‘এই টাকায় হবে না। কী দেন, এ দিয়ে হবে না। সব কিছু ঠিক করে আনেন কাজ করে দেবো।’
Advertisement
‘না স্যার, আপনি একটু দয়া করেন। গরিব মানুষ, বুইনেরে জমিডা দেবে, এই টাহাই পকেট দিয়া দেতেছি।’
প্রায় আড়াই মিনিটের একটি ভিডিওতে এভাবেই ফুটে উঠেছে ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ঘুষ লেনেদেনের চিত্র। সম্প্রতি জাগো নিউজের হাতে আসা একটি ভিডিওর সূত্র ধরে অনুসন্ধানে জানা যায়, পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার কালিশুরি ইউনিয়ন ভূমি অফিসের চিত্র এটি।
ফুটেজের সূত্র ধরে কালিশুরি ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তার দায়িত্বে রয়েছেন মো. আশরাফ আলী খান। ভিডিও ফুটেজের ব্যক্তির সঙ্গে তার শতভাগ মিলও রয়েছে। নিশ্চিত হওয়া যায় এটি এই অফিসের ঘুস লেনদেনেরই চিত্র।
Advertisement
অনুসন্ধানের দ্বিতীয় ধাপে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বললে ইউনিয়ন ভূমি অফিসের সেবার মানের বাস্তব চিত্র উঠে আসে। স্থানীয় বেশ কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভূমি অফিসের সব কাজ অনলাইনে হচ্ছে বলে বিগত সময়ের থেকে ঘুসের পরিমাণ বেড়েছে। টাকা না দিলে কোনো কাজই করেন না ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা আশরাফ আলী খান।
কালিশুরি গ্রামের ৪নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা মোতাহার সন্যামত জানান, ১৫ দিন আগে তিনি তার এক প্রতিবেশীকে নিয়ে ভূমির খাজনা দিতে গিয়েছিলেন।
কেমন ছিল ভূমি অফিসের সেবা- জানতে চাইলে মোতাহার সন্যামত বলেন, ‘সেবা..., ওনার ধারে গেলে সেবাতো দূরের কথা, এক টাহায় তেরো টাহা। গেলেই কয় রেকর্ড নাই, হলনা নাই, দলনা নাই, ওমুক নাই, সমুক নাই। কয় বাহের নামে রেকর্ড হইছে আবার এহন পোলার নামে রেকর্ড কইরা আনেন। তয় টাহা দেলে আর কিছু লাগে না, কাম কইরা দেয়। গত সপ্তাহে এক শতাংশ জমির দাখিলা কাটতে ২৫০০ টাকা নেছে। সরকারি ফি মোডে ৫০ টাহা।’
একই ধরনের অভিজ্ঞতা কালিশুরি বাজারের ফার্মেসি স্যবসায়ী কাজী রাশেদুল হকের। এ পর্যন্ত দুইবার জমির খাজনা দিতে গিয়ে তাকে মোটা অংকের টাকা ঘুস দিতে হয়েছে।
Advertisement
রাশেদুল হক বলেন, ‘আমি দুই আড়াই মাস আগে ৫ শতাংশ জমির দাখিলা করেছি। প্রথমে সে চাইছে ১৮ হাজার টাকা। আমি বলছি জমির দাম এক লাখ টাকা আর দাখিলায় লাগবে ১৮ হাজার, এ কোন কতা। এর পর আমি আত্মীয় পরিচয় দেওয়ার পর বলে ১২ হাজার টাকা লাগবে। আমি বলছি আমি এত টাকা দিতে পারমু না। পরে বলে খাজনার বই নাই। একদিন গেছি কয় নেটওয়ার্কে সমস্যা। পরে আমার কাছ থেকে ৯ হাজার টাকা নিয়া কাজ করছে। আর কয়দিন আগে ১০ শতাংশ জমির একটি দাখিলা কাটছি, সেখানেও সে আমার কাছ থেকে আট হাজার টাকা নিছে।’
তবে এমন অনিয়ম আর ভোগান্তিতে যখন ইউনিয়নের সাধারণ মানুষ তখন অভিযুক্ত ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা শুনালেন ভূমি অফিসের ডিজিটাল কাজ ও ডিজিটাল লেনদেনের কথা।
আশরাফ আলী খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘ভূমি অফিস এখন শতভাগ ডিজিটাল। সকল কাজ অনলাইনে হয়। আবেদনও অনলঅইনে করতে হয়। আমার এখানে হাতে হাতে কোনো কাজ নেই। আর সে কারণে আর্থিক লেনদেনেরও কোনো সুযোগ নাই। যেহেতু আমি তাকে কোনো কাগজ দিতে পারবো না সে কারণে আমি কীভাবে টাকা নেবো। আর আমাকে কেনইবা টাকা দেবে।’
এক পর্যায়ে ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তাকে ঘুস লেনেদেনের একটি ভিডিও ফুটেজ দেখালে তিনি দাবি করেন, তাকে ফাঁসানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে হয়তো কেউ এটি করেছে।
এদিকে ভূমি সহকারী কর্মকর্তার বক্তব্য শেষে ফেরার পথে অফিস স্টাফদের দিয়ে সাংবাদিকদের টাকা দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। এ সময় বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়ার জন্য বলেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মো. নূর কুতুবুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, ভূমি অফিসের কোনো সেবা প্রত্যাশী যদি কোনো ধরনের অনিয়মের শিকার হন তাহলে সরাসরি জেলা প্রশাসক কিংবা উপজেলা প্রশাসনের কাছে অভিযোগ জানাতে পারেন। সেক্ষেত্রে অভিযোগ লিখে আমার হোয়াটসঅ্যাপে কিংবা মেইলেও পাঠাতে পারেন। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
এফএ/এমএস