হাসানুল হক ইনু। জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (ইনু) সভাপতি। জন্ম ১৯৪৬ সাল, কুষ্টিয়া। সাবেক তথ্যমন্ত্রী। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
Advertisement
আসন্ন নির্বাচন, জোট, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে মুখোমুখি হন জাগো নিউজের। দুই পর্বের সাক্ষাৎকারের আজ থাকছে প্রথমটি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সায়েম সাবু।
জাগো নিউজ: দেড় দশক ধরে ক্ষমতার অংশীদার হয়ে আছেন সরকারে। সুনাম নাকি বদনামের পাল্লা ভারী করলেন?
হাসানুল হক ইনু: ২০০৯ সাল থেকে আমরা ক্ষমতায়। রাজনৈতিক বা সাংবিধানিক দায়িত্বই শুধু আমাদের পালন করতে হয়নি, আমরা অর্থনীতিকেও উদ্ধার করেছি। ২০০৯ সালে আমরা একটি সংবিধান পেয়েছিলাম, যেখানে সামরিক বাহিনীর পদচিহ্ন ছিল। জিয়াউর রহমান ও এরশাদ সংবিধানে সাম্প্রদায়িক চেতনা ঢুকিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি বিদেশিদের কাছে ইজারা দিয়েছিলেন। মুক্তবাজারের নামে একটি জগাখিচুড়ি মার্কা অর্থনীতি পরিচালনা করা হয়েছে। অনুন্নয়নই ছিল অতীত সরকারের মাপকাঠি। আমরা অন্ধকার থেকে অর্থনীতি উদ্ধার করেছি।
Advertisement
আরও পড়ুন>> ‘এমন বিপদে বাংলাদেশ কখনই পড়েনি’
অন্যদিকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর সামরিক যে জঞ্জাল সৃষ্টি করে গিয়েছিল, তা পরিষ্কার করার উদ্যোগ নিতে হয়েছে। আমরা ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যেতে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হয়েছি।
জাগো নিউজ: যে চেতনার প্রশ্নে জোট করেছিলেন তার প্রাপ্তিতে কী বলবেন?
হাসানুল হক ইনু: আমি সমগ্র জাতির প্রাপ্তি নিয়ে বলছি। আমি নিজে কী পেলাম আর কী না পেলাম বা দল কী পেল তা নিয়ে ভাবি না। এটি একটি সংকীর্ণ হিসাব। বাংলাদেশ সৃষ্টির পর ২০০৮ সালেই একমাত্র ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন হয়েছে। আমরা মন্ত্রিসভায় ছিলাম। ২০১৮ সাল থেকে জোটের শরিকরা মন্ত্রিসভায় নেই। কিন্তু আমরা জোটের হয়েই সরকারে কাজ করছি।
Advertisement
জাগো নিউজ: মন্ত্রিসভায় এখন নেই, হতাশা কাজ করে?
হাসানুল হক ইনু: না। আমাদের মধ্যে কোনো হতাশা কাজ করে না। এমনকি জোটে থাকা না থাকা নিয়ে জোট নেত্রীর সঙ্গে কোনোদিন আলোচনা করিনি।
জাগো নিউজ: কিন্তু নিজ দলের মধ্যে তো চাপ আছে?
হাসানুল হক ইনু: রাজনীতি মানেই তো ক্ষমতা। কর্মীরাও হিসাব করতে পারে। আমরা সেই অর্থে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভাগবাটোয়ারা করতে পারিনি। অনেক জায়গায়ই আমরা নেই, যেখানে থাকার কথা ছিল।
জাগো নিউজ: তার মানে জোটে বঞ্চিত হয়েছেন?
হাসানুল হক ইনু: বঞ্চিত বলবো না। তবে টানাপোড়েন আছে।
রাজনীতি মানেই তো ক্ষমতা। কর্মীরাও হিসাব করতে পারে। আমরা সেই অর্থে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভাগবাটোয়ারা করতে পারিনি। অনেক জায়গায়ই আমরা নেই, যেখানে থাকার কথা ছিল।
জাগো নিউজ: টানাপোড়েন থেকেই বিস্ফোরণ ঘটে? জোটেই থাকছেন?
