অর্থনীতি

অর্ডার দিলেই হাজির গরম গরম পাউরুটি-কেক

দেশে একসময় আটা-ময়দাজাত পণ্যের চাহিদার প্রায় পুরোটাই সরবরাহ করতো পাড়া-মহল্লার হস্তচালিত বেকারিগুলো। এখন এটা বড় বড় শিল্পগ্রুপের দখলে। নতুন করে আনাচে-কানাচের কনফেকশনারির দোকানগুলো হয়ে উঠছে একেকটি লাইভ বেকারি। এতে দুরবস্থায় পুরোনো বেকারিগুলো। রয়েছে আরও কিছু সমস্যা। এসব নিয়ে জাগো নিউজের তিন পর্বের ধারাবাহিকের আজ থাকছে প্রথম পর্ব।

Advertisement

অর্ডার দিলেই মিলছে গরম গরম পাউরুটি, বনরুটি ও কেক। পাওয়া যাচ্ছে হরেক রকম বিস্কুটসহ অন্যান্য বেকারি আইটেমও। সবকিছু তৈরি হচ্ছে ক্রেতার চোখের সামনে, পাড়া-মহল্লার দোকানের মধ্যে। সেখানেই আটো মেশিন (স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র) বসিয়ে দোকানেই বেকারি গড়ে তুলেছেন উদ্যোক্তারা। এগুলোকে বলা হচ্ছে ‘লাইভ বেকারি’।

আরও পড়ুন: বেকারি খাদ্যে ক্ষতিকর পটাশিয়াম ব্যবহার বন্ধে নির্দেশনা

বিদেশে এ ধরনের বেকারি বহুল প্রচলিত। দেশেও এর আগে গুলশান-বানানীতে দু-একটা ছিল। তবে ঢাকা শহরজুড়ে বিস্তৃত হচ্ছে নতুনভাবে। চলতি বছরই বেশি চোখে পড়ছে এর ব্যাপ্তি। শুরু থেকেই এ ধরনের বেকারিতে ভোক্তাদের আগ্রহ প্রবল। পণ্য উৎপাদনের অধিকাংশ ধাপ আটোমেশিনে বলে আপাতদৃষ্টিতে এটা পরিচ্ছন্ন–সতেজ মনে করছেন তারা। সেজন্য অল্প সময়ের মধ্যে নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে উচ্চবিত্তদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বেশ। ভালো হচ্ছে বেচা-বিক্রি।

Advertisement

মহল্লার লাইভ বেকারির বিভিন্ন পণ্য/জাগো নিউজ

খিলগাঁওয়ের একটি বেকারি থেকে পণ্য কিনতে আসা তমাল হোসেন জাগো নিউজেক বলেন, ‘চোখের সামনে পণ্য তৈরি হচ্ছে। তাই মনে হচ্ছে এটা কোনো কনফেকশনারির দোকানে রাখা বেকারি পণ্যের চেয়ে ভালো। এছাড়া এটা যে মেয়াদোত্তীর্ণ নয়, সেটাতো নিশ্চিত হতে পারছি নিজে। এই বেকারি চালু হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন পণ্য খাচ্ছি। টাটকা বলে সুস্বাদুও লাগে।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকায় এখন এ ধরনের বেকারির সংখ্যা প্রায় একশো। খিলগাঁও, বাসাবো, রামপুরা, বাড্ডা এলাকায় সবচেয়ে বেশি। এছাড়া বরিশালে এ ধরনের কিছু বেকারি গড়ে উঠেছে।

আরও পড়ুন: দাম বাড়ায় ক্রেতা কমছে বেকারি পণ্যের

Advertisement

যারা এ ধরনের বেকারি চালাচ্ছেন তারা বলছেন, স্বল্প পুঁজি, কম শ্রমিক ও অল্প জায়গায় এসব বেকারি করা যাচ্ছে, যা গতানুগতিক হস্তচালিত বেকারির চেয়ে সাশ্রয়ী। এছাড়া লাইভ বেকারির মূলযন্ত্রটি (ডেক ওভেন) এলপিজি গ্যাসে চালানো যায়। ফলে বাণিজ্যিক গ্যাসের লাইনের প্রয়োজন হয় না। একটি দোকানে পণ্য তৈরি ও বিক্রি সম্ভব হচ্ছে।

