ফিলিস্তিনের মানুষের পক্ষে স্বাধীনতার পর থেকে সমর্থন রয়েছে বাংলাদেশের। দেশের সাধারণ মানুষের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে ফিলিস্তিনের সাধারণ মানুষের প্রতি। ১৯৭৩ সালে সর্বশেষ যুদ্ধে ফিলিস্তিন মানুষের পক্ষে লড়াই করেছে বাংলাদেশের মানুষ। বাংলাদেশে নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসেফ এসওয়াই রামাদানের মতে, 'বাংলাদেশের মানুষ আমাদের (ফিলিস্তিনের) জন্য সরাসরি রক্ত ঝরিয়েছে।' যেখানে দুই দেশের মধ্যকার ঐতিহাসিক সম্পর্কটা এমন, সেখানে এই ইস্যুতে বিএনপি'র সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড অনেকটা 'ধরি মাছ, না ছুঁই পানি'র মতো। কিন্তু কেনো?
Advertisement
বঙ্গবন্ধু ফিলিস্তিনের মানুষকে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বাংলাদেশের মানুষ যেমন পাকিস্তানের শোষণ নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে ১৯৭১ সালে অস্ত্র হাতে নিয়ে বুকের রক্ত ঝরিয়েছিলও এবং ছিনিয়ে এনেছিলো স্বাধীনতা, অনেকটা একইভাবে নিজের অধিকার ও স্বাধীনতা লাভের জন্য ইসরাইলের বিপক্ষে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিন।
যখনই বাংলাদেশের ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ ছিলো, জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশন ও অন্যান্য ফোরামের আলোচনায় সর্বদা ফিলিস্তিনের মানুষের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে বাংলাদেশ। শুধু অবস্থান নয়, বাংলাদেশের ছিলো অকুণ্ঠ সমর্থন ফিলিস্তিনের প্রতি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ফিলিস্তিন ইস্যুতে সর্বশেষ জাতিসংঘের আলোচনায় সরাসরি দেশটির প্রতি সমর্থনের কথা জানান।
পক্ষান্তরে সম্প্রতি ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইল যখন চরাও হচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র তাদের সর্বাত্মক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ইউএসএস জেরাল্ড আর ফোর্ড, একটি মিসাইল ক্রজার এবং চারটি মিসাইল ডেস্ট্রয়ার ঢুকছে ভূমধ্যসাগরে ইসরায়েলকে সহায়তার জন্য। এ ছাড়াও ফাইটার জেট এবং যত আর্মস এন্ড অ্যামুনেশন প্রয়োজন ইসরায়েলকে সরবরাহের নিশ্চয়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর আরও একটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ভূমধ্যসাগরে প্রেরণের ঘোষণাও দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এদিকে ফিলিস্তিনের নাম না নিয়ে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে ইসরাইল। গাজায় বড় ধরণের সামরিক হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে দেশটি। আকাশ পথে আক্রমণের পাশাপাশি ভূমিতে বড় হামলা চালাবে বলে ঘোষণা দিয়েছে ইসরাইল।
Advertisement
গাজায় ইসরাইলের এমন হামলা ও প্রস্তুতি নিয়ে যখন সমালোচনার ঝড় উঠেছে বিশ্ব জুড়ে, ঠিক তখন ফিলিস্তিনের পক্ষে সরাসরি অবস্থান না নিয়ে অনেকটা নিরপেক্ষ ভূমিকায় বিএনপি ও তার সিনিয়র নেতৃবৃন্দ। কিন্তু কেনো? বিএনপির শীর্ষ নেতা ও দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান সম্প্রতি এক্সে (সাবেক টুইটার) করা এক পোস্টে জানান, তিনি সব ধরণের সহিংসতার বিপক্ষে এবং জাতিসংঘ, ওআইসি ও বিশ্ব নেতাদের এই সংঘাতময় পরিস্থিতি বন্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানান তিনি।
