গাজীপুর সিটি করপোরেশনের অধীন একটি বিল বালু দিয়ে ভরাট করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলা হচ্ছে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ‘আলেম ওলামা ও দ্বীনদার প্রপার্টি’ নামে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিলের প্রায় ৮-১০ ফুট পানির নিচে থাকা ২৫ একর জমিতে বালু ভরাট করার জন্য প্রায় দুই কিলোমিটার দূর থেকে বসানো হয়েছে লোহার পাইপ।
Advertisement
বিলটি সিটি করপোরেশনের ১৩ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের ইটাহাটা, কামার বাসুলিয়া ও মজলিশপুর এলাকায় অবস্থিত। সাধারণ মানুষ, কৃষক, জেলেসহ স্থানীয়রা গত দুই বছর ধরে কৃষিজমি ভরাটের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে আসছেন। তারপরও স্থানীয়দের বাঁধা উপেক্ষা করে মাটি ভরাটের কাজ শুরু করেছেন আলেম ওলামা ও দ্বীনদার প্রপার্টির লোকজন।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক, পুলিশ কমিশনার, সিটি করপোরেশন, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ বরাবর আবেদন করেও কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন।
ইটাহাটার মজলিশপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, ওই এলাকার স্থানীয় মরহুম আব্দুল মজিদ প্রফেসরের বাড়ির সামনের সড়ক থেকে প্রশস্ত একটি কাঁচা রাস্তা পশ্চিম দিকে খৈলাদী বিলের মাঝ বরাবর কয়েকশ গজ দূরে গিয়ে শেষ হয়েছে। ওই রাস্তার প্রবেশ পথে ‘আলেম উলামা ও দ্বীনদার প্রপার্টি (এডিপি)’ নামে একটি বিশাল ভিত্তিপ্রস্তর (নামফলক) স্থাপন রয়েছে। এতে প্রপার্টির দলিল হস্তান্তর ও রাস্তা উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে কাউন্সিলর মো. খোরশেদ আলম সরকারের নাম লেখা রয়েছে।
Advertisement
কথা হয় ওই গ্রামের কৃষক ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, ‘আলেম উলামা ও দ্বীনদার প্রপার্টি (এডিপি)’ সমিতির নামে ইটাহাট ও মজলিশপুর এলাকায় কিছু জমি কেনেন কয়েকশ সদস্য। ওই সমিতির চেয়ারম্যান ছিলেন হেফাজতে ইসলামের তৎকালীন নেতা মরহুম মাওলানা ফজলুল হক আমিনী। তার মৃত্যুর পর মাওলানা ফয়জুল্লাহকে চেয়ারম্যান করা হয়। স্থানীয়ভাবে এ প্রপার্টির দেখাশোনা করেন তৈয়ব হাজী এবং মাসুদ রানা।
কৃষক ফরহাদ হোসেন আরও বলেন, খৈলাদী বিলের পাড়ে তার বসতবাড়ি। বাড়ির চারপাশে হিন্দু সম্প্রদায়। স্থানীয়রা হেফাজতের ওই প্রপার্টির লোকজনের কাছে জমি বিক্রি করে দেন। তাকেও বাড়িসহ জমি বিক্রির জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু তিনি রাজি না হওয়ায় তারা বাড়ির চারপাশের মাটি কেটে বিশাল গর্ত করেন এবং যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দেন।
ফরহাদ হোসেনের অভিযোগ, তার বাড়ির চারপাশে গভীর গর্ত করায় পাড়ের মাটি ভেঙে পড়ছে। তিনি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঝুঁকিতে আছেন।
স্থানীয় সাইফুল ইসলাম মোল্লা বলেন, খৈলাদী বিলে ৫-৬টি সেচ পাম্প বসিয়ে স্থানীয়রা ধানচাষ করেন। সম্প্রতি ঢাকা লালবাগের শাহি মসজিদ এলাকার কিছু ব্যক্তি কম দামে বিলের নিচু জমি কেনেন। জমি কেনার সময় তারা বলেছিলেন, ওই জমিতে মাছচাষ ও কৃষিকাজ করা হবে। কিন্তু এখন প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে তুরাগ নদীর কড্ডা থেকে লোহার পাইপ বসিয়ে বালু ফেলার উদ্যোগ নিচ্ছে।
