আমির হোসেন কয়েক বছর আগেও সমতলে ধান আর পাহাড়ে সবজি চাষাবাদ করতেন। এখন তিনি স্ত্রীকে নিয়ে দিয়েছেন একটি হোটেল। স্ত্রী রান্নার কাজ করেন আর তিনি একজন শ্রমিক নিয়ে পর্যটকদের খাবার-দাবার পরিবেশন করেন। একইসঙ্গে ক্যাশিয়ারের কাজও করেন।
Advertisement
সবুজ আগে ছিলেন ইলেকট্রিশিয়ান। কখনো কাজ থাকতো, কখনো থাকতো না। গ্রামে পর্যটকদের ভিড় বাড়ায় নিজেই বাড়ির সামনের একটি জায়গায় দিয়েছেন জার্সি কাপড় ও অ্যাংলেটের দোকান। বেশ ভালোই চলছে তার ব্যবসা।
শুধু আমির হোসেন, সবুজ কিংবা রহিমা নয়, চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলার খৈয়াছড়া ঝরনা বদলে দিয়েছে অনেকের জীবন। এক ঝরনার ওপর নির্ভর করে চলছে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য।
৫০ বছর আগে থেকে নির্জন পাহাড়ের গহীন থেকে প্রবাহিত হচ্ছে ঝরনাটি। খৈয়াছড়া ইউনিয়নে বলে এটিকে খৈয়াছড়া নামকরণ করা হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও ইউটিউবের কল্যাণে গত পাঁচ-ছয় বছর ধরে ধীরে ধীরে খৈয়াছড়া ঝরনার সৌন্দর্যের কথা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। দিন দিন প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে টানতে সক্ষম হয় ঝরনার মহনীয় সৌন্দর্য।
Advertisement
দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এখানে ঘুরতে এসে তৈরি করে নানারকম অ্যাডভেঞ্চার ভ্লগ। এসব ভ্লগ দেখে দেখে আকৃষ্ট হয়ে আরও নতুন নতুন পর্যটক এখানে ভিড়তে থাকেন। একসময় বাড়তে থাকে বিভিন্ন জিনিসপত্রের চাহিদা। খৈয়াছড়া ঝরনাকে ঘিরে বদলে যেতে শুরু করে এখানকার স্থানীয়দের একাংশের জীবন-জীবিকা।
কথা বলে জানা গেছে, ক্ষুদ্র পরিসের অনেকেই শুরু করেন ব্যবসা। উঁচু পাহাড় হওয়ায় পর্যটকদের উঠতে কষ্ট হয় তাই কেউ বিক্রি করেন পাহাড়ি বাঁশের লাঠি। ঝিরিপথে পাথরের কণা পায়ে লেগে পর্যটকরা আঘাত পান। এজন্য কেউ শুরু করেন ফুটবল খেলার অ্যাংলেট বিক্রি। ঝরনায় নেমে গোসলের সুবিধার জন্য কেউ কেউ শর্ট, থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট বিক্রি করেন। তীব্র রোদে পুড়ে পর্যটকদের গলা শুকিয়ে যায়, অনেকে শক্তি হারিয়ে ফেলেন। এসব চিন্তা করে স্থানীয়দের কেউ বিক্রি করছেন পানির বোতল, কেউ সিদ্ধ ডিম, কেউবা ঘরের বানানো নাস্তা। আবার ঝরনা ঘুরে ফেরার সময় অনেকে ভালো পানিতে হাত, পা পরিষ্কার করতে চান। এজন্য কেউ কেউ কূপের পানিতে পরিষ্কার হতে দিয়ে টাকা রোজগার করছেন। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরাও করছে টুকটাক ব্যবসা।
