ফিচার

শিশুর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে প্রভাব

শীতের সকালে বাবা-মায়ের হাত ধরে প্রথম স্কুল প্রাঙ্গণে পা দেয় একটি শিশু। বইয়ের ব্যাগে কয়েকটি রঙিন পেন্সিল, খাতা, খেলনা গাড়ি আর ছবির বই। খাতার কয়েকটি পাতায় রঙিন ছবি আঁকার চেষ্টা হয়েছে অনেক, তবে কোনোটিই ছবি হয়ে ওঠেনি। স্কুলের নাম শুনেই যে শিশুর মন আনন্দে নেচে ওঠে, তা স্কুলের শ্রেণিকক্ষে ঢুকতেই বদলে যায়। রঙিন পেন্সিল আর খাতার রং নিয়ে খেলার সময় নেই। নেই কোনো স্কুলের মাঠ। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে আকাশ দেখা যায় না। সবুজ মাঠের তো প্রশ্নই আসে না। এমন চিত্রের দেখা মেলে শহরের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বিশেষ করে প্রাইভেট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

Advertisement

শহরে জনসংখ্যার অনুপাতে স্কুল বাড়ছে, অনেক বেশি শিক্ষার্থী স্কুলে যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের প্রাথমিক ও প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা কি দিন দিন নিরানন্দ হয়ে যাচ্ছে? ভালো স্কুলে ভর্তির জন্য প্রতিযোগিতা দিয়ে জীবন শুরু হয় ছোট্ট সোনামণির। শহরের সবচেয়ে নামি স্কুলে ভর্তি না হতে পারলে জীবনটাই মাটি হয়ে যাবে; এমন মনোভাব অভিভাবকদের কাছ থেকেই শিক্ষার্থীদের মাঝে সংক্রমিত হচ্ছে ক্রমান্বয়ে।

‘স্কুল ব্যাগটা বড্ড ভারী, বইতে কী আর আমরা পারি, কষ্ট হয়, কষ্ট হয়’—বাস্তব পটভূমিতে তৈরি কবির সুমনের এ গান। স্কুলের লম্বা সিলেবাসে শৈশব হারিয়ে যাচ্ছে। ইঁদুর দৌড়ের প্রতিযোগিতায় শিশুদের ব্যাগ হচ্ছে ভারী। পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে স্কুল ব্যাগে যুক্ত হচ্ছে গাইড বই, স্কেল, ক্যালকুলেটর, রং পেন্সিল, প্রতি বিষয়ের জন্য আলাদা এক বা একাধিক খাতা, টিফিন বক্স, পানির বোতলসহ অতিরিক্ত জিনিসপত্র। ভাবতেই বড় অবাক লাগে, মাত্র তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া একজন শিশুর দেহের ওজনের প্রায় সমান ওজন তার স্কুল ব্যাগের।

আরও পড়ুন: মধ্যযুগে পুতুল নয়, শিশুদের সাজানো হতো কাকতাড়ুয়া

Advertisement

জাগো নিউজের সঙ্গে কথা হয় এমনই কিছু শিশুর। যারা বাধ্য হয়েই প্রায় নিজের সমপরিমাণ ব্যাগের বোঝা নিয়ে স্কুলের দিকে ছুটছে। তুবা (ছদ্মনাম) নামের ৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থী জানায়, তার ব্যাগে খাতা, বই, কলম, মাম পট, টিফিন বক্স, ছাতা আর গাইড বই আছে। যা বহন করতে তার বেশ কষ্ট হয়। কিন্তু বই-খাতা না নিলে তো স্যার-ম্যাডাম বকা দেন, সেই ভয়ে অতিরিক্ত বইয়ের বোঝা তাকে টানতে হয়। সঙ্গে গাইড বই নেওয়ারও বাড়তি বেগ পোহাতে হয় তাকে।

চতুর্থ শ্রেণির আরেক শিশু তাওহীদ (ছদ্মনাম)। তার ব্যাগে আছে বই, খাতা, কলম, পানির পট, টিফিন বক্স, রং পেন্সিল। ছোট্ট মুখে বলছিল, লেখাপড়া করতে হলে ইট্টু কষ্ট নাকি করতেই হবে। এসব কথা তার বাবা-মা এবং স্যারদের থেকে শিখেছে। তাওহীদ আরও জানায়, স্কুল ব্যাগ বহন করতে তার নাকি পিঠে এবং ঘাড়ে প্রচুর ব্যথা হয়।