Advertisement
৭২ বছর বয়সী বৃদ্ধ শুক্কুর আলী বলেন, ‘বিল ভরাট বন্ধের দাবিতে আমরা জেলা প্রশাসক, সিটি করপোরেশন, গাজীপুর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ পুলিশ কমিশনার বরাবর আবেদন করেছেন। কিন্তু আমরা বিভিন্নভাবে খবর পাচ্ছি তারা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে বিল ভরাটের প্রস্তুতি নিচ্ছে। খুব দ্রুত তারা বালু ভরাট কার্যক্রম শুরু করবে বলে শুনেছি।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্থানীয়দের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতবছর ১২ জুন বাসন ইউনিয়ন ভূমি অফিসের ভূমি সহকারী কর্মকর্তা বেগম শেফালী আক্তার সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। তিনি সেখানে বিলের পানিতে দুই কিলোমিটারজুড়ে পাইপ বসিয়ে বিলে বালু ভরাট করার বিষয়টি দেখতে পান। পরে এ বিষয়ে গাজীপুর সদর সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর প্রতিবেদন জমা দেন। পরবর্তী সময়ে গত ২৮ আগস্ট সহকারী কমিশনার (ভূমি) রাফে মোহাম্মদ ছড়া বালুভরাটের মাধ্যমে জমির শ্রেণি পরিবর্তনের জন্য গৃহীত কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য আলেম ওলামা দ্বীনদার প্রপার্টিজকে নির্দেশ দেন।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০ অনুসারে কোনো জমির শ্রেণি পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কালেক্টরেটের পূর্বানুমোদন প্রয়োজন। এছাড়া মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সব পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ এর ৫ নম্বর ধারায় প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গায় শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না মর্মে উল্লেখ রয়েছে।
শুধু তাই নয়, পরিবেশ অধিদপ্তর গাজীপুর জেলা কার্যালয় থেকে আলেম উলামা ও দ্বীনদার প্রপার্টিকে প্রদত্ত ছাড়পত্রে কোনো অবস্থাতেই কোনোধরনের জলাশয়, খাল, বিল, পুকুর ভরাট করা যাবে না বলে উল্লেখ রয়েছে।
এ বিষয়ে জলাশয় ভরাট কাজের তদারককারী ও আলেম ওলামা ও দ্বীনদার প্রপার্টির পরিচালক মুফতি হাজি তৈয়ব হোসেন বলেন, ‘লালবাগ মাদরাসার হুজুর হাফেজ মুসা সাহেবসহ আমরা সাড়ে ৪০০ আলেম ওলামা ২০০০ সালে বছরে পাঁচ হাজার টাকা করে জমাই। পরে ২০০৯ সালে সবার নামে গাজীপুর সিটির ১৩ ও ২০ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন দাগ খতিয়ানে মোট ২৫ একর জমি কেনা হয়।
তিনি বলেন, আমরা ডিসি, এসিল্যান্ড, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট অফিসের অনুমতি নিয়ে এবং কথা বলে বালু ভরাটের কাজ শুরু করেছি। জমির বৈধ কাগজপত্র ও বিভিন্ন দপ্তরের অনুমতির কাগজ তাদের অপর সদস্য মাসুদ রানার কাছে জমা আছে।
জানতে চাইলে মাসুদ রানা বলেন, সহকারী কমিশনার (ভূমি), গাজীপুর জেলা প্রশাসকের রাজস্ব শাখার রেভিনিউ ডেপুটি কালেক্টর এবং পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র নিয়ে কড্ডা প্রজেক্টে জমি ভরাটের কাজ শুরু করা হয়েছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক আবুল ফাতে মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় ভরাট এবং জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে কোনো কাজ করা আইনসম্মত নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এসআর/জেআইএম