সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলে উৎপল কুমার ঘোষ। কলেজ খুলনায় শেষ করলেও অনার্স-মাস্টার্স করেন যশোর এমএম কলেজে। ভ্রমণ ভিসার জন্য ঢাকার আইভ্যাকে গিয়ে অপেক্ষা করছিলেন। এক সময় চোখ আটকে যায় একটি স্কলারশিপের বিজ্ঞপ্তিতে। পরে ওয়েবসাইট ঘাঁটাঘাঁটি করতে করতে করে ফেলেন আবেদন। এরপর ভার্চুয়াল ইন্টারভিউ এবং ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি হায়দ্রবাদে (আইআইটি হায়দ্রবাদ) ফেলোশিপের সুযোগ। সবকিছুই আচমকা হয়ে যায় উৎপলের।
Advertisement
আরও পড়ুন>> ভারত বায়োটেক/চিকুনগুনিয়া ও লাম্ফি ভাইরাসের টিকা অনুমোদন পর্যায়ে
এখন সস্ত্রীক থাকছেন প্রযুক্তি ইনস্টিটিউটটির দেওয়া দুই রুমের আবাসনে। মাসে পান ৬০ হাজার রুপি (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৭৫ হাজার)। প্রতি বছর গবেষণার কাজে পান আরও এক লাখ রুপি। এই ফেলোশিপ জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে উৎপলের।
জাগো নিউজের সঙ্গে আলাপকালে উৎপল বলেন, আমি এখানে পিএইচডিতে ফার্স্ট ফেলোশিপের আওতায় আছি। ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশন তাদের ওয়েবসাইটে আইআইটি হায়দ্রবাদে স্কলারশিপ নিয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। আমি জানার পর প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইটে ঢুকে আবেদন করি। পরে তাদের একটি ভার্চুয়াল ইন্টারভিউ বোর্ডে ইন্টারভিউ দেই। আমি সেখানে সিলেক্ট হই এবং চলে আসি।
Advertisement
আইআইটি হায়দ্রবাদের ক্যাম্পাস
‘ফার্স্ট ফেলোশিপের স্কিমটি চমৎকার। মাসিক ৬০ হাজার রুপির পাশাপাশি বিবাহিত হওয়ায় আমাকে দুই রুমের ফ্ল্যাটও দিয়েছে। ব্যাচেলররা হোস্টেলে থাকতে পারেন।’
বাংলাদেশিরা কেন আইআইটি হায়দ্রবাদে পড়তে যাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ল্যাবরেটরিগুলো সেভাবে সমৃদ্ধ না। ডক্টরেট শিক্ষকও কম। আমি এখানে এসেছি কেমেস্ট্রি নিয়ে গবেষণায়। একজন শিক্ষক যখন ভালো ল্যাবে গবেষণা করেন তখন তারা অনেক বেশি দক্ষ হয়ে ওঠেন। এখানকার সব শিক্ষকই পিএইচডি করা।
‘এখানে যখন একজন শিক্ষক নিয়োগ পান তখন তিনি জুনিয়র সায়েন্টিস্ট হিসেবে নিয়োগ পান। আমাদের দেশে সে ধরনের ল্যাবরেটরি বা রিসার্চ সুবিধা নেই। এখানে বিশ্বমানের ল্যাবরেটরিতে রিসার্চ করা যায়। আর বাংলাদেশের খুব কাছাকাছি হওয়ায় এখানে সব দিক থেকে সুবিধা পাওয়া যায়।’
Advertisement
বাংলাদেশের সঙ্গে কোলাবোরেশন চান উৎপল
বাংলাদেশের আইটি ইনস্টিটিউট ও সরকারকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে উৎপল বলেন, এখানে দেখেছি নেপালের একটি ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা ফাইনাল এয়ারে এখানে পড়তে আসছে। আমাদের কোনো প্রতিষ্ঠান যদি কোলাবোরেশন করে তাহলে থার্ড ইয়ার বা ফাইনাল ইয়ারে আন্ডারগ্রাজুয়েটেই তারা আসতে পারে। বিশেষ করে এখানকার হাই টেকনোলজির ল্যাবগুলো তারা ব্যবহার করতে পারবে। বাংলাদেশের বুয়েটেও যা নেই আমার জানা মতে।
মতবিনিময় সভায় বি এস মূর্তিসহ অন্যরা
আইইএলটিএস ছাড়াই স্কলারশিপ পেয়েছেন হাসানাত
কথা হচ্ছিল পাশে থাকা বাংলাদেশের আরেক মেধাবী ছাত্র চাঁদপুরের আবুল হাসানাতের সঙ্গে। তিনিই এখানকার প্রথম বাংলাদেশি ছাত্র। হাসানাত বলেন, আমি সুইজারল্যান্ড ও ভারতে স্কলারশিপের জন্য চেষ্টা করছিলাম। ভারতের দুটো প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পাই। জিআরই কিংবা আইএলটিএস ছাড়াই স্কলারশিপ হয়ে যায় আইআইটি হায়দ্রবাদে।
আরও পড়ুন>> সুষ্ঠু-গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মূলমন্ত্র ‘বিশ্বাস’
ইউরোপ, আমেরিকা বা কানাডা না গিয়ে কেন ভারতে- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার ইংরেজির দক্ষতা যা ছিল তা এখানকার জন্য যথেষ্ট। বাড়ির পাশে হওয়ায় সহজে অ্যাডজাস্ট করতে পারবো। এখানে আসার অন্যতম কারণ হলো রিসার্চ। আমার ছোটবেলা থেকে রিসার্চের শখ ছিল। এখানকার রিসার্চটা খুব ভালো।
এর আগে প্রায় ৬শ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত আইআইটি হায়দ্রবাদের ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখান এখানকার পাবলিক রিলেশন্স অফিসার মিতালি আগারওয়াল। তিনি আইআইটি হায়দ্রবাদের ভবন, এর ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন, বিশেষত্ব, বিভিন্ন ফ্যাকাল্টি সম্পর্কে সাম্যক ধারণা দেন। ভবনে প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহার, হিট প্রুফিং প্রযুক্তি টের পাওয়া গেলো কড়া রোদ থেকে ঢুকেই।
