যেসব ফ্যামিলিতে স্বামী-স্ত্রী দুজনই আয় করছেন, তারা তাদের ফাইন্যান্সকে কীভাবে ম্যানেজ করবেন সেটা নিয়ে অনেকেই দ্বিধায় থাকেন। আমার পরিচিত একটি কাপল একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। স্ত্রী মাসের বেতন পাওয়ার সাথে সাথেই স্বামী তাঁর বেতন হান্ড্রেড পার্সেন্ট নিয়ে নিতেন। এটাই ওই পরিবারের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। স্বামী তার নিজের মতো করে সংসার চালাতেন। ভদ্রমহিলা বেশির ভাগ সময়ই খুব অশান্তিতে ভুগতেন এবং এই বিষয়টি নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সার্বক্ষণিক দ্বন্দ্ব লেগে থাকত।
Advertisement
কোনো কোনো ফ্যামিলিতে দেখবেন স্বামী আয় করছে, স্ত্রী হয়তো আয় করছেন না কিন্তু পুরো টাকাটা স্ত্রীর কাছে থাকছে এবং স্বামী সেখান থেকে অল্প অল্প করে টাকা নিয়ে প্রয়োজনে খরচ করছেন। এখানেও একটা অস্বস্তির ব্যাপার আছে। টাকাটা কোথায় যাবে, কোন হিসাবে যাবে সেটা নিয়েও একটা বিরূপ পরিবেশের সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে এবং হরহামেশাই হচ্ছে। আবার অনেক ফ্যামিলি আছে যেখানে স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করছেন, দুজনই আয় করছেন, তারাও তাদের পার্সোনাল ফাইনান্সটা কীভাবে ম্যানেজ করবেন সেটা ঠিক করতে হিমশিম খাচ্ছেন।
পরিবার হচ্ছে একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্গানাইজেশন এবং সমাজের খুবই ইম্পরট্যান্ট একটা ইউনিট। এই পরিবার থেকেই আপনার সন্তান জন্মলাভ করে, এই পরিবার বিস্তার লাভ করে এবং অসংখ্য পরিবার তৈরি হয় যার সমষ্টিকে আমরা সমাজ এবং রাষ্ট্র বলি। এই পরিবার যখন আপনি ম্যান্যেজ করতে যাবেন তখন অনেক কিছু মেইনটেইন করে আপনাকে চলতে হয়। আমরা আলোচনা করছি কীভাবে যৌথ আয়ের সংসারে টাকার ব্যবস্থাপনা করতে হবে সেটা নিয়ে।
যৌথ আয়ের সংসারে পার্সোনাল ফাইনান্স ম্যানেজমেন্ট করতে প্রথম যেটা দরকার, সেটা হচ্ছে, এক, স্বামী-স্ত্রী দুজনের একটা মুক্ত আলোচনায় বসা দরকার। তাদের ঠিক করে নিতে হবে তারা কীভাবে সামনে যাবেন, কোন পথে সামনে অগ্রসর হবেন, সামনে তারা কী কী বাস্তবায়ন করবেন। এসব বিষয়ের মধ্যে প্রথম যেটি আসা দরকার, এটা আমার ব্যক্তিগত মতামত অবশ্য, সেটি হলো দুজনের পরিবারের মা-বাবার সংসারের সদস্যদের কার কী নিডস আছে সেটাকে অ্যাসেসমেন্ট করে ফেলা (যদি দুজনের বাবা-মা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল থাকেন তাহলে এটা না করলেও চলবে)। যে ধরনের জীবন তারা যাপন করছেন, সেই ধরনের জীবন যাপন করার জন্য কেমন খরচ মাসে দরকার।
Advertisement
বাবা-মার প্রতি দায়িত্ব সর্বপ্রথম এবং আমি মনে করি আপনার আয় থেকে যে নিজেকে আগে পেমেন্ট করবেন বা যা সঞ্চয় করবেন সেই সঞ্চয়ের চেয়েও এটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তারা কষ্ট করে আপনাদের মানুষ করেছেন এবং বাবা-মা’রা, তাদের সমস্ত উজাড় করে, জমি/সম্পদ বিক্রি করে ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া শিখিয়েছেন। তাই আপনাদের আয়ের একটা অংশ দুই পরিবারের বাবা-মা’য়ের সংসারে যেতে হবে।
