংগঠনিক অবস্থা নিয়ে মোহাম্মদ আলী আরাফাত বলেন, আগের এমপি দীর্ঘদিন অসুস্থ ছিলেন। যার কারণে সাংগঠনিকভাবে এলাকাটি গোছানো নেই। এটা আমি করতে চেষ্টা করছি। আমি তো আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য। আমার কাজ হলো, এখানে নৌকার বিজয় নিশ্চিত করা। এজন্য কাজ করছি। নমিনেশন যেই পাক। সেটা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড- ১৫, ১৮, ১৯ ও ২০ এবং ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকা নিয়ে জাতীয় সংসদের ১৯০ নম্বর আসন। এখানে মোট ভোটার ৩ লাখ ১৩ হাজার ৯৯৮ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৬৮ হাজার আর নারী ভোটার ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৯৮।
অভিজাত আসন হলেও অভিজাত ভোটার কম। বেশিরভাগই নিম্ন ও মধ্যবিত্তের ভোটার। এদের ভোটকেন্দ্রে আনা ও সমর্থন আদায়ই সামনে নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ।
এসইউজে/এমএএইচ/এসএইচএস/জেআইএম