‘উদ্ভাবন ও উদ্ভাবন’, স্টার্স্টআপে পূর্ণ সহযোগিতা
পরে আইআইটি হায়দ্রবাদের পরিচালক বি এস মূর্তি ভারত সফররত বাংলাদেশি সাংবাদিক প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। তিনি একটি প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে প্রথমে আইটিআইটি হায়দ্রবাদ সম্পর্কে ধারণা দেন। এসময় তিনি বলেন, ফার্স্ট স্কিমের মাধ্যমে আমরা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের পূর্ণ অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ পিএইচডি করার সুযোগ দিচ্ছি। ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা টেকনোলজি সম্পর্কিত যে কোনো বিষয়ে ভালো ফলাফলসহ মাস্টার্স ডিগ্রি থাকলে তিনি আবেদন করতে পারবেন। টোটাল জিপিএ ১০ এর মধ্যে অন্তত ৮ থাকতে হবে।
আইআইটি হায়দ্রবাদের ক্যাম্পাসের একটি ভবন
২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউটটি এনআইআরএফ র্যাংকিংয়ে তৃতীয়, কিউএস র্যাংকিংয়ে ৭০০-র মধ্যে ও ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটগুলোর মধ্যে ১১তম বলেন জানান তিনি।
বিএস মূর্তি জানান, প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে শিক্ষার্থী আছে চার হাজারের বেশি। স্নাতক পর্যায়ে ১৭৬০, স্নাতকোত্তর ১২৮০ ও ডক্টরাল শিক্ষার্থী ১১৬০ জন। এখানে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, বায়োমেডিক্যাল, বায়োটেকনোলজি, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ক্লাইমেট চেঞ্জ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, কম্পিউটার সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং, মেটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড মেটালজিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, মেকানিক্যাল আন্ড অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং, ফিজিক্স, কেমেস্ট্রি, লিবারেল আর্টস, ডিজাইন, এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট ও হেরিটেজ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি পড়ানো হয়।
আরও পড়ুন>> ‘ভারত কোনো বিশেষ দলকে সমর্থন করে না, সম্পর্ক দেশের সঙ্গে হয়’
মূর্তি বলেন, বাংলাদেশি ছাত্রদের এখানে পিএইচডি, ফেলোশিপের মাধ্যমে, আইজিসিসিআর স্কলারপিশের মাধ্যমে এখানে আসতে পারে, ফার্স্ট ফেলোশিপের জন্য আসতে পারে। আমরা গবেষণা ও উদ্ভাবনে উৎসাহ পায় এমনভাবে পাঠ্যক্রম সাজিয়েছি। আমাদের ট্যাগ লাইন- উদ্ভাবন ও উদ্ভাবন।
তিনি বলেন, কোনো শিক্ষার্থী কানো সমস্যা সমাধানে আইডিয়া নিয়ে হাজির হলে সেটা বোর্ডে যায়। বোর্ড পাস করলে শুরুতেই এক লাখ রুপি বৃত্তি দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে সেই উদ্ভাবন যদি স্টার্টআপ পর্যায়ে যায় তাহলে এই ইনস্টিটিউটই তাকে কোম্পানি পর্যন্ত লিংক করে দেয়।
গত পাঁচ বছরে এমন স্টার্টআপ প্রায় ১২শ কোটি রুপি আয় করেছে বলেও জানান তিনি।
বি এস মূর্তি আরও বলেন, কোনো শিক্ষার্থী যে বিষয়েই পড়ুক না কেন তাকে বেসিক কোর্সের পাশাপাশি ক্রিয়েটিভ মানবিক শিল্পকলা পড়তে হয় ৪০ শতাংশ। ৬০ শতাংশ বেসিক কোর্স। এটি এখানকার অন্যতম বিষয়।
আইআইটি হায়দ্রবাদের একটি রিসার্চ ল্যাব
বাংলাদেশ চাইলে সুযোগ-সুবিধা বাড়াবে আইআইটি হায়দ্রাবাদ
প্রতিষ্ঠানটির ডিন (ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্স) প্রফেসর তরুণ কান্তি পান্ডা বলেন, আমরা চাই বেশি বেশি বাংলাদেশি এখানে আসুক। কিন্তু বাংলাদেশের কোনো ইনস্টিটিউটের সঙ্গে আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ নেই। এখন যতটুকু যোগাযোগ আছে তা ছাত্র, গবেষক পর্যায়ে।
এসময় বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা জানি, কিন্তু তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ হয়নি। কোনো প্রতিষ্ঠান যোগাযোগ করলে অবশ্যই আমরা সযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবো এবং সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে চিন্তা করতে পারবো।
সবশেষে প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্পন্ন ল্যাব ঘুরিয়ে দেখানো হয়। এই মুহূর্তে স্কলারশিপের জন্য বিজ্ঞপ্তি আছে। চাইলে আগ্রহীরা আবেদন করতে পারবেন।
এএসএ/জেআইএম