উপজেলার খৈয়াছড়া ইউনিয়নের পূর্ব খৈয়াছড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. শামসুদ্দিন (৪৫)। দুবছর আগেও অন্যের কাছ থেকে বর্গা নেওয়া জমিতে করতেন চাষাবাদ। ভোরে হালের গরু নিয়ে ফসলের মাঠে ছুটে যেতেন। দিনভর তীব্র রোদে পুড়ে হাড় ভাঙা পরিশ্রম করে ফিরতেন সন্ধ্যায়। কোন কোন বছর ফসল তুলে লাভবান হতেন। আবার কোনো কোনো বছর জমি বর্গার খাজনা দিতেও হিমশিম খেতেন। মৌসুম শেষ হলে সংসারে নুন আনতে ফানতা পুরাতো। কিন্তু এখন শামসুদ্দিন একজন পুরাদস্তুর ব্যবসায়ী।
স্ত্রী আকলিমা আক্তারকে নিয়ে পরিচালনা করছেন একটি ঘরোয়া রেস্টুরেন্ট। দেশী হাঁস, মুরগি, কবুতর, মাছ, মাংস আর ভাত রান্না করে বিক্রি করছেন। বেচা-কেনাও হরদম হচ্ছে। আগের চেয়ে অনেক বেশি স্বাবলম্বী হয়েছেন শামসুদ্দিন। ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা করাচ্ছেন। দিয়েছেন পাকা বাড়িও।
Advertisement
রহিমা বেগম ওই গ্রামের একজন কৃষাণী। পর্যটকদের চাপ বাড়লেও খৈয়াছড়া গ্রামে গাড়ি রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। বিশেষ করে বাইকারদের দল যখন বেড়াতে আসে তখন তারা বিপাকে পড়ে শখের বাইক রাখা নিয়ে। এ কথা চিন্তা করে রহিমা তার বাড়ির উঠানে বাইক পার্কিংয়ের ব্যবসা শুরু করেছেন। কৃষি কাজের পাশাপাশি শুক্রবার ও বিভিন্ন ছুটির দিনে ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হয় তার। প্রতিটি বাইক পার্কিংয়ে ৫০ টাকা করে নেন। পর্যটকরাও স্বাচ্ছন্দ্যে নিরাপদে তার বাড়ির উঠানে বাইক রেখে যাচ্ছেন।
এদিকে কোনো কোনো যুবক কাজ করছেন পর্যটকদের গাইড হিসেবে। কেন না দুর্গম পাহাড়ি আঁকাবাঁকা ঝিরিপথ, গিরিপথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেই পথ হারিয়ে ফেলেন। এভাবেই খৈয়াছড়া গ্রামের ভেতরে জমে উঠেছে বিভিন্ন ধরনের ব্যবসা। ধীরে ধীরে বাড়ির সামনেই অনেক খুলে দেন ঘরোয়া হোটেল। ব্যানার, পোস্টারে নানারকম অফার জুড়ে দিয়ে ভাতের ব্যবসা করছেন গ্রামের কৃষকরা।
গত ৬ বছরে খৈয়াছড়া ঝরনায় অন্তত ২০টি হোটেল চালু হয়েছে। এসব হোটেলের সবকটি স্থানীয়রা পরিচালনা করেন। এছাড়া আচার, ঝালমুড়ি, পানি, সিদ্ধ ডিম, বাঁশের লাঠি, কাপড়, অ্যাংলেট, মোবাইলের ব্যাগ, শরবত, নাস্তার দোকান গড়ে উঠেছে শতাধিক। এসব দোকান যারা পরিচালনা করেন তাদের প্রত্যেকেই আগে কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। আবার কেউ দিনমজুর হিসেবে কাজ করে সংসার চালাতেন। কিন্তু এখন সবাই ব্যবসায়ী।