এই পোস্টে ফিলিস্তিনের মানুষের প্রতি সমর্থন বা বিগত চার-পাঁচ দশক ধরে ফিলিস্তিনের মানুষের প্রতি ইসরাইলের দমন ও অত্যাচারের কথা একবারও বলা হয়নি। বাংলাদেশের অধিকাংশ সাম্প্রদায়িক দলকে নিয়ে চলা বিএনপিও দলের শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের এই একটি পোস্টকে রিটুইট করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ বলে মনে করেন। সেখানে ইসরাইলের আগ্রাসনে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়েও নেই কোন কথা। অথচ এই দলটি বরাবরই দাবি করে আসছে 'আওয়ামী লীগ ইসলাম বিরোধী দল' এবং 'তারাই (বিএনপি) ইসলামের পক্ষের দল'। প্রশ্ন থাকে, তাহলে ফিলিস্তিন ইস্যুতে এতো চুপ কেনো দলটি।
সম্প্রতি বিএনপির শীর্ষ নেতার পাশাপাশি একাধিক নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের এজেন্ট হিসেবে পরিচিত মেন্দি এন সাফাদি। চলতি বছরের ৯ জুলাই বাংলাদেশের এক টেলিভিশনে দেয়া সাক্ষাৎকারে সাফাদি বলেন, তার সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের কথা হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মেন্দি বলেন, ‘হ্যাঁ, কথা হয়েছে। তবে এ বিষয়ে এখন বেশি কিছু বলতে চাচ্ছি না।’ এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় যেখানে বিএনপির শীর্ষ নেতা তারেক রহমানের সঙ্গে মেন্দি এন সাফাদি কথা বলছেন বলে দেখা যায়। সেখানে মেন্দি এন সাফাদি বলেন, ‘শুভ সকাল মি. রহমান। আমি মেন্দি। আপনার প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছে। আমরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেছি। আমি মনে করি, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা নিয়ে আমি কাজ করছি।’ এই ভিডিওতে মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে দেখা যায় বিএনপির কৃষিবিষয়ক সহসম্পাদক কৃষিবিদ চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল ফারুক ও বিএনপিপন্থী সাংবাদিক মামুন স্ট্যালিনকে।
ইসরায়েলের লিকুদ পার্টির সঙ্গে যুক্ত মেন্দি এন সাফাদি বাংলাদেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে দেয়া সাক্ষাৎকারে শুধু তারেক রহমানের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে নিয়েই কথা বলেননি। এর পাশাপাশি তিনি জানান, বাংলাদেশে (আওয়ামী লীগ) বিরোধী দল ক্ষমতায় এলে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ভালো হবে। সেই সঙ্গে বিরোধী দল ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী গোষ্ঠীগুলোকে ‘সন্ত্রাসী গোষ্ঠী বলে মনে করেন’ বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন মেন্দি এন সাফাদি।
Advertisement
বিএনপির কাছেও জানতে চাওয়া, এ দেশের ৯০ শতাংশের বেশি জনগণকে বাদ দিয়ে তারা কী রাজনীতি করতে চায়? তা না হলে ফিলিস্তিনের মানুষের পক্ষে কেনো আওয়াজ তুলছে না দলটি?
