আন্তর্জাতিক

তিন দিক থেকে হামলার জন্য প্রস্তুত ইসরায়েলি সৈন্যরা

স্থল, আকাশ এবং জলপথে হামলার জন্য পরিকল্পনা করছে ইসরায়েল। এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স (আইডিএফ) জানিয়েছে, তাদের সেনারা সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছে। তবে কবে নাগাদ এই স্থল অভিযান শুরু হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। খবর আল জাজিরা, বিবিসির। 

Advertisement

শনিবার (১৪ অক্টোবর) রাতে ইসরায়েলি সেনাদের প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। এর আগে গত শনিবার যেখানে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস হামলা চালিয়েছিল সেখানেই ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ইসরায়েলি সৈন্যদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন তিনি। একটি ভিডিও ফুটেজে তাকে বুলেট প্রুফ পোশাকে ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায়।

আরও পড়ুন: এবার ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলে হিজবুল্লাহর হামলা, হতাহত ৪

সে সময় সেনাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সামনে যা হতে পারে তার জন্য কি আপনারা প্রস্তুত? এর উত্তরে সেনারা জানান, তারা পুরোপুরি প্রস্তুত। হামাস নেতাদের পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন ইসরায়েলের শীর্ষ নেতারা। তারা বলছেন, গাজা আগে যা ছিল সেই অবস্থায় আর কখনো ফিরবে না।

Advertisement

নেতানিয়াহু বলেছেন, প্রতিটি হামাস সদস্য একজন মৃত ব্যক্তি। ইসরায়েল গাজার সম্ভাব্য অভিযানের নাম দিয়েছে দ্য অপারেশন সোর্ডস অব আয়রন। ধারণা করা হচ্ছে, গাজার ইতিহাসে যত সামরিক পরিকল্পনা এর আগে হয়েছে, এটি হবে তার অনেক বেশি জোরালো অভিযান।

কিন্তু এটা কি বাস্তবসম্মত সামরিক অভিযান? সামরিক কমান্ডাররা কীভাবে একে সফল করে তুলবেন? এমন প্রশ্নই এখন ঘুরেফিরে আসছে। গাজা উপত্যকায় স্থল অভিযান মানে হলো শহরের ঘরে ঘরে লড়াই, যা বেসামরিক নাগরিকদের জীবন ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে।

বিমান হামলায় এর মধ্যেই কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং চার লাখেরও বেশি মানুষ তাদের ঘর-বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। এখন ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব হলো ১৫০ জন জিম্মিকে উদ্ধার করা। এসব জিম্মিকে গাজার গোপন কোনো স্থানে রাখা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আইডিএফ হামাসকে ‘বিলুপ্ত’ করে দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে এবং এর একজন নেতাকে বিশেষভাবে চিহ্নিত করেছে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর বেতারের সামরিক বিশ্লেষক আমির বার শালম অবশ্য বলছেন যে, ইসরায়েল হামাসের সব সদস্যকে বিলুপ্ত বা অকার্যকর করা সম্ভব হবে বলে মনে করি না। কিন্তু আপনি তাদের দুর্বল করতে পারেন যেন আর কোনো অভিযান চালানোর সক্ষমতা না থাকে।

Advertisement

আরও পড়ুন: সৌদি যুবরাজের সঙ্গে বৈঠক ‘খুবই ফলপ্রসূ’ হয়েছে: ব্লিঙ্কেন

এটা হতে পারে অনেক বেশি বাস্তববাদী লক্ষ্য। হামাসের সঙ্গে চারটি যুদ্ধ করেছে ইসরায়েল। কিন্তু এর রকেট হামলা ঠেকানোর প্রতিটি চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেঃ কর্নেল জোনাথন কনরিকাস বলেছেন, যুদ্ধের পর কোনো ইসরায়েলি নাগরিককে হত্যা বা হুমকির সামরিক সক্ষমতা আর হামাসের থাকবে না।

