মতামত

আর কত জীবন এবং সম্পদের বিনাশ?

বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে রাস্তাগুলো জীবন এবং যানজটে ভরপুর, যেখানে নাগরিকদের প্রতিদিনের ব্যস্ততা অগ্রগতি এবং উন্নয়নের প্রতীক, সেখানে রাস্তায় চলাচলকারী নাগরিকদের জীবনে প্রায়ই একটি কালো ছায়া নেমে আসে আর তাহলো-সড়ক দুর্ঘটনা। সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টি শুধু জাতীয় উদ্বেগের বিষয় নয়, এটি এখন মানবাধিকারেরও বিষয়। সড়ক দুর্ঘটনা বাংলাদেশকে বছরের পর বছর ধরে জর্জরিত করেছে, অগণিত প্রাণ কেড়ে নিয়েছে এবং অপরিমেয় দুর্ভোগের কারণ হয়েছে।

Advertisement

বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান ভয়াবহ। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় ৮ হাজার মানুষ মারা যায়। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, সড়কে প্রতিদিন ৬৪ জনের মৃত্যু হয়। এই তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ হাজার ৩৬০ জন মারা যায়। আহত হয় প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ। প্রতি বছর প্রায় ৮০ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হয়। তাদের মধ্যে ১২ হাজারেরও বেশি ১৭ বছরের কম বয়সী শিশু। এ হিসাবে প্রতিদিন গড়ে ২২০ জন প্রতিবন্ধী হয় শুধু সড়ক দুর্ঘটনায়।

অন্যদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, সারা বিশ্বে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩ লাখ মানুষ মারা যায়। বাংলাদেশে মারা যায় আনুমানিক ২৪ হাজার ৯৫৪ জন। সংস্থাটির মতে, আক্রান্তদের মধ্যে ৬৭ শতাংশের বয়স ১৫ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। এক্ষেত্রে ১৫ থেকে ৪৯ বছর বয়সী মানুষের মৃত্যুর ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। সংস্থাটির দাবি, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় জিডিপির ক্ষতি হচ্ছে ৫ দশমিক ৩ শতাংশ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটে। যারা মারা যায় বা পঙ্গু হয় তারা নিছক সংখ্যা নয়; তারা কারও পরিবারের প্রিয় সদস্য, বন্ধুবান্ধব এবং সর্বোপরি বাংলাদেশের একজন নাগরিক; যারা এমন একটি শূন্যতা রেখে যায় যা কখনও পূরণ করা যায় না।

Advertisement

প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনা একটি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ট্র্যাজেডির সৃষ্টি করে। অনেক পরিবার হারায় তার একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে, সন্তানরা হারায় বাবা-মাকে, আর জাতি হারায় তার ভবিষ্যৎ নেতাদের। সড়ক দুর্ঘটনায় আহত ব্যক্তিদের ব্যথা এবং ট্রমা হলো এমন দাগ যা পুরোপুরি নিরাময় নাও হতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনা অক্ষমতা, মনস্তাত্ত্বিক ট্রমা এবং অর্থনৈতিক দুর্ভোগের চক্রকে আরও স্থায়ী করে।

যদিও এ দুর্ঘটনাগুলো ব্যক্তি এবং পরিবারকে প্রভাবিত করে, তারা দেশের অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করে। উৎপাদনশীল জীবন হারানো এবং চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের সঙ্গে যুক্ত খরচ দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে।

অতিরিক্ত গতি এবং অ্যালকোহল বা মাদকের প্রভাবে গাড়ি চালানোসহ নানাবিধ কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রাফিক নিয়মকানুন না মানার প্রবণতা একটি উল্লেখযোগ্য উদ্বেগের বিষয়। রাস্তার ত্রুটিপূর্ণ নকশা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং অবকাঠামো দুর্ঘটনায় অবদান রাখে। ভাঙাচোরা রাস্তা, গর্ত, সঠিক চিহ্নের অভাব এবং চালকের বেপরোয়া মনোভাব গুরুতর বিপদ ডেকে আনে। ত্রুটিপূর্ণ ব্রেক, টায়ার এবং আলোসহ দুর্বল যান্ত্রিক ব্যবস্থাও যানবাহন দুর্ঘটনা ঘটায়।

গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনের ব্যবহার এবং অন্যান্য বিভ্রান্তি একটি ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ। এটি রাস্তা থেকে চালকের মনোযোগ সরিয়ে দেয়, ফলে দুর্ঘটনা ঘটে। পথচারীরা বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ। নির্দিষ্ট ক্রসওয়াকের অভাব এবং পথচারীদের বেপরোয়া আচরণ দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।

