পলাশীর যুদ্ধ ১৭৫৭ সাল। নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পনির শাসন জেঁকে বসে কোলকাতায়। এ সময় অনেক জমিদারই ইস্ট ইন্ডিয়ার সাথে নানা ব্যবসা-বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়ে এবং তারা সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। ফলে সমাজে হিন্দু জমিদারদের অনেকেরই প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। এছাড়া সমাজের এক শ্রেণির মানুষ ইংরেজদের সাথে বিভিন্ন রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রভূত ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে ওঠে।
Advertisement
ইংরেজদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে এবং নিজেদের বিত্তবৈভব প্রদর্শনের জন্য এসব ধনিক শ্রেনির ব্যবসায়ীদের কাছে দুর্গা পূজা হয়ে ওঠে প্রধান ধর্মীয় উৎসব। সমাজে ধনীর সংখ্যা যত বাড়তে থাকে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে দুর্গা পূজার সংখ্যা। এই পূজাকে ঘিরে অর্থ খরচ করে নিজেদের শো-আপ করার এক অশুভ প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
পূজায় ইংরেজদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। তাদের আপ্যায়নের নামে থাকতো বিলাস-বহুল এলাহি ব্যবস্থা। কোথাও কোথাও নাচ গানের জন্য বাঈজীদের আনা হতো। থাকতো খাবার-দাবারের বিশেষ ব্যবস্থা। ইংরেজদের আসর মানে পানীয় উপকরণ থাকবে না তা কি করে হয়। এ সবকিছু আয়োজন হতো মূলত ইংরেজদের খুশি করার জন্য।
পূজা উপলক্ষ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তা জে জেড হোলওয়েল ১৭৬৬ সালে লিখেছিলেন, “পূজায় সাধারণত কোম্পানির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে সকল ইউরোপীয়দের আমন্ত্রণ জানানো হতো। অভ্যাগতদেরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হতো। তাদের জন্য ফলসহ বিপুল খাবার দাবারের ব্যবস্থা থাকতো। প্রতি সন্ধ্যায় আগত অতিথিদের বিনোদনের জন্য বাঈজী নাচ ও গানের জলসার আয়োজন করা হতো।’
Advertisement
দুঃখের বিষয়, জমিদারদের এই জমকালো দুর্গা পূজায় সাধারণ জনগণের প্রবেশাধিকার ছিল না। তবে ব্যতিক্রম ছিলেন রানী রাসমনি। তিনি দুর্গা পূজায় ইংরেজদের নিমন্ত্রণ না জানিয়ে বরং সাধারণ প্রজাদের অংশগ্রহণে আয়োজন করতেন যাত্রাপালা, কবিয়াল গানের আসর।
সময়ের বিবর্তনে সমাজের বিত্তশালী জামিদারদের প্রতিপত্তি ধীরে ধীরে ফিকে হতে থাকে। ১৭৯০ সালে ভারতের পশ্চিমবাংলার হুগলি জেলার বলাগড় থানার গুপ্তিপাড়া এক পূজা অর্থাভাবে বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তখন পাড়ার বারোজন বন্ধু মিলে সেই দুর্গা পূজা নতুন ভাবে আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়। উর্দুতে বন্ধুকে ইয়ার বলা হয়। তাই এ পূজার নাম দেয়া হয় বারোইয়ারী অর্থাৎ বারোয়ারী। এই পূজার মাধ্যমে ধনী জমিদারদের অন্দরমহল ছেড়ে সর্বপ্রথম দুর্গা পূজা আমজনতার অংশগ্রহণে উৎসব হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
