ওমর ফারুক জিলন
Advertisement
রাজধানীর পুরান ঢাকার বুড়িগঙ্গার তীরবর্তী ইসলামপুরের কুমারটুলী এলাকায় মাথা উঁচু করে স্বগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে তৎকালীন নবাবদের তৈরী দেড়শো বছরের পুরোনো আহসান মঞ্জিল। শেখ এনায়েত উল্লাহর তৈরি প্রমোদভবনটি একসময় নবাবদের আবাসিক ভবন ও জমিদারদের সদর কাচারি হিসেবে চালু থাকলেও বর্তমানে এটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৮৫৯ সালে নওয়াব আব্দুল গনি এটির নির্মাণ কাজ শুরু করেন এবং ১৮৭২ সালে নির্মাণ কাজ শেষ হয়। প্রাণপ্রিয় পুত্র খাজা আহসান উল্লাহর নামে এর নামকরণ করা হয় ‘আহসান মঞ্জিল’।
১৮৮৮ সালের ৭ এপ্রিল প্রবল ভূমিকম্পে পুরো আহসান মঞ্জিলের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত আহসান মঞ্জিল পুনর্নির্মাণের সময় বর্তমান উঁচু গম্বুজটি সংযোজন করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশের পট পরিবর্তনকারী বিখ্যাত মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত হয়েছিল এই গৌরবমন্ডিত আহসান মঞ্জিলে।
আরও পড়ুন: বিশ্বের সপ্তাশ্চর্যের তালিকায় যেসব স্থান
Advertisement
আহসান মঞ্জিল দুটি অংশে বিভক্ত। প্রথমভাগে মূল ভবন এবং অন্যটি অন্দরমহল যা দ্বিতলা বিশিষ্ট। একসময় মূল ভবন ও অন্দরমহলের মাঝে সংযোগ সেতু থাকলেও বর্তমানে এটি অচল ও বেহালদশায় পড়ে আছে। মূল ভবনের নিচতলায় ১০ টি রুম এবং উপরের তলায় ১৪ টি রুম রয়েছে। নিচ তলায় মধ্যে উনবিংশ শতাব্দীর সৈনিকদের বর্ম, নবাবদের ব্যবহৃত ধাতব, পিতল, সিরামিক এবং চীনামাটির তৈরি নানা ধরনের আসবাবপত্র, ফানুস, জগদান, ফলপাত্র, আতরদান; বক্ষণাস্ত্র, শিরণাস্ত্র, দাঁতসহ হাতির মাথার কঙ্কাল, মুসলিম লীগ হল, বিলিয়ার্ড টেবিল, বক্স, ভল্ট সহ দৈত্যাকার আলমারি ও সিন্ধুক ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। দ্বিতীয় তলায় ওঠার জন্য লাল গলিচায় আবৃত কাঠের প্রধান সিড়িটি বর্তমানে বন্ধ আছে। ১০ নং রুম দিয়ে দোতলায় উঠার জন্য পাকা সিঁড়ি রয়েছে।
দোতলায় রয়েছে মাওলানা আকরাম খাঁ, এ.কে ফজলুল হল, হরপ্রসাধ শাস্ত্রী, বিপিন চন্দ্র পাল, সৈয়দ আমীর আলী, হাজী মুহাম্মদ মহসিন, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, বেগম রোকেয়া, কাজী নজরুল ইসলাম, হাছন রাজা, জগদীশ চন্দ্র নসু, দীন বন্ধু মিত্র, প্যারিচাঁদ মিত্র প্রমুখ বিখ্যাত ব্যক্তিবর্গের প্রতিকৃতি। এছাড়াও রয়েছে নবাবদের ব্যবহৃত হাতির দাঁতের হাতপাখা, পাশার ঘুটি, সাদা সিমেন্টের তৈরি ভাস্কর্য, লাইব্রেরি কক্ষ, টাইপ মেশিন পানিশোধন যন্ত্র, বৈদ্যুতিক হিটার, বৈদ্যুতিক মিটার, ঝাড়বাতি, প্রাসাদ ড্রইিং রুম, দর্শনার্থী বিশ্রামাগার, বলরুম নাচঘর, দৈত্যাকার হল গ্রান্ড পিয়ানো, ক্রিষ্টাল টেবিল, ঘোড়ার হাতল বিশিষ্ট চেয়ার, গুপ্ত স্থানে যাওয়ার জন্য দুটো সিঁড়ি।
আহসান মঞ্জিলকে ঢাকা শহরের প্রথম ইট-পাথরের তৈরি স্থাপত্য নিদর্শন মনে করা হয়। তৎকালীন নবাবদের হাতে এই ভবনেই সর্বপ্রথম বৈদ্যুতিক বাতি জ্বলে উঠে। একসময় ঢাকা শহরের সবচেয়ে উঁচু গম্বুজ ছিল আহসান মঞ্জিলের প্রাসাদের ছাদের ওপরের সুন্দর গম্বুজটি।
আরও পড়ুন: হেলিপ্যাডে ‘এইচ’ লেখা থাকে কেন?
Advertisement
আহসান মঞ্জিলের অন্দরমহলে রয়েছে অফিস, ঘোড়ার গাড়িতে সলিমুল্লাহর ভাস্কর্য, নওয়াবদের, মোটরযান (ডিওরোমা), নওয়াবদের বজরা, স্টিমার, প্রভাবশালী কর্মচারীদের প্রতিকৃতি, শয়ন কক্ষ এবং হাম্মামখানা, ইমারজেন্সি সিঁড়ি। এছাড়াও আহসান মঞ্জিলে রয়েছে বিশাল বাগান, ফুল ও ফল গাছ, দোতলা থেকে নামার জন্য দৈত্যাকার সিঁড়ি যা ফটোগ্রাফিপ্রেমী দর্শনার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু, প্রবেশ পথে রয়েছে দর্শনার্থীদের ব্যাগ রাখার সুব্যবস্থা।
১৯০১ সালে খাজা আহসানউল্লাহর মৃত্যুর পর আহসান মঞ্জিলের গৌরবময় অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটে। তার উত্তরসূরিরা পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে আহসান মঞ্জিলের গৌরবকে ধরে রাখতে পারেননি। তারা প্রাসাদের বিভিন্ন অংশ ভাড়াটিয়াদের কাছে ভাড়া দেন এবং এর ফলে প্রাসাদটি বস্তিতে রুপান্তরিত হয়।
১৯৫২ সালে সরকার এই সম্পত্তিটি অধিগ্রহণ করে। ১৯৮৫ সালে ঢাকা জাতীয় জাদুঘর এই প্রাসাদটি অধিগ্রহণ করে জাদুঘরে রূপান্তরিত করে। বর্তমানে যা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়েছে। নির্দিষ্ট মূল্যের টিকিট কেটে আহসান মঞ্জিল দেখতে পারবেন যে কেউ।
আহসান মঞ্জিলে যেতে ঢাকার সদরঘাটগামী যে কোনো বাসে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে নেমে যেতে হবে। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে কিংবা ৩০ টাকা রিকশা ভাড়ায় আহসান মঞ্জিল যেতে পারবেন। অথবা ঢাকার যে কোনো জায়গা থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত এসে রিকশা অথবা সিএনজি নিয়ে সদরঘাট হয়ে আহসান মঞ্জিল দেখতে যেতে পারেন।
লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
কেএসকে/জিকেএস