লাইভ বেকারি নাবিল ফুডের স্বত্বাধিকারী নুরে আলম জাগো নিউজকে বলেন, ‘নানা কারণে পুরোনো বেকারিগুলো ভালো চলছে না। সেজন্য এ লাইভ বেকারিতে যাচ্ছেন আগের বেকারি মালিকরা। এটি এখন ভালো চলছে।

মহল্লার লাইভ বেকারির কেক/জাগো নিউজ

তিনি বলেন, ‘হস্তচালিত বেকারিতে একটি কারখানা প্রয়োজন, আবার পণ্য বিক্রির জন্য অলাদা দোকান বা শোরুম লাগে। লাইভ বেকারিতে এক জায়গায় উৎপাদন ও বিক্রি দুটিই হচ্ছে। একজন শ্রমিক বেকারির কাজ করছেন, আবার কাজ না থাকলে বিক্রিতে সহায়তাও করছেন। ফলে অল্প শ্রমিক দিয়ে এগুলো চলছে।’

লাইভ বেকারিতে কত খরচ?

নুরে আলমসহ কয়েকজন উদ্যোক্তা জানান, খুব ছোট পরিসরে লাইভ বেকারির যন্ত্রাংশের জন্য তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা বিনিয়োগ লাগে। মাঝারি পরিসরে দশ লাখ পর্যন্ত, যা পুরোনো বেকারিগুলোর চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী।

চীন থেকে আমদানি হওয়া এর মূল যন্ত্র ডেক ওভেনের দাম দুই থেকে ছয় লাখ টাকার মধ্যে, যা উৎপাদন সক্ষমতার ওপর নির্ভর করে। এছাড়া এক লাখের মধ্যেও ভালোমানের মিক্সার মেশিন (খামির তৈরির যন্ত্র) ও এর অর্ধেক দামে স্লাইস মেশিন (রুটি কেক কাটার যন্ত্র) দিয়েও এমন বেকারি শুরু করা যাচ্ছে। এছাড়া আলাদা পণ্যের যন্ত্র আলাদা আলাদা ফর্মা লাগে।

আরও পড়ুন: বহু বেকারির খাদ্য এখন অখাদ্য

হট লাইভ বেকারির মাহিম বলেন, ‘একটি হস্তচালিত বেকারির জন্য ৫০ লাখ টাকা লাগে। এখানে দশ লাখে ভালোভাবে ব্যবসা করা যাচ্ছে। এজন্য সবাই এ ধরনের বেকারিতে ঝুঁকছে।’

মহল্লার লাইভ বেকারির পাউরুটি/জাগো নিউজ

এসব বেকারির উদ্যোক্তারা এ-ও বলছেন, ‘আগের বেকারিগুলোর ব্যবসা খুব খারাপ যাচ্ছে। বড় বড় কোম্পানি এ খাতে বিনিয়োগ করেছে। ফলে অনেকে হস্তচালিত বেকারি বন্ধ করে বাধ্য হয়ে লাইভ বেকারি করে টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।’

খিলগাঁও রেলগেট এলাকায় এমন লাইভ বেকারি রয়েছে ছয়- সাতটি। সেগুলোতে দেখা গেলো ভালো বেচাকেনা হচ্ছে। বেকারিগুলোতে ময়দা, তেল, চিনি মিশিয়ে মেশিনে খামির তৈরিতে আধাঘণ্টা সময় লাগে, এরপর সেগুলো আলাদা ফর্মায় সাজিয়ে ওভেনে দেওয়া হচ্ছে। সেখানে প্রায় আধাঘণ্টা লাগে। এরপর গরম গরম পরিবেশন করা হচ্ছে ক্রেতার সামনে।