এদিকে রাইসা (ছদ্মনাম) নামের ৩য় শ্রেণির আরেক শিশু জানায়, আমার ব্যাগে আছে বইপত্র। বই, খাতা, গাইড বই, কলম, পানির বক্স, টিফিন বক্স। রাইসার শরীরের ওজন মাত্র ১৮ কেজি। আর তার ব্যাগের ওজন ১০ কেজির মতো।

এছাড়া কয়েকজন শিশুর ব্যাগের ওজন পরিমাপ করে দেখা গেলো প্রতিটি ব্যাগের ওজন ৬ থেকে ১২ কেজি। যা একটি শিশুর নিজের ওজনের কাছাকাছি। এছাড়া কিছু শিশুর ব্যাগের ওজন ৩ থেকে ৫ কেজির মধ্যে পেলেও সে সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম। আর দেড় থেকে ৩ কেজির সংখ্যা খুবই নগণ্য।

Advertisement

অথচ বিশেষজ্ঞদের মতে, স্কুল ব্যাগের ওজন হওয়া উচিত শিশুর শরীরের ওজনের সর্বাধিক ১০-১৫ শতাংশ। অর্থাৎ কোনো শিশুর ওজন যদি ২৫ কেজি হয়, সেক্ষেত্রে তার বইপত্রসহ স্কুল ব্যাগের ওজন হওয়া উচিত আড়াই থেকে বড়জোর তিন কেজি। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুদের স্কুল ব্যাগের ওজন দেড় থেকে দুই কেজির বেশি হওয়া উচিত নয়।

শাহনাজ পারভীন নামের এক অভিভাবক জানান, তার মেয়ে ৩য় শ্রেণিতে পড়ে। তার মেয়ের ব্যাগের ভেতর বই, খাতা, কলম, টিফিন বক্স, পানির পট দিতে হয়। তিনি আরও বলেন, ‘লেখাপড়া করাতে হলে, ভালো ফলাফল পেতে হলে তো একটু ভারী ব্যাগ টানতেই হবে। তাছাড়া স্কুল থেকেও চাপ আসে যে, বই-খাতা এগুলো নেওয়ার জন্য। পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে গাইড বই, জ্যামিতি বক্স এগুলোও নিতে বলে। অথচ বই-খাতা যদি একটু কম হয় তাহলে শিশুর জন্য উপকার হয়। আমার মেয়ে অনেক দিন স্কুল থেকে এসে বলে আম্মু পিঠে ব্যথা করে। কাঁধ ব্যথা হয়ে যায়। কিন্তু কী করবো বলুন? ছেলে-মেয়েদের তো ভালো একটা অবস্থানে নিতে হবে।’

উত্তম রায় আমাদের সঙ্গে গল্পের ছলে বলেন, ‘আমার ছেলে একটা কিন্ডারগার্টেনে ২য় শ্রেণিতে পড়ে। একটা শিশুর যে পরিমাণে ওজন, আমার মনে হয় একটা ব্যাগের ওজন তার সমান হয়ে যায়। শিশুর ব্যাগের ভেতরে তার আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র যেমন- পানির পট, টিফিন বক্সসহ অনেক কিছুই থাকে। তার বই ৬-৭টি সঙ্গে প্রতিটির জন্য আলাদা খাতা। বাড়ির কাজের খাতা আবার আলাদা নিতে হয়। এ নিয়ে যে ওজন দাঁড়ায়, তাতে শিশুটির বহন করতে সমস্যাই হয়।’

আরও পড়ুন: দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়েও বাহার যেভাবে সফল হলেন 

সরকারি প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত বইয়ের সংখ্যা কম থাকলেও, বেসরকারি বা প্রাইভেট বিদ্যালয়গুলোতে সম্পূর্ণ উল্টো চিত্রের দেখা মেলে। বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, ‘শিশুদের ভালো রেজাল্টের জন্যই তাকে নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়। অন্য প্রতিষ্ঠানের থেকে ব্যতিক্রম হতে বেশি বেশি বাড়ির কাজ, কয়েক ধরনের নোট বই, প্রতি বিষয়ের জন্য আলাদা খাতা আনতে শিশুদের এক ধরনের বাধ্যই করা হয়। এতে যদিও তার ব্যাগের বোঝা বেশি হয়ে যায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ যেভাবে চালাবেন, আমরা সেভাবেই চলতে বাধ্য। নয়তো চাকরি হারানোর ভয় তো থেকেই যায়।’