আরও পড়ুন>> আমি আওয়ামী লীগে থাকলে বিএনপিকে নিষিদ্ধ করতাম
হাসানুল হক ইনু: বিস্ফোরণ হবে না। কারণ শেখ হাসিনা সঠিকভাবেই দেশটি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
জাগো নিউজ: আপনার মনে হয় দেশ সঠিকভাবে এগোচ্ছে?
হাসানুল হক ইনু: অবশ্যই সঠিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ রাজাকার-জঙ্গিবাদের যে থাবা তা থেকে দেশটাকে তিনি রক্ষা করে চলছেন।
জাগো নিউজ: ১৯৭২ সালের সংবিধানে যাওয়ার কথা বললেন। পারেননি তো?
হাসানুল হক ইনু: আমরা সংবিধানের মূল চারটি ধারা প্রবর্তন করতে পেরেছি। সাম্প্রদায়িক কয়েকটি ধারা আমরা বাদ দিতে পেরেছি। তবে জিয়াউর রহমান ও এরশাদের প্রণয়ন করা কয়েকটি ধারা বাদ দিতে পারিনি। তবে আমরা উত্তরণের পর্যায়ে আছি। আমরা সবকিছু অর্জন করতে পারিনি। কিন্তু যাত্রা তো থেমে নেই। আমরা যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে সক্ষম হয়েছি, জঙ্গি দমন করতে পেরেছি এমনকি আঞ্চলিক শান্তি রক্ষায় কাজ করতে পেরেছি।
জাগো নিউজ: আসলেই কি সক্ষম হয়েছেন, নাকি সাময়িক বিরতি বা ধামাচাপার পরিস্থিতি চলছে?
হাসানুল হক ইনু: আমি বলছি না যে জঙ্গিবাদ একেবারে বিতাড়িত হয়েছে। এখনো ধর্মভিত্তিক দলগুলো নিবন্ধন নিয়ে কাজ করছে। এটি আমাদের চেষ্টার ঘাটতি।
জাগো নিউজ: বল প্রয়োগ করে দুর্বল করার চেষ্টা করছেন। আপনারা তো চাইছিলেন মননে-মগজে চেতনার প্রতিষ্ঠা দিতে। তা কি পারলেন?
হাসানুল হক ইনু: এখানে দীর্ঘদিন সাম্প্রদায়িক ও সামরিক বাহিনীর চেতনা কাজ করেছে। এ অবস্থা থেকে সহজেই বের হয়ে আসা সম্ভব নয়। ১৯৭১ সালের খুনি, ১৯৭৫ সালের খুনি, ২১ আগস্টের খুনিদের সঙ্গে বিএনপি সরাসরি জড়িত। একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এটি বড় ঘটনা। ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়ে বিএনপি জঘন্য অপরাধ করেছে।
জাগো নিউজ: বঙ্গবন্ধুর শাসনব্যবস্থা আলোচনায় এলে আপনার দল জাসদের বিরোধিতাও আলোচনায় আসে। আপনার ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন আসে। বলা হয় বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট মূলত জাসদই তৈরি করেছিল।
হাসানুল হক ইনু: আওয়ামী লীগের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা মোশতাকের দালাল, খুনির পক্ষ তারাই অপরাধ আড়াল করতে জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, ভাসানীর ঘাড়ে দোষ চাপায়।
জাগো নিউজ: কিন্তু আপনি তো বঙ্গবন্ধুর শাসনব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিলেন, এটি সত্য?
