মতামত

শারদীয় দুর্গোৎসব ও ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’

কেউ স্বীকার করুক আর না করুক, সব দেশেই সংখ্যালঘুরা অবহেলিত। তবে সংখ্যালঘু বলতে যদি ধর্মীয় সংখ্যালঘুর প্রসঙ্গ আসে তাহলে বলতেই হবে এই উপমহাদেশের চিত্র অনাকাঙ্ক্ষিত। কখনো কখনো ভয়ংকরও। অথচ বাংলাদেশ ও ভারত দুটি দেশেরই রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতা। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় পরিচয়ই সাম্প্রদায়িকতার ওপর প্রতিষ্ঠিত। মিয়ানমারের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা রাষ্ট্রীয় অবহেলাই শুধু নয় রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসেরই শিকার। তাই শেষোক্ত দেশ দুটিতে সংখ্যালঘুরা যে জীবদ্দশায়ই নরকবাসী তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

Advertisement

আমাদের দেশের সংখ্যালঘুরা কেমন আছে? জবাব খুঁজতে গেলে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ চলে আসে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শিক ভাবনার বিষয়ের যে হাল, এখানকার সংখ্যালঘুদের অবস্থাও তাই। তবে এমন বলার সুযোগ নেই এখানে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদ আছে। কিন্তু সাংবিধানিকভাবে দেশের প্রতিটি নাগরিকের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব যে সরকারের সেই সরকার তা পালন করতে পেরেছে কতটুকু? যদি না পেরে থাকে, তাহলে দায়িত্ব পালনে তাদের আন্তরিকতার ঘাটতি আছে কি না সেটাও ভাবতে হবে।

প্রতি বছর দুর্গাপূজা এলে আমাদের চোখ কান খাড়া হয়ে থাকে, এই বুঝি ওমুক জায়গায় মূর্তি ভাঙার সংবাদ পড়বো। যেমনি পূজা শুরুর মাসকাল আগে থেকে প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় সর্বজনীন পূজা উদযাপনের বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসন সংখ্যালঘুদের সঙ্গে রুটিন বৈঠকের ব্যবস্থা করে, আর সেসব সংবাদ আমরা পত্রিকায় পড়ে থাকি। তারপরও মূর্তি ভাঙার খবর হয়। যদিও অলৌকিকভাবে এবছর মূর্তি ভাঙার সংবাদ কমই চোখে পড়ছে। দুই বছর আগে কুমিল্লায় মূর্তির পায়ে পবিত্র কোরআন রেখে যে তাণ্ডব তৈরি করা হয়েছিল, সেই তাণ্ডবের হোতা মুসলমান এক তরুণ গ্রেফতার হয়েছিল ঘটনার কিছুদিনের মধ্যেই। চিহ্নিত করা ও গ্রেফতার হওয়ার মাঝখানের সময়টায় এই তাণ্ডব ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে।

বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায় সেসময় তাদের বছরের শ্রেষ্ঠ ধর্মীয় উৎসব পালন করতে পারেনি। উৎসব করেওনি প্রতিবাদ হিসেবে। কিন্তু কি হয়েছে সেই প্রতিবাদের পরিণতি? এতদিনেও বিচার হয়নি, মূর্তির পায়ে কোরআন রাখা সেই তরুণের। নাসিরনগর, শাল্লা, রামুর ঘটনার পরিণতি কেউ কি জানেন? পাগল সাজিয়ে তাদের দায়মুক্তির চেষ্টা শুরু থেকেই করা হয়েছিল। জানি না সুস্থ হিসেবে তারা এখন মুক্ত জীবনযাপন করছে কি না।

Advertisement

এমন পরিস্থিতিতে দেশের সংখ্যালঘুরা যখন লঘুতর হচ্ছে তখন ভাবনার বিষয়টা শুধু সচেতন সাধারণ মানুষের জন্যই নয়, এটা রাষ্ট্রীয়ভাবেও উদ্বেগের। দেশের জনসংখ্যা যেখানে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে, সেখানে সংখ্যালঘুদের ক্রমহ্রাস রাষ্ট্রের দায়িত্ব পালনের সাফল্য-ব্যর্থতার নিরিখে হিসাব করতে হয়। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা দেশ ছাড়ছে কেন? অবশ্যই তারা নিজ দেশে থাকার নিরাপত্তা পাচ্ছে না বলেই। আর অন্য কারণ আছে কি? সেই বিবেচনায় সমাজ ও রাষ্ট্র দায় এড়ায় কীভাবে?

এমন পরিস্থিতিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের স্বার্থ রক্ষায় গঠিত ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’ আন্দোলনে নেমেছে তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর নিশ্চয়তার দাবিতে। তাদের দাবিগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ কম। বিভিন্ন পরিস্থিতি-পরিবেশের কারণে তারা রাষ্ট্রের কাছে ‘সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন’ করা ও তার বাস্তবায়ন দাবি করেছে। সংবিধান অনুযায়ী সম্প্রদায়, ধর্ম, অঞ্চল ইত্যাদি ভেদে নাগরিকে নাগরিকে পার্থক্য করার সুযোগ নেই।