স্থল অভিযানের ঝুঁকিঅনেকগুলো বিষয় আছে যা সামরিক অভিযানকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে পারে। ইসরায়েলের আক্রমণের জন্য প্রস্তুত থাকবে হামাসের সামরিক শাখা আল কামেম ব্রিগেড। বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরক বসানো হবে। সেট করা হবে অ্যামবুশ। গাজার বিস্তৃত টানেল নেটওয়ার্ক ইসরায়েলি সৈন্যদের ওপর হামলায় ব্যবহৃত হবে।

২০১৪ সালে ইসরায়েলি পদাতিক ব্যাটালিয়ন মারাত্মক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছিলো অ্যান্টি ট্যাংক মাইন, স্নাইপার আর অ্যামবুশের কারণে। গাজা শহরের উত্তরাঞ্চলের কাছে শত শত বেসামরিক নাগরিক মারা যায় সেই লড়াইয়ে।

এ কারণেই ইসরায়েল এবার ১১ লাখ বেসামরিক নাগরিককে দ্রুত গাজা ছাড়তে বলেছে। এরা গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলে বসবাস করে। ইসরায়েল এবার সতর্ক করে বলেছে, যুদ্ধ কয়েক মাস স্থায়ী হতে পারে। তারা রেকর্ড সংখ্যক ৩ লাখ ৬০ হাজার রিজার্ভ সেনাকে জড়ো করেছে।

এখন প্রশ্ন হলো ফিরে যাবার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ ছাড়াই কতদিন এটা অব্যাহত রাখতে পারবে ইসরায়েল? জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা বলছে, গাজা দ্রুত ‘জাহান্নামের গর্তে’ পরিণত হচ্ছে। মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। পানি, বিদ্যুৎ ও তেল সরবরাহ বন্ধ আছে। এখন মোট জনসংখ্যার অর্ধেককেই গাজা ছাড়তে বলা হচ্ছে।

সরকার ও সামরিক বাহিনী মনে করছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের সাথে আছে- বিশেষ করে পশ্চিমা নেতারা। এখন চিন্তা হলো অবস্থান নিয়ে। এমনটাই বলছেন ইসরায়েলের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বিষয়ক সাংবাদিক ইয়সি মেলমান। দ্রুত বা বিলম্বেই হোক যখন ক্ষুধার্ত মানুষের ছবি আসবে তখনি ইসরায়েলের সহযোগী দেশগুলো এতে হস্তক্ষেপ করবে।

তবে হামাস যাদের জিম্মি করে নিয়ে গেছে তাদের মধ্যে বেশিরভাগই ইসরায়েলি হলেও অনেক বিদেশি নাগরিকও আছেন। এদের মধ্যে অনেকের দ্বৈত নাগরিকত্ব আছে। এসব কারণেই যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের এই অভিযানে অংশীদারিত্ব আছে।

আরও পড়ুন: ইসরায়েলের সমর্থনে দ্বিতীয় রণতরী পাঠালো যুক্তরাষ্ট্র

এদিকে ফরাসি-ইসরায়েলি পরিবারগুলোকে আশ্বস্ত করে প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, তাদের প্রিয়জনদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করা হবে। ফ্রান্স কখনো তার কোনো সন্তানকে পরিত্যক্ত রেখে আসে না।

এই জিম্মিদের ভাগ্যও অনেকটা প্রভাব রাখবে সামরিক পরিকল্পনায়। ইসরায়েলের নেতাদের ওপর এজন্য অভ্যন্তরীণ চাপও আছে। আমির বার শালম একে ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকের সময়কার ঘটনার সঙ্গে তুলনা করেছেন। সে সময় ফিলিস্তিনি বন্দুকধারীরা ইসরায়েলি অ্যাথলেটদের অপহরণ করেছিলো এবং নিহত হয়েছিল ১১ জন। ওই হামলার সঙ্গে জড়িত সবাইকে হত্যার জন্য অপারেশন পরিচালনা করা হয়েছিল।

তার মতে, সরকার এবারও অপহরণের সঙ্গে জড়িত সবাইকে ধরতে চায়। জিম্মি সবাইকে উদ্ধার করাটা হয়তো ইসরায়েলের এলিট ইউনিট সায়েরেত মাতকাল এর কমান্ডোদের সক্ষমতার প্রমাণ দেবে। অপরদিকে ইসরায়েল হামলা চালালে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে জিম্মিদের গুলি করে হত্যার হুমকি দিয়েছে হামাস।