হাসানুল হক ইনু: বঙ্গবন্ধুর শাসনব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিলাম রাজনৈতিক অধিকার থেকে। এটি আমার অধিকার। সাংবিধানিক অধিকার। বঙ্গবন্ধু তো সাংবিধানিক অধিকার চর্চা করেছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে পার্লামেন্টে জাসদ ছিল। মারামারি হয়েছে, দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়েছে। কিন্তু হত্যা, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল, সামরিক শাসনের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। এটি নিয়ে আলোচনা করতেও চাই না।
আরও পড়ুন>> জামায়াতকে ছাড় দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই
আমি বলতে চাইছি, জেনারেল জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শুধু সমর্থনই করেনি, একাত্তরের খুনিদের ভাগাড় থেকে তুলে এনে রাজনীতি করার সুযোগ দিয়েছে। জিয়াউর রহমানের কারণেই জামায়াত রাজনীতি করার সুযোগ পায়, রাজাকাররা মন্ত্রী হয়। এই রেশ থেকে বেরিয়ে আসতে তো সময় লাগবে।
১৫ বছর ধরে এই অপশক্তি একটি নির্বাচিত সরকারকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনও খালেদা জিয়া মেনে নেননি। পরে আবার হেফাজতে ইসলামের ওপর ভর করে ক্ষমতায় যাওয়ার চেষ্টা করেছে।
বঙ্গবন্ধুর শাসনব্যবস্থার বিরোধিতা করেছিলাম রাজনৈতিক অধিকার থেকে। এটি আমার অধিকার। সাংবিধানিক অধিকার। বঙ্গবন্ধু তো সাংবিধানিক অধিকার চর্চা করেছেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে পার্লামেন্টে জাসদ ছিল। মারামারি হয়েছে, দ্বন্দ্ব-সংঘাত হয়েছে। কিন্তু হত্যা, অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল, সামরিক শাসনের সঙ্গে আমাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না।
জাগো নিউজ: বলা হয় হেফাজতের ওপর সরকারও ভর করে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে?
হাসানুল হক ইনু: সরকার হেফাজতের সঙ্গে নেই। সরকার মূলত হেফাজতকে দয়া করেছে। হেফাজতের খুনিচক্র যারা রাজাকারদের পক্ষে ছিলেন আমরা তাদের সাজা দিয়েছি।
জাগো নিউজ: এই ‘দয়া’ কোনো কিছুর বিনিময়ে কি না?
হাসানুল হক ইনু: আমাদের কোনো বিনিময় নেই। হেফাজতের অপরাধী কেউ রেহাই পায়নি। সবাই মামলায় জেলখানায় আছে।
জাগো নিউজ: তাহলে দয়ার প্রশ্ন এলো কেন?
হাসানুল হক ইনু: দয়ার প্রশ্ন এই কারণে এলো যে, আমরা হেফাজতের মতো বদলা নিইনি। গণতান্ত্রিক উপায়ে সরকার আইনি ব্যবস্থা নিয়েছে।
জাগো নিউজ: এক সময় ‘দয়া’ বুমেরাং হতে পারে কি না?
হাসানুল হক ইনু: আমি তা মনে করি না।
জাগো নিউজ: হেফাজত নেতাদের সঙ্গে সরকারি দলের লোকেরা বৈঠক করে। খোদ গণভবনে হেফাজত প্রধান বৈঠক করলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে।
হাসানুল হক ইনু: একজন দেখা করতে এলেই তার সঙ্গে সমঝোতা হয় না। আমরা আইনি ব্যবস্থায় মোকাবিলা করছি। আমরা ২১ আগস্টের মতো গ্রেনডে হামলা করে সব শেষ করে দিচ্ছি না।
জাগো নিউজ: হেফাজত আবারও সক্রিয় হচ্ছে…
হাসানুল হক ইনু: হেফাজত আইনের বাইরে পা রাখলে পা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সেটা হেফাজতের আমির-ই হোক অথবা কর্মীই হোক। আইনের বাইরে এক চুল গেলে কোনো দয়া দেখানো হবে না।
আমি মনে করি হেফাজত সরকারের জন্য কোনো ফ্যাক্টর নয়। বিএনপি-জামায়াত সংগঠিত হচ্ছে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার নাম করে। এই খেলায় বিএনপি শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করে একটি ছদ্মবেশী সরকার প্রতিষ্ঠা দিচ্ছে, যারা জামায়াত ও দণ্ডিত রাজাকারদের পক্ষে সাফাই গাইবে।
বিএনপি গণতন্ত্র, ভোটের মাঠে সমান্তরাল রাজনীতির নামে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনতে চাইছে যারা জঙ্গিবাদ, সাম্প্রদায়িক চেতনা, খুনি, স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতের রাজনীতি হালাল করে দেবে।
এএসএস/এএসএ/জিকেএস