ইকবাল খৈয়াছড়া গ্রামের বেকার যুবক। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। একদিন দেখলেন একদল পর্যটক বলাবলি করছেন তাদের দামী মোবাইল ফোন পানিতে পড়ে নষ্ট হয়েছে। ইকবাল তার এক বন্ধুর কাছে দেখেছেন মোবাইল ফোনকে পানি থেকে বাঁচাতে বিশেষ ব্যাগ ব্যবহার করতে। ঠিক করলেন খৈয়াছড়ায় এ ধরনের ব্যাগ বিক্রি শুরু করবেন। এরপর তিনি প্রথমে হেঁটে বিক্রি করতেন। পরে কয়েক প্রকার আইটেম নিয়ে একটি দোকান দিয়ে দেন। এখন ইকবালের দোকানে প্রতিদিন গড়ে ৫০-৬০টি মোবাইল ব্যাগ বিক্রি হয়৷। বিক্রি বাড়াতে ইকবাল দিচ্ছেন বিশেষ ছাড়ের ঘোষণাও।
একইভাবে ফয়সাল, মোবারক, আলাউদ্দিন, সালাউদ্দিন, আহম্মেদ, বশির তারা প্রত্যেকেই ছিলেন গ্রামের কৃষক, খামারি, দিনমজুর। আর খৈয়াছড়া ঝরনার বদৌলতে তারা এখন সবাই ব্যবসায়ী। ব্যবসা করে স্বাবলম্বীও হয়েছেন। ঘুরে গেছে অনেকের জীবনের মোড়ও।একইসঙ্গে বদলে গেছে এখানকার জীবিকার উৎস।
ব্যবসায়ী মো. সবুজ বলেন, দিনে ন্যূনতম ১০০ জন পর্যটক খৈয়াছড়া ঝরনায় বেড়াতে আসেন। শুক্রবার ও ছুটির দিনগুলোতে ২-৩ হাজার পর্যটকের ভিড় হয় এখানে। এ সময় বেচা-বিক্রি সবচেয়ে বেশি। কোনদিন কম বিক্রি হলেও ছুটির দিনে সেটি পুষিয়ে যায়।
শামসুদ্দিন বলেন, আমাদের গ্রামের অনেকেই ভাতের হোটেল দিয়েছেন। পর্যটকরা এসব হোটেলে আগে থেকে অর্ডার করে যান। দুপুরে বা বিকেলে ফেরার পথে তারা খাবার খান। ঘরোয়া পরিবেশের রান্না পর্যটকদের বেশি আকৃষ্ট করে। এছাড়া দামও হাতের নাগালে।
খৈয়াছড়া ঝরনায় ঘুরতে আসা নুসরাত জাহান, মাঈনুদ্দিন, দিদারুল আলমসহ বেশ কয়েকজন পর্যটকের সঙ্গে কথা জাগো নিউজের। তারা জানান, খৈয়াছড়া ঝরনায় যাওয়ার পথে যে দোকান, হোটেল, রেস্টুরেন্ট আছে তারা শুধু ব্যবসাই করছে না পাহাড়ে যাওয়ার পথে তারা পর্যটকদের সতর্ক করছেন। যেখানে বন বিভাগ ও ইজারাদার কোনো ধরনের সতর্কতামূলক নির্দেশনাও দেয়নি সেখানে ব্যবসায়ীদের নির্দেশনাগুলো থেকে অনেক পর্যটক সতর্ক হচ্ছেন। এতে ভ্রমণ হচ্ছে আরও রোমাঞ্চকর ও নিরাপদ। এছাড়া প্রয়োজনীয় অনেক জিনিসপত্রের সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে এসব দোকানের বদৌলতে। খৈয়াছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুল হক জুনু জাগো নিউজকে বলেন, খৈয়াছড়া ঝরনার কারণে স্থানীয় অনেকের জীবন বদলে গেছে। কেউ বেকার ছিলেন, কেউ কৃষক ছিলেন। এখন এরা পুরোদমে ব্যবসায়ী। ওই এলাকার প্রায় ৫০০ মানুষ ঝরনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ব্যবসা করছেন। এতে তারা যেমন লাভবান হচ্ছেন, তেমনি দূর-দূরান্ত থেকে এখানে ছুটে আসা লোকজন উপকৃত হচ্ছেন।
মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ইউনিয়নে বারৈয়াঢালা জাতীয় উদ্যানের আওতায় থাকা এ ঝরনাটি বন বিভাগ ইজারা দিয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক থেকে প্রায় এক কিলোমিটার যেতে হয় সিএনজি অটোরিকশায় চেপে। ২০ টাকার টিকিট কেটে প্রবেশ করতে হয় মূল ট্রেকিংয়ে। এরপর হেঁটে যেতে আরও অন্তত ৪ কিলোমিটার ঝিরি ও গিরিপথ। এখানকার পাহাড়গুলো বেশ উঁচু। বর্ষাকালে পিচ্ছিল ও কর্দমাক্ত হয়ে ওঠে এ পথ। এজন্য অনেক বেশি সতর্ক হতে হবে। খৈয়াছড়া ট্রেইল ট্রেকিংয়ে আছে মোট ১২টি ঝরনা। প্রত্যেকটি ঝর্ণায় শীতল পানির অবিরাম ধারা বয়ে যাচ্ছে। মনোমুগ্ধকর এ দৃশ্য উপভোগে দেশের নানা প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটকরা ছুটছেন খৈয়াছড়ায়। তবে অসতর্কতা ও অসাবধানতায় প্রায় ঘটছে মৃত্যুর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা।
গেলো বছর খৈয়াছড়ায় যাওয়ার পথে রেলক্রসিংয়ে মাইক্রোবাসে ধাক্কা দেয় দ্রুতগামী ট্রেন। এতে ১৩ জন পর্যটক প্রাণ হারান। এছাড়া ঝরনার কূপে গোসলে নেমে ডুবে গিয়ে, কিংবা পা পিছলে পড়ে মৃত্যু হয়েছে অনেকের।
স্থানীয়দের ভাষ্য, খৈয়াছড়া ঝরনায় যাওয়ার একমাত্র গ্রামের রাস্তাটির দৈন্যদশা। দক্ষ, সচেতন ইজারাদার, পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাবে ঘটছে দুর্ঘটনা। ট্যুরিস্ট পুলিশের ক্যাম্প স্থাপন, সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত, সড়ক তথা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন করা গেলে খৈয়াছড়া ঝরনা হয়ে উঠবে উত্তর চট্টগ্রামের সবচেয়ে ব্যস্ততম পর্যটন স্পট। এতে বাড়বে সরকারের রাজস্ব আয়ও।
বারৈয়াঢালা রেঞ্জ কর্মকর্তা একেএম আলতাফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের রেঞ্জের আওতাধীন খৈয়াছড়া, নাপিত্তাছড়া, রূপসী, সোনাইছড়ি, সহস্রধারা ঝরনা ইজারা দেওয়া হয়েছে। চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত প্রায় ৭০ হাজার পর্যটক ঝরনায় প্রবেশ করেছে। এরমধ্যে ৩৫ হাজার জন শুধু খৈয়াছড়া ঝরনা দেখতে গেছেন। এসব পর্যটকের কাছে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন স্থানীয়রা।
ঝরনার ইজারা পাওয়া ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এএইচ এন্টারপ্রাইজ তত্ত্বাবধায়ক নাজমুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বারৈয়ঢালা রেঞ্জের সবকটি ঝরনা ২৯ লাখ টাকায় ইজারা নিয়েছি। জামানত দিয়েছি ৭ লাখ টাকা।
তিনি আরও বলেন, এখানকার সব ঝরনাকে ঘিরে স্থানীয় লোকজন স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তবে বেশি স্বাবলম্বী হয়েছেন খৈয়াছড়া ঝরনাকে ঘিরে। অনেকে বেকার ছিল, এখন ঝরনার কারণে তাদের জীবনযাত্রার চিত্র পাল্টেছে।
এম মাঈন উদ্দিন/এসজে/এএসএম