এখন কথা হচ্ছে, কত অংশ উভয়ের পরিবারে যাবে, এটা সঠিক হিসাব করা যাবে না আসলে। এক্ষেত্রে মুক্তমনে নিডস অ্যাসেস করে আপনার ইনকামের যে পোরশনটা তাদের দরকার, সেই অংশটা দিয়ে দিতে হবে। কেউ কেউ বলেন, গ্রস ইনকামের দশ পার্সেন্ট। আমি কোনো পার্সেন্টেজের কথা বলতে চাই না। আপনি নিডসটাকে আগে অ্যাসেস করেন। তারপর যে সাপোর্ট তাদের লাগবে সেটা দিতে হবে।
দুই, আপনারা দুজন বসে আপনাদের ভবিষ্যতের লক্ষ্য ঠিক করে নিন। আপনাদের হয়তো একটা বাড়ির স্বপ্ন আছে বা একটা অ্যাপার্টমেন্টের স্বপ্ন আছে। সেটি আপনি কতদিন পরে কিনতে চান? ভবিষ্যতে আপনার ফ্যামিলিতে কী কী দরকার, তার জন্য একটা বাজেট করুন। দুজন মিলে যে ইনকাম আসছে, সেই ইনকামের কত পার্সেন্ট আপনারা সঞ্চয় করতে চান সেটা ঠিক করে ফেলুন। দুজনের সংসার চলতে বাড়িভাড়া থেকে শুরু করে বিল পেমেন্ট, বেসিক নিডগুলো ফুলফিল করতে আপনার কত টাকা দরকার, সেটার হিসাব করুন। অনেকের শখ থাকে যে প্রতি ছয় মাস অন্তর একবার কোথাও ঘুরতে যাবেন।
তাহলে ভ্রমণের জন্য আপনার একটা পোরশন সঞ্চয় করা দরকার। বাচ্চাদের এডুকেশনের জন্য একটা খরচ আছে। বিভিন্ন ধরনের খরচের খাতগুলোকে চিহ্নিত করে, দুজন মিলে সমন্বিতভাবে একমত হয়ে একটা প্ল্যান সেট করুন। যা যা আপনি চান, তার জন্য আপনার কত টাকা খরচ হবে, দুই বছর পরে আপনার কত টাকা লাগবে, পাঁচ বছর পরে আপনার কত টাকা লাগবে, দশ বছর পরে আপনার কত টাকা লাগবে এগুলো আলোচনা করে প্ল্যান করে নিন।
Advertisement
আপনাদের আয়ের অংশগুলোকে আপনি কোন কোন খাতের জন্য সঞ্চয় করবেন সেটির প্ল্যান করেন, আপনারা অ্যালোকেট করে ফেলেন। কার টাকা কোন কাজে লাগাবেন সেটা ঠিক করে লিখে ফেলুন। টাকা ব্যবহারের একটা রুল আছে, ৫০/৩০/২০ নীতি, এটা আপনি মানতে পারেন। সমস্ত প্রয়োজনীয় খরচ আপনি পঞ্চাশ পার্সেন্টের মধ্যে নিয়ে আসেন।
বাকি যে পঞ্চাশ পার্সেন্ট থাকছে সেই তার থার্টি পার্সেন্ট আপনি আপনার শখের বিভিন্ন জিনিস কিনতে খরচ করতে পারেন। আর বাকি যে বিশ শতাংশ থাকে সেটা আপনি সঞ্চয় করুন। এটার একটু এপাশ ওপাশ হতে পারে, অসুবিধা নেই তাতে। মূলত আপনারা আপনাদের জীবনকে কীভাবে সাজাতে চান, একটা সময় পরে আপনারা নিজেদের কোথায় দেখতে চান, এই উদ্দ্যেশেই আর্থিক প্ল্যানটা করা জরুরি। যে প্ল্যানই আপনি করেন, দুজন মিলে যখন আলোচনার ভিত্তিতে করে ফেলছেন এবং লিখে ফেলছেন, তখন দুজনের মধ্যে আর কোনো ঝগড়াঝাটি বিবাদের কোনো প্রশ্ন থাকছে না।
আমি ব্যাংকে কাজ করেছি দীর্ঘদিন। সেখানে কাজ করার সময় দেখেছি, ছেলেরা ব্যাংকে যখন অ্যাকাউন্ট খুলতে আসে, ৯৯ পার্সেন্ট ছেলেরা তাদের স্ত্রীদের নমিনি করেন কিন্তু অদ্ভুতভাবে আমি খেয়াল করেছি, ৯৯ পার্সেন্ট মেয়ের ক্ষেত্রে এটা উল্টা। তারা স্বামীকে নমিনি করতে চান না। যদি বাচ্চা থাকে তাহলে বাচ্চাকে নমিনি করেন অথবা তার নিজের পরিবারের কোনো সদস্যকে নমিনি করেন। যৌথ জীবনে এসব ক্ষেত্রেও দুজন মিলে একটা আলোচনায় এসে সিদ্ধান্ত নিতে হবে যে, আপনারা যে আয়ের একটা নির্দিষ্ট অংশ সঞ্চয় করবেন, এটা কি স্ত্রীর নামে দশ পার্সেন্ট বা ফিফটিন পার্সেন্ট সেভ করবেন, নাকি স্বামীর নামে করবেন, নাকি দুইজন মিলে একটা জয়েন্ট একাউন্টে সঞ্চয় করবেন।