১৮’শতকের শেষের দিকে বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ধনাঢ্য বাড়ির পূজার সংখ্যাও নেহাত কম ছিল না। তবে ঊনিশশতকের শুরুর দিকে বাংলায় হিন্দু সমাজে নব জাগরণ ঘটতে থাকে। এসময় রাজা রামমোহন রায়, দ্বারকানাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মতো প্রথিতযশা ব্যক্তিদের হাত ধরে বাংলায় নানা সামাজিক আন্দোলন গড়ে ওঠে। চারিদিকে সমাজ সংস্করণের ঢেউ লেগে যায়। অনেক যুবক ইংরেজি ও পাশ্চাত্য ধারায় শিক্ষিত হয়ে সমাজের নানা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে।
তৎকালীন দক্ষিণ কোলকাতার ভবানীপুর অঞ্চলে আদিগঙ্গার তীরবর্তী বলরাম বসু ঘাট এলাকার কতিপয় যুবক ও ব্যবসায়ী মিলিত হয়ে ‘ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভা’ প্রতিষ্ঠা করেন। এই সমিতির উদ্যোগে এলাকার সাধারণ জনগণের কাছ থেকে চাঁদা তুলে ১৯১০ সালে সর্বপ্রথম সর্বজনীন দুর্গা পূজা শুরু করে।
Advertisement
দিনবদলের আরো একটি নতুন ধারায় শুরু হয়েছে থিম পূজা। বর্তমানে দুর্গা পূজা আর প্রর্থনা বা আরাধনার স্থানে নেই। সেটি এখন শো-অফে পরিণত হয়েছে। কে কোন থিমে পূজার প্যান্ডেল করছে। কে কিভাবে দুর্গাকে উপস্থাপন করছে। এসব দেখতেই মানুষ সারা বাংলাজুড়ে ভিড় করছে। বর্তমানে কোলকাতার আদলে বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে পূজার নামে অর্থ নষ্টের প্রতিযোগিতা। প্রতিবছর দুর্গা পূজায় কোটি কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে। বানানো হচ্ছে ভিন্ন আঙ্গিকে পূজা প্যান্ডেল। তার মধ্যে সাজানো হচ্ছে থিম অনুযায়ী মূর্তি, ইতিহাস, ঐতিহ্য, স্থাপনা নিদর্শন।
মানুষ দূর দূরান্ত থেকে আসছে পূজা দেখতে। আপনজনদের নিয়ে আনন্দ-আড্ডায় মেতে থেকে আবার ফেরত যাচ্ছে নিজগৃহে। ষষ্ঠী থেকে শুরু করে দশমীর মধ্যে শেষ হচ্ছে শারদীয় দুর্গা পূজা। বিসর্জনের করুণ সুর বাজিয়ে প্রতিমা বিদায় করা হচ্ছে। সাথে প্যান্ডেল, লাইট, সাজ-সজ্জাসহ সকল কিছুই নষ্ট করা হচ্ছে। প্রয়োজনের অধিক মাটির মূর্তি বানানো হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে প্যান্ডেল। এসব বিসর্জনের জন্য বেছে নেয়া হচ্ছে নদী-নালা-পুকুর। সাজ-সজ্জার অনেক কিছুই আবর্জনায় পরিণত হচ্ছে। মাটির প্রতিমাগুলো চলে যাচ্ছে জলে। আর আবর্জনা চলে যাচ্ছে ভাগাড়ে। কোটি টাকার সম্পদ ক্ষণিকের আনন্দ দিলেও শেষ পর্যন্ত নিরানন্দই দিচ্ছে বেশি। প্রতিবছর নদীতে প্রতিমা বিসর্জনের মাধ্যমে নদী ভরাট হচ্ছে। বিভিন্ন ক্যামিক্যাল মিশ্রিত রং নদীর জল দূষিত করছে। সেই জল যখন জমিতে যাচ্ছে তখন জমি তার উর্বরতা হারাচ্ছে।
আমি পূজার বিরোধিতা করছি না। আমার অবস্থান পূজায় খরচের আধিক্য। অর্থাৎ অপব্যয় এর বিরুদ্ধে আমার অবস্থান। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কোনো পূজা বা পার্বণে কখনো সার্বিক খুশি বা খুশি ভাগ করার কথা বলা হয়নি। সকল মন্দিরে দান গ্রহণ করা হয়। কখনো দান করার কথা শোনা যায় না। প্রতিবছর এত টাকা নষ্ট করে দুর্গোৎসব করা হয়, অথচ কখনো কোনো পূজার সময় শোনা যায় না তারা গরীবদের দান করেছে।
