প্রাথমিকভাবে খাদ্যের জোগান আসে কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যসম্পদ থেকে। এ দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় এ তিনটি উৎসের ভূমিকা অপরিসীম। দৃশ্যমান ফসল, ফল, শাক-সবজি, প্রাণী ও মৎস্যের উৎপাদন বেড়েছে বহুগুণ। নানা প্রতিকূলতার মাঝে এবং বিগত বছরগুলোতে গবেষণায় উদ্ভাবিত নতুন নতুন উন্নত জাত ও উৎপাদন পদ্ধতির প্রযুক্তিগুলো কৃষক বা খামারিদের মাঝে পৌঁছে দেওয়ার ফলে। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার মাত্রা প্রশংসনীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষির সব শাখা (কৃষি, প্রাণিসম্পদ ও মৎস্যসম্পদ) উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে স্বীকৃতি পেয়েছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ২য়, ধান, সবজি ও পেঁয়াজ উৎপাদনে ৩য়, আম ও আলু উৎপাদনে ৭ম, পেয়ারা উৎপাদনে ৮ম আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে বর্তমানে দশম। এছাড়া অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে মাছ উৎপাদনে ৩য়, ইলিশ উৎপাদনে ১ম, ছাগলের দুধ উৎপাদনে বিশ্বে ২য়, ছাগলের সংখ্যা ও মাংস উৎপাদনে ৪র্থ, গবাদিপশু উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে ১২তম।
Advertisement
খাদ্যে বিপত্তিখাদ্যের নিরাপত্তা হলো এক বা একাধিক বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ, যা ভোক্তার স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য খাদ্যকে খাদ্যের বিভিন্ন বিপত্তি থেকে রক্ষা করে। খাদ্যকে দূষিত করতে পারে কিংবা রোগ সৃষ্টি করতে পারে তথা মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক খাদ্যস্থিত যে কোনো কিছুকে খাদ্য বিপত্তি বলা হয়। যেমন- ভৌত খাদ্য বিপত্তি, জৈবিক খাদ্য বিপত্তি, রাসায়নিক খাদ্য বিপত্তি এবং এলার্জি সৃষ্টিকারী খাদ্য বিপত্তি। খাদ্য বিপত্তি নিরসনকল্পে প্রতিকারমূলক নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি প্রতিরোধমূলক নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে খাদ্য সংশ্লিষ্ট বিপত্তি নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে খাদ্য উৎপাদনকারী থেকে শুরু করে খাদ্য পরিবহন, সংরক্ষণ, বিতরণ, বিপণন এবং খাদ্য ব্যবসার সঙ্গে জড়িত খাদ্যকর্মীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্যমানুষের জীবনে মৌলিক চাহিদাগুলো যথা- অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মধ্যে প্রথম প্রয়োজনীয় হচ্ছে খাদ্য। বাকি সবগুলোর সঙ্গে আপস করা গেলেও খাদ্য ছাড়া বেঁচে থাকাটাই অসম্ভব। জন্মলগ্ন থেকেই একটি শিশুর প্রাথমিক চাহিদা থাকে খাদ্য; যা তার বেড়ে ওঠার জন্য অপরিহার্য। আর সেই খাদ্য যদি নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ না হয়, তাহলে শিশুটির স্বাভাবিক বৃদ্ধি যেমন ব্যাহত হয়, তেমনি তার মেধা বা মননশীলতারও বিকাশ ঘটে না। শিশুটি তখন জাতির কাছে মানবসম্পদে পরিণত না হয়ে বোঝায় রূপ নেয়। অর্থাৎ ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, তথা রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার সঙ্গে খাদ্যের নিরাপত্তা জড়িয়ে আছে।
আরও পড়ুন: পরিবেশবান্ধব উন্নয়নের এক নতুন সাফল্য
Advertisement