Advertisement

প্রতিকূল আবহাওয়া, যেমন ভারী বৃষ্টি এবং কুয়াশা দুর্ঘটনায় অবদান রাখে। চালকরা প্রায়ই তাদের গতি এবং আচরণ সেই অনুযায়ী সামঞ্জস্য করতে ব্যর্থ হয়। অপর্যাপ্ত চালক প্রশিক্ষণ এবং সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থা সম্পর্কে জনসচেতনতার অভাব দুর্ঘটনা ঘটায়।

বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে একাধিক উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করা করা হয়েছে। যদিও এই উদ্যোগগুলো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের প্রতিনিধিত্ব করে তবে চ্যালেঞ্জের মাত্রা অপরিসীম। সড়ক দুর্ঘটনার স্থায়িত্ব ইঙ্গিত করে যে আরও ব্যাপক ব্যবস্থার প্রয়োজন।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধে শিক্ষা ও সচেতনতা মৌলিক। গণ প্রচারাভিযান এবং স্কুলভিত্তিক প্রোগ্রামগুলো অল্প বয়স থেকেই সড়ক নিরাপত্তার অভ্যাস গড়ে তোলার দিকে মনোনিবেশ করা উচিত। শিক্ষা কেবল চালককেই নয়, পথচারীদেরও সচেতন করতে হবে।

চালকদের দায়িত্বশীল আচরণ সম্পর্কে প্রচার করা অপরিহার্য। এর মধ্যে ওভারস্পিডিং, মাদকের প্রভাবে গাড়ি না চালানো এবং গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোন ব্যবহার করার বিপদ সম্পর্কে সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। রাস্তায় প্রতিরক্ষামূলক ড্রাইভিং কৌশল এবং ধৈর্য উৎাহিত করা দুর্ঘটনা রোধে অবদান রাখতে পারে।

প্রযুক্তিগত সমাধানগুলো অন্তর্ভুক্ত করা উল্লেখযোগ্যভাবে সড়ক নিরাপত্তা বাড়াতে পারে। ট্রাফিক নিরীক্ষণ এবং লঙ্ঘন শনাক্ত করতে, বেপরোয়া ড্রাইভিং প্রতিরোধে নজরদারি ক্যামেরা ব্যবহার আইন প্রয়োগকারীকে সহায়তা করতে পারে।

সড়ক নিরাপত্তায় বাংলাদেশের অঙ্গীকার শুধু নীতির বিষয় নয়; এটি তার নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য জাতির সহানুভূতি এবং দায়িত্বের প্রতিফলন। আর কতদিন সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হতে হবে এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের মিলিত প্রচেষ্টা, শিক্ষা, সচেতনতা, প্রযুক্তি এবং অবকাঠামোগত উন্নতির মাধ্যমে পাওয়া যেতে পারে।

উন্নত নেভিগেশন সিস্টেম রিয়েল-টাইম ট্রাফিক আপডেট প্রদান করতে পারে, ড্রাইভারদের নিরাপদ রুট পরিকল্পনা করতে এবং যানজট এড়াতে সাহায্য করে। অ্যান্টিলক ব্রেকিং সিস্টেম (ABS), ইলেকট্রনিক স্ট্যাবিলিটি কন্ট্রোল (ESC) এবং সংঘর্ষ-এড়িয়ে চলা সিস্টেমের মতো নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যে সজ্জিত যানবাহন ব্যবহারকে উৎসাহিত করা। দক্ষ জরুরি প্রতিক্রিয়া সিস্টেমের বিকাশ দুর্ঘটনা কমাতে পারে, সম্ভাব্য জীবন বাঁচাতে পারে।

সড়ক অবকাঠামোতে বিনিয়োগ দুর্ঘটনা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। নিয়মিত রাস্তার রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গর্তগুলো ঠিক করা, ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো মেরামত এবং রাস্তার অবস্থার উন্নতি করা। চালকদের গাইড করতে এবং সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য পরিষ্কার এবং কার্যকর রাস্তার চিহ্ন স্থাপন করা। পথচারীবান্ধব অবকাঠামো উন্নয়ন করা, যেমন ফুটপাত, পথচারী ক্রসিং এবং পথচারী সেতু। সাইকেল চালানোর প্রচার এবং ডেডিকেটেড সাইকেল লেন তৈরি করা রাস্তার যানজট এবং দুর্ঘটনা কমাতে পারে।