আমার মতে এই সেভিংসের টাকাটা জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে সঞ্চয় করা ভালো। যদি কোনো ডিপিএস হয়, দুজনের নামে হোক এবং দুজনেই একটা অংশ এখানে সঞ্চয় করবেন। সেই ক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন আসবে যে এটার নমিনি কে হবে? এটাও দুজন আলোচনা করে ঠিক করতে হবে। ডিসিশন এমনভাবে নিতে হবে যেন, যদি কোনো বিপদ হয় তখন যেন একজন পুরো বঞ্চিত না হয়ে যায়। এটা আপনারা আপনাদের মতো করে ঠিক করবেন।
একটা কথা বলে রাখা খুব দরকার, সব ঠিকঠাক করার পরে যখন আপনি কাজে নামবেন তখন রেইনি ডের জন্য কিছু সঞ্চয় করা দরকার। যখন দুইজন আয় করছেন, তখন ছয় মাস থেকে এক বছর এর জন্য ইমার্জেন্সি ফান্ড গঠন করে নেবেন এবং এমন একটা অ্যাকাউন্টে টাকাটা রাখবেন যেন আপনারা প্রয়োজনে যখন ইচ্ছা টাকাটা ওঠাতে পারেন।
তিন, আপনারা একটা বাজেট করে সামনে এগুবেন। খরচ ট্রাক করবেন। প্রতিদিন না পারেন অন্তত প্রতি সপ্তাহে একবার দুজন বসে খরচ রিভিউ করবেন। যদি অপ্রয়োজনীয় খরচ করে থাকেন তাহলে ভবিষ্যতে যেন তেমন খরচ এড়াতে পারেন সেদিকে সচেষ্ট হবেন। টাকা সংক্রান্ত কু-অভ্যাস থাকলে সেখা থেকে বের হয়ে আসবেন। দুজন মিলে ইউটিউবে ঢুকে finfacts চ্যানেলটি দেখবেন। অনেক সাহায্য সেখান থেকে পাবেন।
চার, দুজনে টাকা সঞ্চয় করতে করতে একসময় দেখবেন আপনাদের হাতে অনেক টাকা জমে গেছে। আপনাদের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে ছোট ছোট করে জমতে জমতে অনেক টাকা হয়েছে। এবার দুজন মিলে বিনিয়োগের চিন্তা করুন। শুধু সঞ্চয় করলে আপনাদের টাকা কিন্তু বাড়বে না। দুজনের মধ্যে এই টাকা খরচ নিয়ে, বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো ঝগড়া করবেন না। সেখানেই বিবাদ, সেখানেই গন্ডগোল, সেখানেই ঝামেলা যেখানে আগে আলাপ করে কোন কিছু ফিক্সড করা না থাকে।
দুজন আলাপ করলে তারপরও যে ঝামেলা হবে না সেটা নয়। ঝামেলা হলে আলোচনা করে ঠিক করে নেবেন। কেউ কারও প্রতি খুব রিজিড হবেন না। উদার হলে দেখবেন দ্রুত সামনে এগুতে পারছেন। যেহেতু এটা একটা ফ্যামিলি টার্গেট আপনারা ফ্যামিলি গঠন করেছেন, একসাথে সারা জীবন চলার জন্যে এটা দুজনকে বুঝতে হবে। দুজনের প্রতি দুজনের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা রেখে দুজনের নিডকে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করতে হবে। দেখতে হবে ফ্যামিলির ফিনান্সিয়াল লক্ষ্য যেটা সেটা ঠিক থাকছে কিনা, সঠিক ডিরেকশানে এগুচ্ছে কিনা।
পাঁচ, রিটায়ারমেন্টের জন্য টাকা জরুরি। আলোচনা করে ঠিক করুন সেটা কীভাবে করবেন এবং অবসরে দুজন কীভাবে কোথায় কাটাবেন।
আলোচিত বিষয় ছাড়াও আরও অনেক বিষয় আসবে যৌথ আয়ের সংসারে। এখানে সবকিছু আলোচনা সম্ভব হয়নি। আপনাদের কোনো প্রশ্ন থাকলে কমেন্টে জানালে আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো। সবাই আর্থিকভাবে স্বাধীন হন এই কামনা করে শেষ করছি।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক, ফাইন্যান্স ও বিজনেস স্ট্রাটেজিস্ট; ইউটিউবার ও সিইও, ফিনপাওয়ার লিডারশিপ ইন্টারন্যাশনাল।hossain.shaiful@gmail.com
এইচআর/এএসএম