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, একজন মানুষ তার সুস্থতার জন্য কমপক্ষে প্রতিদিন মোট ৪০০ গ্রাম সবজি ও ফল (ফল জাতীয় সবজি ২০০ গ্রাম, পাতা জাতীয় সবজি ১০০ গ্রাম এবং ফল ১০০ গ্রাম) খাওয়া প্রয়োজন। এককথায় বলা যায়, একটি সুস্থ-সবল জাতি গঠনের পূর্বশর্ত হলো জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা ও সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করে নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তি। এখানে উল্লেখ্য, পুষ্টিসমৃদ্ধ কোনো খাবার নিরাপদ না হলে তা কোনো কাজে আসবে না বরং বিভিন্ন ধরনের রোগ সৃষ্টি বা মৃত্যুর কারণ হতে পারে। তাই যে কোনো খাবার নিরাপদ হওয়া বাঞ্ছনীয়। দানাদার শস্য বিশেষ করে ধান উৎপাদনে এরই মধ্যে বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর ‘এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে’ নির্দেশনা বাস্তবায়নে কৃষি মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, মৎস্য অধিদপ্তর ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরসহ অন্য অংশীজন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কার্যকর নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির প্রচলন ও নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে খাদ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় এইচএসিসিপি, জিএমপি, জিএইচপি, আইএসও ২২০০০ ইত্যাদি মান ও গাইড লাইনস অনুসরণের জন্য নির্দেশনা প্রদান করে যাচ্ছে।
উত্তম কৃষিচর্চাজাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে উত্তম কৃষিচর্চা হলো Good Agricultural Practices (GAP)। নিরাপদ এবং মানসম্পন্ন খাদ্য ও খাদ্য বহির্ভূত কৃষিজাত পণ্য সহজলভ্য করার মাধ্যমে পরিবেশ, অর্থনীতি এবং সামাজিক সুরক্ষা সুসংহত করার ক্ষেত্রে উত্তম কৃষিচর্চা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উত্তম কৃষিচর্চা পদ্ধতিগুলো খামার ও সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রয়োগ করার ফলে খাদ্য উৎপাদন, সংগ্রহ, পরিবহন, সংরক্ষণ, বিপণন, বিতরণ এবং সংগ্রহোত্তর প্রক্রিয়াকরণ পর্যায়ে নিরাপদ ও মানসম্পন্ন খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব। সেই সঙ্গে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা, পরিবেশ সংরক্ষণ, পণ্যের আন্তর্জাতিক মান অর্জন ও কাজের পদ্ধতিগত উন্নয়ন সাধন সম্ভব। এরই মধ্যে কৃষি মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ উত্তম কৃষিচর্চা নীতিমালা ২০২০ প্রণয়ন করে মাঠপর্যায়ে প্রয়োগের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
আরও পড়ুন: ধানের নতুন রোগ বিপিবি প্রতিরোধে করণীয়
Advertisement
পার্টনার প্রকল্পবর্তমান কৃষিকে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য টেকসই ও নিরাপদ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরের মাধ্যমে খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কৃষিখাতে নেওয়া সবচেয়ে বড় প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়েছে। প্রোগ্রাম অন এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ট্রান্সফরমেশন ফর নিউট্রিশন এন্টারপ্রেনারশিপ অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ইন বাংলাদেশ (পার্টনার) নামের এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। এটি কৃষির উন্নয়নে এযাবৎকালে নেওয়া সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এই মেগা