আরও পড়ুন: বেকারিতেই শেষ বেকারত্ব

রহমানিয়া বেকারির সোবহান বলেন, ‘এখন গ্যাসের লাইন পাওয়া যায় না হস্তচালিত নতুন বেকারির করার জন্য। এসব লাইভ মেশিন সিলিন্ডার গ্যাসে চলে। ফলে খরচ অনেক কম। ঝামেলা নেই। বিক্রি থাকলে চলে, না থাকলে বন্ধ রাখা যায়।’

হট বেকারির এনামুল হোসেন বলেন, ‘ডেক ওভেনে রুটি ও কেক ছাড়াও টোস্ট থেকে শুরু করে বাখরখানির মতো সবকিছু এক মেশিনে বানানো সম্ভব, যা আগের পুরোনো মেশিনগুলোতে হতো না। এ প্রযুক্তির কাছে পুরোনো বেকারিগুলো মার খাচ্ছে। একসময় সব বেকারি এমন মেশিন ব্যবহার করবে।

মহল্লার লাইভ বেকারিতে বিকিকিনি/জাগো নিউজ

লাইভ বেকারিপণ্যের দাম

লাইভ বেকারির পণ্যগুলোর দাম সচরাচর অন্য হাতে তৈরি বেকারিপণ্যের মতোই বলা যায়। এখানে বড় পাউরুটি এলাকাভেদে ৮০ থেকে ১০০ টাকা, মাঝারি ৫০-৬০ টাকা ও ছোট রুটি ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া বনরুটি বিক্রি হচ্ছে ১৫ টাকা।

এছাড়া এলাকাভেদে নানা ধরনের কেক বিক্রি হচ্ছে বড়গুলো ১৬০-২০০ টাকা, মাঝারি ৮০ থেকে ১০০ এবং ছোট ৩০-৫০ টাকা। পিস কেক ১৫ টাকা।

অনুমোদন ছাড়াই চলছে ‘লাইভ বেকারি’

জনপ্রিয় হলেও এসব লাইভ বেকারির অধিকাংশ বাংলাদেশে স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) অনুমোদিত নয়। এছাড়া এসব বেকারির পণ্যের নেই মোড়কজাতকরণ সনদ, যা পণ্য বিক্রি ও বিপণনের জন্য বাধ্যতামূলক।

আরও পড়ুন: বেকারিপণ্যের দাম ২০% বাড়ানোর সিদ্ধান্ত, বেড়েছে ৫০%

এ বিষয়ে নাবিল ফুডের স্বত্বাধিকারী নুরে আলম বলেন, শুরুতে আমরা প্রায় ১০-১২ জন বেকারি মালিক বিএসটিআইয়ে প্রস্তাব করেছি এসব নিবন্ধনের জন্য। এখনো সেটি হয়নি। কিছু আইনি জটিলতা রয়েছে।

মহল্লার লাইভ বেকারিতে তৈরি হচ্ছে পণ্য/জাগো নিউজ

তিনি বলেন, ‘যারা লাইভ বেকারি চালু করেছেন তাদের অনেকের সাধারণ বেকারি চালানোর লাইসেন্স আছে। তারা এখন এসব লাইভ বেকারি করছে মাত্র। নিশ্চয় সরকার কোনো আইন করলে সেটা আমরা মানবো।’

বিএসটিআইয়ের উপ-পরিচালক রিয়াজুল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘লাইভ বেকারির পণ্যের অনুকূলে বিএসটিআই থেকে মান সনদ গ্রহণ বাধ্যতামূলক হয়েছে গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে। আগামী দুই মাস পর থেকে বিএসটিআইর মান সনদ গ্রহণ ছাড়া বিক্রি-বিতরণ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে।’

এনএইচ/এএসএ/এএসএম