শিক্ষা

‘পৃথিবী দ্রুত পাল্টে গেছে, আমাদের শিক্ষাটা পাল্টায়নি’

স্কুলের সামনে চলছে মানববন্ধন। সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে শতাধিক শিক্ষার্থী। তাদের সামনে ‘মাদককে না বলুন’ লেখা ব্যানার। হঠাৎ একপাশ থেকে কাগজের বানানো প্রতীকী মাইক্রোফোন হাতে ধীর পায়ে এগিয়ে এলো ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রী। সাবলীল উপস্থাপনায় জানালো- কী হচ্ছে সেখানে, কেনইবা মানববন্ধন করছে শিক্ষার্থীরা। এ যেন পুরাদস্তুর সাংবাদিক!

Advertisement

প্রোজেক্টরে চলা ভিডিওতে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রীর এমন সাবলীল উপস্থাপনায় সাংবাদিকতার হাতেখড়ি নিতে দেখে ততক্ষণে হলভর্তি মানুষের করতালি। সবার মধ্যে বিস্ময়। বৃহস্পতিবার (১২ অক্টোবর) দুপুরে এমন দৃশ্য দেখা গেলো রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলের ওয়েসিস হল রুমে। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ‘বিশেষ মতবিনিময় সভা’ শুরুও হলো শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল এমন অনেকগুলো কাজের ভিডিও দেখানোর মাধ্যমে।

তুমুল করতালির মধ্যে ডায়াসে এলেন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) সদস্য অধ্যাপক ড. মশিউজ্জামান। তিনি জানালেন, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের এমন সৃজনশীল হিসেবে গড়ে তোলার কাজটিই তারা করছেন।

ড. মশিউজ্জামান বলেন, ‘ভিডিও ডকুমেন্টটি আমরা ঘটা করে বানাইনি। শিক্ষার্থীদের এমন কাজের ছবি-ভিডিও শিক্ষকরা ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন। সেখান থেকে এগুলো সংগ্রহ করা।’

Advertisement

সভায় ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১ রূপরেখা’ অনুযায়ী প্রণীত নতুন শিক্ষাক্রম বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তারিক আহসান। নতুন শিক্ষাক্রম কী, কেন এটা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে কী ধরনের পরিবর্তন আসবে, তা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে তুলে ধরেন তিনি।

এরপর শুরু হয় মুক্ত আলোচনা। এ পর্ব পরিচালনা করেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। শুরুতেই মতামত তুলে ধরেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক ও ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত।

তিনি বলেন, ‘পৃথিবী দ্রুত পাল্টে গেছে, যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষাটা পাল্টাইনি। দেশের ১৪ কোটি মানুষের হাতে মোবাইল ফোন। ৮ কোটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট। আরও বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় বহু মানুষ। এগুলো আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা যে রূপান্তর করতে চাচ্ছি, সেখানে দুটো জিনিস গুরুত্বপূর্ণ। একটা হলো- সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ, দ্বিতীয়টি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। এ দুটো যেন মূলভিত্তি হিসেবে থাকে। সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ঠিক থাকলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধরে পথ হাঁটবে তরুণ প্রজন্ম।’

একাত্তর টিভির হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদ বলেন, ‘এতদিন আমরা রাস্তাঘাট-অবকাঠামো উন্নয়ন করেছি। মগজ ঠিক করেছি কি না, তা নিয়ে কিন্তু প্রশ্নটা থেকেই গিয়েছিল। আজকের অনুষ্ঠানে এসে মনে হচ্ছে আমরা মগজ ঠিক করার কাজে হাত দিয়েছি। সেই পথে এগোচ্ছি। দেশের মানুষের ক্রিয়েটিভ মাইন্ড তৈরিতে আমরা কাজ করছি, এটা অসাধারণ। মানুষ বানানোর কাজটা শুরু হলো। এ যাত্রা সফল হবে বলে প্রত্যাশা করি।

Advertisement

সাংবাদিক মুন্নী সাহা বলেন, ‘শিক্ষাক্রম নিয়ে এতক্ষণ যা শুনলাম, বুঝলাম- তাতে আমার কাছে চমৎকার মনে হয়েছে। তবে যারা এখনো শিক্ষার মূলধারায় আসেনি; বিশেষ করে কওমি মাদরাসাগুলো, সেগুলোকেও যেন মূলধারায় আনার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে নতুন এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন করলে সমতাবিধান করা সম্ভব হবে।’

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, ‘শিক্ষার ঘরটা এখন পোক্ত, শিক্ষক-শিক্ষা নড়বড়ে। এটা থেকে আমাদের বের হওয়া জরুরি ছিল। শিক্ষার সেই রূপান্তর প্রক্রিয়ার শুরুটা দেখছি আমরা। যে যাত্রা শুরু হয়েছে, সেটা আমাদের শক্ত জায়গায় পৌঁছে নিয়ে যাবে।’