বিএনপির সঙ্গে থাকা আরেকটি দল গণঅধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নুরের সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়টিও নিশ্চিত করেন মেন্দি এন সাফাদি। নুরের সঙ্গে ডিসেম্বর মাসে দুবাইয়ে তার দেখা হয়েছিলো বলে জানান মেন্দি। নুরও বাংলাদেশের সঙ্গে ইসরাইলের দৃঢ় সম্পর্ক তৈরির বিষয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন বলে জানান ইসরাইলের লিকুদ পার্টির এই সদস্য। এর আগে বিএনপি নেতা আসলামকেও এই মেন্দির সঙ্গে দেখা করতে দেখা যায়।
এ সকল হিসেব থেকে বেশ স্পষ্ট যে, বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর সঙ্গে দেখা ও মত বিনিময় হয়েছে ইসরাইলের এই এজেন্টের। আর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিএনপি ও তার সহ সংগঠনের নেতারা সবাই ইসরাইলের সঙ্গে দৃঢ় সম্পর্ক তৈরির বিষয়ে মেন্দি এন সাফাদিকে আশ্বস্ত করে।
মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে ইসরাইলের অন্যতম একটি প্রোপাগান্ডা হলো, 'ইসলাম মানেই জঙ্গি ও সন্ত্রাসী।' আর এটি প্রমাণের জন্য ইসলামপন্থী বিভিন্ন জঙ্গি ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা প্রদান করে এসেছে ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। বিগত সময়ে সারা বিশ্বে ত্রাস সৃষ্টি করা আইএসআইএস-কে তথ্য ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তার মাধ্যমে সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পতনের চেষ্টার ক্ষেত্রেও মোসাদের জড়িত থাকার বিষয়টি চলে আসে বেশ কিছু যুদ্ধ বিশেষজ্ঞের আলোচনায়।
ইসরাইলের মতই মুসলিমদের সন্ত্রাসী তকমা দিতে ২০০১-০৬ সাল পর্যন্ত কাজ করে বিএনপি। দেশ জুড়ে অসংখ্য তথাকথিত ইসলামপন্থী জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ও বাংলাদেশকে পাকিস্তানের মতো একটি ব্যর্থ ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণের চেষ্টায় বাংলা ভাই, জেএমবি, আনসারুল্লাহসহ অসংখ্য জঙ্গি গোষ্ঠীকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে বিএনপি তথা তার শীর্ষ নেতা তারেক রহমান। বিএনপির এই শীর্ষ নেতার সঙ্গে বিশ্বের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের একজন দাউদ ইব্রাহিমের বৈঠক হয়েছে বলেও গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানিয়েছে। ইসলাম নামধারী জঙ্গিবাদের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকলেও ফিলিস্তিনের মানুষের পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন প্রদানে একেবারেই অনীহা তারেক রহমানের।
ক্ষমতায় আসতে বিএনপির যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের সহায়তা গ্রহণের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়েছে সম্প্রতি ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধের বিষয়টি সামনে আসার পর। যুক্তরাষ্ট্রের কিছু কংগ্রেসম্যান ও রাজনীতিকের সমর্থনেই বর্তমান সরকারকে অসংবিধানিকভাবে পতনের মাধ্যমে সম্প্রতি ক্ষমতায় আসার কথা ভাবছে বিএনপি। আর এ কারণেই নির্বাচন বর্জন ও সরকার পতনের আন্দোলনের অনড় তারা।
যেহেতু দেশের জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসার বাধ্যবাধকতা দেখছে না দলটি, তাই এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরাইলকে চটাতে চায় না বিএনপি। দলটির শীর্ষ নেতৃত্বেও ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলায় রয়েছে অনীহা। ফিলিস্তিনের ওপর ইসরাইলের হামলা ও বর্তমানে বড় পরিসরে হামলার প্রস্তুতি গ্রহণের পরও দলটির নেতৃবৃন্দের বক্তব্যে শুধুই সরকার পতনের ডাক। সেখানে ফিলিস্তিনের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের বিষয়টি বারবার এড়িয়ে যাচ্ছে। বিএনপির বর্তমান এই অবস্থানে আরও জনবিচ্ছিন্ন হচ্ছে দলটি।
বিএনপি তথা নুর ও অন্যান্য রাজনীতিবিদদের ইসরাইল সংযোগ বিষয়ে প্রশ্নের উত্তরে গণমাধ্যমে দেয়া সাক্ষাৎকারে ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূত ইউসেফ এসওয়াই রামাদান জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের পাশে রয়েছে। রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ আমরা। এই দেশের ৯০ ভাগেরও বেশি জনগণ সরাসরি সমর্থন দেয়া আমাদের। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা সহায়তা করে যাচ্ছে ফিলিস্তিনিদের। এখন এই দেশের ৯০ শতাংশ মানুষকে বাদ দিয়ে যদি কোন দল বা ব্যক্তি রাজনীতি করতে চায়। এটা তাদের বিষয়। এ বিষয়ে আমার কিছু বলার নেই।
তাই বিএনপির কাছেও জানতে চাওয়া, এ দেশের ৯০ শতাংশের বেশি জনগণকে বাদ দিয়ে তারা কী রাজনীতি করতে চায়? তা না হলে ফিলিস্তিনের মানুষের পক্ষে কেনো আওয়াজ তুলছে না দলটি?
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/জিকেএস