হালে কিছু পূজায় দান করার কথা শোনা যায় বা টিভি নিউজে দেখা যায়। তবে সেটা পূজা কমিটির পক্ষ থেকে নয়। পূজা পরিদর্শনে কোনো মন্ত্রী বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার উপস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে দান করা হয়। শুধু দান নয়, এমনকি প্রসাদ পর্যন্ত দেয়া হয় না সকলের মাঝে। পূজা প্যান্ডেলে প্রতিদিন থেকে রাত প্রচুর দর্শনার্থী উপস্থিত হয়। তাদের কয়জন দর্শনার্থী পূজা দেখতে গিয়ে প্রসাদ পায়? এমনকি পূজায় অংশগ্রহণ বা অঞ্জলী দিতে যারা যায় তাদের আপ্যায়নের ব্যবস্থাও থাকে না। থাকে না নিচু জাতের মানুষদের মন্দির স্পর্শ করার অধিকার।
সমাজের যেসকল বিত্তশালী হিন্দু ব্যক্তিবর্গ যারা প্রতিবছর পূজার নামে অর্থ নষ্ট করছেন, তারা কি কখনো সমাজের অসহায় মানুষদের অর্থ সাহায্য করেছেন? অস্বচ্ছল মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ার জন্য কখনো স্কলারশিপ দিয়েছেন। নিম্ম আয়ের মানুষের চিকিৎসার জন্য কখনো অর্থ সাহায্য করেছেন? অথচ পূজার নামে কোটি কোটি টাকা প্রতিবছর নষ্ট করছেন। কি প্রয়োজন এই লোক দেখানো পূজা করার? শাস্ত্রে এত আলোকসজ্জা, জাঁকজমক, ভোজন, জলসা করার কথা নেই। অথচ সেই সবই করা হচ্ছে। বাংলাদেশের হিন্দুরা দুর্গা পূজায় শাস্ত্র মানে না, অথচ নারী সম্পত্তি অধিকারে শাস্ত্রের বাইরে যেতে পারেন না।
ঘটা করে দুর্গা পূজা প্রচলন হয়েছিল বাণিজ্যিক স্বার্থে। বিত্তশালী পরিমন্ডল ছেড়ে সাধারণের নাগালে আসলেও দুর্গা পূজা এখনো সর্বজনীন হতে পারেনি। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ তখনই সার্থক হবে যখন আপনার পাশের মানুষটিও আপনার খুশিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে। হালে পূজার খুশিতে আত্মীয়-স্বজনদের নতুন কাপড় উপহার দেয়ার প্রচলন হয়েছে। তবে সেই সব আত্মীয়কেই উপহার দেয়া হয়, যারা তাদের আবার উপহার দিতে পারবে। প্রতিটি পরিবারেই অসচ্ছল আত্মীয়-স্বজন থাকে। তাদের কেউ খোঁজ রাখে না। এমনকি তাদের বাড়িতে পূজা উপলক্ষ্যে কোনো উপহারও যায় না। এটাই বর্তমান সময়ের দুর্গা উৎসব।
পূজায় অতিরিক্ত খরচ না করে, একটি ফান্ড তৈরি করা যেতে পারে। যা সমাজের অসচ্ছল মানুষদের সাহায্যে দান করতে পারে। পূজায় যদি আপনি এক কোটি খরচ করতে পারেন, তাহলে একটি মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর পড়ার দায়িত্ব নিতে পারবেন না কেন? একটি অসহায় পরিবারের আয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন না কেন? একজন অসহায় মানুষের চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে পারবেন না কেন?
বাংলাদেশে অনেক ধনী হিন্দু ব্যক্তি আছে সেটা টের পাওয়া যায় দুর্গা পূজা আসলে। কখনো কোনো পেপার পত্রিকায় দেখেছেন বা শুনেছেন, তারা অসহায় পরিবার, ছাত্র-ছাত্রী বা চিকিৎসার দায়িত্বে এগিয়ে এসেছেন? না এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই। টাকা খরচ করে মাটি কিনে নদীর নাব্য নষ্ট করবেন না। জমির উর্বরতা নষ্ট করবেন না। বরং সমাজের একজন অসহায় যে আপনার কমিউনিটির বা পাশের বাড়ি বাস করে তার প্রয়োজনে এগিয়ে আসুন। দুর্গা, মাটির প্রতিমার মধ্যে থাকে না। মাটির দুর্গা কথা বলতে পারে না। সমাজে যে দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ আছে তাদের সেবা করেন। তারা ঈশ্বরের তৈরি, তারা আপনার মঙ্গল কামনায় ঈশ্বরের কাছেই প্রার্থনা করবে।
লেখক: সাংবাদিক, সাহিত্যিক, নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক।
এইচআর/এএসএম