তিনি বলেন, ‘রূপান্তর মানেই সাংস্কৃতিক রূপান্তর, বিশাল পরিসর। এটা এক বছর, দুই বছরে হয় না। ২০১৭ সাল থেকে ২০২৭ সাল পর্যন্ত এক দশক সময় নেন। যদিও এক দশক একটা রূপান্তর প্রক্রিয়ার জন্য খুব বেশি সময় নয়।’

জ্যেষ্ঠ এ সাংবাদিক আরও বলেন, ‘এ ধারা অব্যাহত রাখতে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো রাজনৈতিক নেতৃত্ব। রাজনৈতিক নেতৃত্ব ছাড়া কোনো রূপান্তর হবে না, হয়ও না। কেউ যদি বলেন—তত্ত্বাবধায়ক, অমুক-তমুক, তৃতীয় শক্তি। আমি বলবো- তাদের দিয়ে কোনো রূপান্তর সম্ভব নয়। পৃথিবীতে কোথাও তৃতীয় শক্তি, অস্বাভাবিক কিছু বা সামরিক শক্তি দিয়ে রূপান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। কাজেই এ দিকটা আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।’

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান বলেন, ‘যে রূপরেখা তৈরি করা হয়েছে, তা বিশেষজ্ঞদের নিয়েই করা হয়েছে। এখানে দ্বিমত থাকা কিংবা বক্তব্য দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে গেলে অবশ্যই শিক্ষকদের কথাটা মাথায় রাখতে হবে। শিক্ষকরা এটা বাস্তবায়ন করবেন। তাদের প্রশিক্ষণ ও মানসিকতা তৈরিতে মাস্টারপ্ল্যান করে কাজ করতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘সামনে আমাদের জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনের কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয় যে মহাপরিকল্পনা নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছিল, সেটি কিন্তু মাঝপথে আটকে গেছে। শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো করাও সম্ভব হয়নি। সবদিক মাথায় রেখে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে কাজ করতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. আব্দুল হালিম বলেন, ‘একটা জায়গা থেকে তো অবশ্যই পরিবর্তনটা শুরু করতে হবে। আমাদের যাত্রাটা এখান থেকে শুরু হোক। আর পিছিয়ে থাকতে চাই না, অগ্রগামী হতে চাই। এখন কাজ হলো—নতুন শিক্ষাক্রমে যেসব সুবিধা রয়েছে, তা সবাইকে জানাতে-বোঝাতে হবে। কাজটা করার প্রধান দায়িত্ব আমাদের শিক্ষকদের।’

শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে সবার আন্তরিকতা প্রয়োজন। এটা নিয়ে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি করতে পারলে দেশের পুরো কাঠামো বদলে যাবে। যা স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে।’

স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে দক্ষ মানবসম্পদ সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। নাগরিকদের দক্ষ করে গড়ে তোলার এ দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তারা যে নতুন শিক্ষাক্রম করেছে, তাতে দক্ষ ও যোগ্য মানবসম্পদ তৈরি হবে।’

প্রত্যেক বক্তার মতামতের পরই সংক্ষেপে জবাব দেন শিক্ষামন্ত্রী। ডা. দীপু মনি বলেন, ‘সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ ঠিক রাখার বিষয়টি আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি। আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মনন গড়ে তুলতে কাজের ক্ষেত্রে আমরা সবসময় সতর্ক হয়ে এগোচ্ছি। আশা করি- শিক্ষার্থীরা সেভাবেই গড়ে উঠবে।’

কওমি মাদরাসায় শিক্ষাক্রম চালুর বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘কওমি মাদরাসাকে মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় আনার পরিকল্পনা আমাদের রয়েছে। তবে হুট করে সেটা সম্ভব নয়। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে যে পদ্ধতিটা চলে আসছে, তা পাল্টে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করাটা সময়সাপেক্ষ কাজ।’

নতুন শিক্ষাক্রমে অভিভাবকদের বাড়তি খরচের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অনেক কাজ শিক্ষার্থীরা করছে। এতে অভিভাবকদের যে বিভিন্ন কিছু কিনে দিতে হচ্ছে, সেটা আমরাও জেনেছি। এখন শিক্ষকরা যেসব কাজ দিচ্ছে, তা অনেক সময় না বুঝেও অতিরিক্ত দিয়ে দিতে পারেন। প্রশিক্ষণে তাদের এ বিষয়ে আরও সুস্পষ্ট ধারণা দিলে সেভাবে কাজ করাতে পারবেন তারা। আশা করি- তখন অভিভাবকের খরচের চাপটা কমবে।’

মতবিনিময় সভায় সংসদ সদস্য, শিক্ষাবিদ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, এনসিটিবি, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অংশ নিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেন। তাদের মতামত বিবেচনা করে তা কাজে লাগানোর চেষ্টার কথা জানান শিক্ষামন্ত্রী ও এনসিটিবি কর্মকর্তারা। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন এনসিটিবির চেয়ারম্যান মো. ফরহাদুল ইসলাম।

এএএইচ/জেডএইচ/জেআইএম