একইসঙ্গে ২৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সাম্প্রদায়িকতা অভিধায় পড়ে এমন সংগঠন বক্তব্য দেওয়ারও সুযোগ নেই। সেই অর্থে ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’ গঠন নিয়ে কেউ কেউ কথা বলতে পারেন। যেমন বলা যায়, ইসলামকে ব্যবহার করে দল ও সংগঠন করার বিষয়টি। এক্ষেত্রে প্রয়োজন ও পরিস্থিতির বিষয়টি চলে আসে। কেন এই সংগঠনের আত্মপ্রকাশ হলো। তার জবাব পাওয়া গেলেই বিষয়টির সমাধান হতে পারে।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এই দেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির জন্মলাভ করে সাবেক সেনাপ্রধান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরে। আর তখনই বোঝা গিয়েছিল বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থা কোথায় যেতে পারে। আজ সংখ্যালঘুরা সংখ্যালঘুতর হওয়ার মূলসূত্র সেখানেই। সেই সময় শুধু সাম্প্রদায়িক রাজনীতিই চালু হয়নি, ইসলামের নাম ব্যবহার করে বিভিন্ন সংগঠনের জন্ম হয়েছে, তাও আমরা দেখতে পাই।

Advertisement

এই ধারা এরপর আর থামেনি। সংবিধানে সাম্প্রদায়িকতা নিষিদ্ধ হওয়ার পরও নির্বাচন কমিশন সব জেনেশুনেই সাম্প্রদায়িক দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়েছে, সেটাও হাল আমলেরই ঘটনা। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতিপক্ষ জামায়াতে ইসলামী নামের সংগঠনটি এখনও রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করছে। এমন পরিস্থিতিতে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যদি তাদের আত্মরক্ষার প্রয়োজনে সংঘবদ্ধ হয়, তাহলে তাকে সংবিধানবিরোধী বলার সুযোগ থাকে না। আর এই সংগঠনটি যে দাবি করছে, সেই দাবিরও যৌক্তিকতা খণ্ডন করার সুযোগ থাকে না পারিপার্শ্বিক কারণে।

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের আহ্বানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় অনশন ধর্মঘট পালন করে। আগেও তারা বিভিন্ন কর্মসূচি মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায়ে চেষ্টা করেছে। এতদিন সরকারি পর্যায়ের কোনো নেতা তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। কিন্তু সম্প্রতি আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক কবির বিন আনোয়ার অনশনস্থলে গিয়ে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতা অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্তকে পানি পান করিয়ে অনশন ভঙ্গ করিয়েছেন। বলা যায়, আন্দোলনকারীদের ডাকে সরকারি দলের সাড়া মিলেছে। সংবাদ সূত্রে জানা যায়, সরকারি দলের নেতা তাদের দাবি মানার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন।

সরকারি দলের আশ্বাস অবশ্যই আশা জাগানোর মতো। কিন্তু ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের যে অবস্থা, তাতে শুধু আইন করে কি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে? কুমিল্লা, রামু কিংবা শাল্লার ঘটনা চলতি আইনেই মারাত্মক অপরাধ হিসেবে গণ্য। অপরাধীদের বিচারও প্রচলিত আইনেও করা যায় বলে বিভিন্ন মহল থেকে শুনেছি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে-বিচার হয়নি। হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেও মনে হয় না।

সংখ্যালঘু কমিশন গঠনের দাবিও রয়েছে ঐক্য পরিষদের। এই কমিশনও কতটা ক্ষমতাধর হবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। তারপরও একটা কিছু হোক। অন্তত বিপদে আপদে দোহাই দেওয়ার সুযোগ হবে।

সরকারি দলের নড়েচড়ে বসার পর আলোচনা হচ্ছে, ভোটে সংখ্যালঘুদের আকর্ষণের জন্যই তারা সংখ্যালঘুদের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেছে। সমঝোতার চেষ্টা করেছে। সাম্প্রতিক প্রতিশ্রুতিকেও অনেকেই নির্বাচনে সংখ্যালঘুদের টানার অংশ বলে মনে করেন। আমি বলি হোক না, তাও যদি দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যে কিছুটা নিরাপত্তাবোধ হয় তাতে আপত্তি কি? চলতি মেয়াদেই যদি সরকার অন্তত আইনি ভিত্তিটা একটু মজবুত করতে পারে সেটাও হবে মন্দের ভালো।

সরকারের পক্ষ থেকে যখন বলা হয়, তাদের দাবি পূরণের ব্যাপারে সরকার সচেষ্ট তখন বলাই যায়, সরকারও তাদের দাবিগুলোকে যৌক্তিক বলে স্বীকার করছে। কিন্তু যখন আওয়ামী লীগ নেতা ড. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘রাজনৈতিক বাস্তবতায় সব সময় সব দাবি মেটানো সম্ভব হয় না’। তখন এই রাজনীতি নিয়েই প্রশ্ন আসে। সংবিধানের মূল ধারণা যেখানে নাগরিক হিসেবে সংখ্যালঘু হিসেবে কেউ চিহ্নিতই হওয়ার কথা নয়, সেখানে রাজনৈতিক বাস্তবতার বিষয়টি বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

প্রশ্ন আসে আমাদের সামনে কি সংবিধান, মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চেয়ে বড় কিছু আছে? বাংলাদেশের জন্মসূত্রের আকাঙ্ক্ষা ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় আন্তরিকতার প্রমাণ দেখতে চাই আমরা। দেখতে চাই দেশটা সব নাগরিকের সব সম্প্রদায়ের এবং এখানে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুর ভেদ থাকবে না। সংবিধানে নির্দেশিত সব নাগরিক সমান অধিকার পাওয়ার অধিকারী হবে এমন প্রত্যাশা অবশ্যই অবাস্তব কিছু নয়।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট।

এইচআর/ফারুক/এএসএম