সড়ক নিরাপত্তা শুধু একটি জাতীয় সমস্যা নয়; এটি একটি বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ। জাতিসংঘ নিরাপদ সড়কের জন্য ২০১১-২০২০ সময়কালকে কর্মের দশক ঘোষণা করেছিল এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (SDGs) অংশ হিসেবে সড়ক নিরাপত্তার লক্ষ্যমাত্রা স্থাপন করেছিল। যার লক্ষ্য ছিল বিশ্বব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু এবং আহতের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনা।

জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনযোগ্য লক্ষ্যগুলো হলো সবার জন্য নিরাপদ, সাশ্রয়ী এবং টেকসই পরিবহন ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা এবং সড়ক নিরাপত্তার উন্নতি করা, বিশেষ করে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের সম্প্রসারণের মাধ্যমে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী এবং বয়স্ক ব্যক্তিদের এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর চাহিদার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিয়ে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

এই বৈশ্বিক উদ্যোগের স্বাক্ষরকারী হিসেবে বাংলাদেশকে অবশ্যই এই লক্ষ্যগুলোর জন্য আরও কাজ করতে হবে। দুর্ঘটনা রোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি এবং সর্বোত্তম অনুশীলন প্রদান করতে পারে।

সড়ক দুর্ঘটনা মোকাবিলা শুধু নীতি বা অর্থনীতির বিষয় নয়; এটি একটি মানবিক বাধ্যতামূলক কাজ। রাস্তায় হারিয়ে যাওয়া প্রতিটি জীবন একটি ট্রাজেডির প্রতিনিধিত্ব করে যা প্রতিরোধ করা সম্ভব। উন্নয়ন ও অগ্রগতির অন্বেষণে প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা ও মঙ্গলকে অবশ্যই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

যেহেতু বাংলাদেশ ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস পালন করে, সুতরাং এদিনটি শুধু হারিয়ে যাওয়া জীবন নয়, যে জীবনগুলো এখনও বাঁচানো যেতে পারে তার প্রতিফলনের একটি মুহূর্ত হিসাবে কাজ করা উচিত। এটি সড়ক নিরাপত্তার প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্নবীকরণ করার এবং নিজেদের প্রশ্ন করার একটি সুযোগ- আর কতদিন আমাদের সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হতে হবে?

জাতির সম্মিলিত ইচ্ছার মধ্যেই রয়েছে্ এ প্রশ্নের উত্তর। সড়ক দুর্ঘটনা অনিবার্য নয়; তারা প্রতিরোধযোগ্য। এটির জন্য সরকারি কর্তৃপক্ষ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নাগরিক সমাজসহ প্রত্যেক নাগরিককে জড়িত করে একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন। এটি মানুষের জীবন ও নিরাপত্তার মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকার থেকে প্রয়োজন।

জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস নিছক একটি অনুষ্ঠান নয় বরং কর্মের অনুঘটক হওয়া উচিত। এটি সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাস এবং নাগরিকদের জীবন রক্ষার প্রচেষ্টাকে পুনরুজ্জীবিত করার একটি উপলক্ষ হওয়া উচিত। এটি সড়ক দুর্ঘটনা রোধে সম্মিলিত কর্মের জন্য একটি আহ্বান এবং এই কর্ম আমাদের প্রত্যেকেই শুরু করতে হবে।

নিরাপদ সড়কের যাত্রাটি সহজ নয়, তবে শুরু করা অতীব জরুরি। জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস একটি মুহূর্ত যা সড়ক দুর্ঘটনার কারণে হারিয়ে যাওয়া জীবন এবং যন্ত্রণার প্রতিফলন ঘটায়। এটি সামনের দিকে তাকানোর এবং এমন একটি জাতিকে কল্পনা করার একটি উপলক্ষ যেখানে প্রতিটি সড়ক ও রাস্তা নিরাপদ এবং প্রতিটি যাত্রা নির্ভয়।

সড়ক নিরাপত্তায় বাংলাদেশের অঙ্গীকার শুধু নীতির বিষয় নয়; এটি তার নাগরিকদের রক্ষা করার জন্য জাতির সহানুভূতি এবং দায়িত্বের প্রতিফলন। আর কতদিন সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হতে হবে এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের মিলিত প্রচেষ্টা, শিক্ষা, সচেতনতা, প্রযুক্তি এবং অবকাঠামোগত উন্নতির মাধ্যমে পাওয়া যেতে পারে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

এইচআর/ফারুক/জেআইএম