প্রকল্পের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে উত্তম কৃষিচর্চা সার্টিফিকেশনের মাধ্যমে ৩ লাখ হেক্টর ফল ও সবজি আবাদি জমি বৃদ্ধি; জলবায়ু অভিঘাত সহনশীল উচ্চফলনশীল নতুন ধানের ও ধান ছাড়া অন্য দানাদার ফসলের জাত উদ্ভাবনসহ মোট ৪ লাখ আবাদি জমির পরিমাণ বাড়ানো; উন্নত ও দক্ষ সেচ প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ১ লাখ হেক্টর নতুন আবাদি জমি সেচের আওতায় আনা; স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে দেশব্যাপী ২ কোটি ২৭ লাখ ৫৩ হাজার ৩২১টি কৃষক পরিবারকে ‘কৃষক স্মার্ট কার্ড’ দেওয়ার মাধ্যমে ডিজিটাল কৃষিসেবার সম্প্রসারণ। উদ্যান ফসল, গবেষণাগার স্থাপন, বীজ পরীক্ষার মতো কার্যক্রমগুলো জোরদার করা হবে এ প্রকল্পের আওতায়। এছাড়া ই-ভাউচারে ভর্তুকি দেওয়া হবে এবং কৃষকদের জন্য তৈরি হবে কৃষক ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সিস্টেম। মোবাইল প্ল্যান্ট ক্লিনিকের মাধ্যমে কৃষি সম্প্রসারণ সেবাকে কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া হবে বলেও জানানো হয়েছে।
উত্তম কৃষিচর্চা বাস্তবায়ন কৌশলখাদ্য শৃঙ্খলের সব স্তরে সুনির্দিষ্ট অনুশীলনসমূহ সঠিকভাবে অনুসরণ করাই উত্তম কৃষিচর্চার মূলভিত্তি। বিশ্বব্যাপী খাদ্যসামগ্রী আমদানি ও রপ্তানি নির্ভরতার ফলে খাদ্য শৃঙ্খলে ভারী ধাতুর উপস্থিতি, কীটনাশকের অবশিষ্টাংশের উপস্থিতি, জীবাণু সংক্রমণ এবং বিস্তৃতির আশঙ্কা থাকে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি। এ প্রেক্ষাপটে নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা বিধানে বিভিন্ন দেশ খাদ্য আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে কঠোর বিধি নিষেধ আরোপ করেছে। কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ফসলে প্রয়োগকৃত রাসায়নিকের অবশিষ্টাংশ, দূষণকারী বস্তু বা ভারী ধাতু বা বিষাক্ত দ্রব্যের উপস্থিতি, পোকামাকড়, রোগ সৃষ্টিকারী অণুজীব, বাণিজ্যিক সংক্রামক এবং খাদ্যে অন্যান্য পদার্থের উপস্থিতি খাদ্য শৃঙ্খলের যে কোনো পর্যায়ে ঘটতে পারে। তাই খাদ্য শৃঙ্খলের প্রত্যেক স্তরেই নিরাপদ খাদ্য সংক্রান্ত ঝুঁকি চিহ্নিতপূর্বক প্রতিরোধ বা দূরীভূত করা প্রয়োজন। উত্তম কৃষিচর্চা বাস্তবায়নের মাধ্যমে উৎপাদিত ফসল খাদ্য হিসেবে গ্রহণ স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ কারণ উৎপাদনের সব স্তরে খাদ্যমান, ঝুঁকি নিরসন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এবং কল্যাণ সাধন নিশ্চিত করা হয়। সে কারণেই আন্তর্জাতিক ধারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উত্তম কৃষিচর্চা বাংলাদেশে অনুসরণ ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অচিরেই একটি সময়াবদ্ধ কর্মপরিকল্পনা তৈরি ও যথাযথভাবে প্রয়োগের মাধ্যমে এ নীতিমালা বাস্তবায়ন, পরিচালনা ও সুফল নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। প্রাথমিক উৎপাদন পর্যায় থেকে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত না হলে প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে কখনোই খাদ্য নিরাপদ করা সম্ভব নয়।
তাই উত্তম কৃষিচর্চা অত্যন্ত জরুরি। উত্তম কৃষিচর্চার পাশাপাশি উত্তম মৎস্যচর্চা ও উত্তম পশুপালনচর্চা না হলে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল তথা খাদ্যের নিরাপত্তা অধরাই রয়ে যাবে। লেখক: লিড-এগ্রিকালচারিস্ট, ঢাকা।
এসইউ/এমএস