২০১১ সালে ইসরায়েল হামাসের হাতে পাঁচ বছর আটক থাকা গিলাড শালিত নামে এক সেনার বিনিময়ে এক হাজার বন্দীকে মুক্তি দিয়েছিল। কিন্তু এখন বড় সংখ্যায় বন্দীদের ছাড়তে ইসরায়েলকে দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে হবে। কারণ এর আগে মুক্তি পাওয়াদের একজন হলেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। তিনি এখন গাজায় হামাসের বড় রাজনৈতিক নেতাদের একজন।

প্রতিবেশীদের ঘনিষ্ঠ পর্যবেক্ষণস্থল অভিযানের সময় ও ফলাফলকে আরও একটি বিষয় প্রভাবিত করতে পারে। তা হলো- ইসরায়েলের প্রতিবেশীদের প্রতিক্রিয়া। মিশরের কাছ থেকে দাবি ক্রমশ বাড়তে পারে। গাজার সাথে দেশটির সীমান্ত আছে। তারা ইতোমধ্যেই রাফাহ সীমান্ত ক্রসিং দিয়ে মানবিক সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছে।

ইসরায়েলের ইন্সটিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের অফির উইন্টার বলছেন, গাজায় ইসরায়েলি সামরিক অভিযান যত বাড়বে, মিশরও তত বেশি চাপে পড়বে এটা প্রমাণের জন্য যে, তারা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেনা।

অন্যদিকে ইসরায়েলের উত্তর সীমান্ত লেবাননের সাথে এবং সেটাও এখন ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। হিজবুল্লাহর সঙ্গে কয়েকটি সংঘর্ষ ইতোমধ্যেই হয়েছে। তবে তারা নতুন করে যুদ্ধ ঘোষণা করেনি।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। তিনি বলেছেন কোন দেশ বা সংগঠন যদি চলতি পরিস্থিতির সুবিধা নেওয়ার চিন্তা করে তাদের প্রতি তার একটি শব্দ ‘করবেন না’।

যুক্তরাষ্ট্রের একটি বিমানবাহী রণতরী ইতোমধ্যেই পূর্ব ভূমধ্যসাগরে পাঠানো হয়েছে এবং আরও একটি রণতরী পাঠানো হবে।

গাজার জন্য ইসরায়েলের ‘শেষ খেলা’যদি হামাস ব্যাপকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে প্রশ্ন উঠবে যে তখন কী ঘটবে? ইসরায়েল ২০০৫ সালে গাজা উপত্যকা থেকে সামরিক বাহিনী ও হাজার হাজার বসতি স্থাপনকারীকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়েছিলো এবং দখলদার বাহিনী হিসেবে সেখানে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা তাদের নেই।

অফির উইন্টার মনে করেন, ক্ষমতার পালাবদল ক্রমশ ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে সেখানে ফিরিয়ে আনার পথ তৈরি করবে। হামাস তাদের ২০০৭ সালে বিতাড়িত করেছিল। এই কর্তৃপক্ষ এখন পশ্চিম তীরের একাংশ পরিচালনা করে। তার মতে, মিশর আরও বাস্তববাদী প্রতিবেশীকে স্বাগত জানাবে।

আরও পড়ুন: আল জাজিরা বন্ধ করে দিতে চায় ইসরায়েল

গাজার ধ্বংস হওয়া অবকাঠামো আবারো আগের মতো পুনঃনির্মাণ করতে হবে। ইসরায়েলে হামাসের হামলার আগে গাজায় প্রবেশে বেশ কড়াকড়ি ছিল। এখন ইসরায়েল আরও বেশি কড়াকড়ি আরোপ করতে পারে। গাজায় বড় ধরনের নিরপেক্ষ এলাকা তৈরির আহ্বান আসছে। তবে যুদ্ধের ফল যাই হোক না কেন, এবারের মতো হামলা যেন আর কখনো না হয় সেটাই নিশ্চিত করতে চাইবে ইসরায়েল।

টিটিএন