শহরে যত বেশি নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; তত বেশি জমতে থাকে বইয়ের ভার। ভার বইতে বইতে হয়তো কোনো শিশু অকালে আক্রান্ত হয়ে যায় মেরুদণ্ডের নানা সমস্যায়। বেঁকে যাচ্ছে মেরুদণ্ডের হাঁড়। ছাঁচে ঢালা শিক্ষা ব্যবস্থায় কাউকে হতে হবে চিকিৎসক, কাউকে প্রকৌশলী অথবা বড় কোনো নামিদামি কর্মকর্তা। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা; এমন যুক্তি যেন অতীত হয়ে যাচ্ছে। রূপকথার গল্পের টিয়া পাখির শিক্ষা দানের মতো অবস্থা এখন আমাদের সমাজের। শিক্ষা ব্যবস্থাকে গলদকরণ করে দেওয়া হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষায়।

শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলেন বাকেরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এবং শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শংকর প্রসাদ অধিকারী। তার মতে, ‘স্কুল ব্যাগের ওজনের কারণে শিশুদের শারীরিক ও মানসিকভাবে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পড়ে। ভারী ব্যাগ বহনের ফলে শিশুরা ক্লান্ত বা অবসাদপূর্ণ হয়ে পড়ে এবং মাসেল স্ট্রেচিং হয়। মাসেল স্ট্রেচিংয়ের ফলে শিশুরা ফ্যাটি হয়ে যায়। এছাড়া সোল্ডার পেইন, নেগ পেইন, লাম্বার পেইন, গো ব্যাক পেইন, নী পেইনগুলোতেও শিশুরা ভুগে থাকে। দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিকর এবং সবচেয়ে ভয়ের কারণ হলো শিশুদের স্পাইনাল কর্ডগুলো পার্মানেন্ট বাঁকা হয়ে যেতে পারে। যেগুলোকে আমরা বলি স্কোলিয়োসিস অর কাইফোসিস যেটা আমাদের জন্য খুবই ভয়ের বিষয়। এটা হলে শিশুদের দীর্ঘমেয়াদী রেস্পিরেটোরি বা শ্বাসযন্ত্র, হার্ট, হৃৎপিণ্ড এবং শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ওপরে প্রভাব পড়ে এবং শিশুর জন্য সেটা দীর্ঘমেয়াদী এবং সারাজীবনের জন্য একটা ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।’

আরও পড়ুন: শিশুদের জীবন রক্ষার কৌশল হচ্ছে সাঁতার শেখা

দেশে ইমারত হচ্ছে শত সহস্র। এই ইমারত কেন্দ্রিক শহর মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য উপযোগী নয় একেবারেই। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ছে শহরে বড় হয়ে ওঠা শিশুদের মাঝে। স্কুল কিংবা বাসা কোথাও মাঠ বা খালি জায়গা অবশিষ্ট নেই বললেই চলে। শিশুদের হাঁপ ছেড়ে বাঁচার সময়টা কেড়ে নিচ্ছে এই যান্ত্রিক আর অবকাঠামোয় ভরা নগরী। জীবনের শুরুতেই নিরানন্দ প্রাথমিক স্কুল সারাজীবনকেই এলোমেলো করে দিচ্ছে অনেক শিশুর।

কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রণালয় শিশুদের জন্য বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। মূলত শিশুদের পড়াশোনার চাপ কমানোর জন্য উদ্যোগী হচ্ছেন তারা। বইয়ের ভার কমানোর জন্য প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত কমানো হচ্ছে বইয়ের সংখ্যা। সেই সঙ্গে বেশকিছু পরীক্ষা কমিয়ে ফেলারও উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অতিরিক্ত চাপ কমাতে হবে। স্কুলে লকারের ব্যবস্থা করা কিংবা বই, খাতা, গাইড সংখ্যা কমানো এবং অভিভাবকদের হতে হবে সচেতন।

তবেই একদিন আকাশ-বাতাস-মাটি হবে মধুময়। মনে আসবে দৃঢ় বিশ্বাস। সব অমানিশা কাটিয়ে শিশুরা হবে মুক্ত বিহঙ্গ। তাই আপনার শিশুর স্কুল ব্যাগের দিকে দৃষ্টি রাখুন, ব্যাগ থেকে অতিরিক্ত বোঝা কমিয়ে শিশুকে মানসিক ও শারীরিকভাবে সুস্থ রাখুন।

কেএসকে/এসইউ/জিকেএস